উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দশম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। প্রথম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দ্বিতীয় পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। তৃতীয় পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। চতুর্থ পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। সপ্তম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। অষ্টম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। নবম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দশম পর্ব
দশম পর্ব
আমার গলা দিয়ে স্বর ফুটল না।
এর মধ্যে হাসান ক্যামেরার আলো জ্বেলে ফেলেছে। সে আলোয় আগে যা দেখেছিলাম তাই-ই দেখলাম।
ডিসেকশানের লম্বা টেবিলটা শুন্য। শুধু কালচেটে রক্তের দাগ লেগে আছে। আর পড়ে আছে স্কালপোল, টুইজার, চিমটি এসব।
ঘরের মধ্যে দুজনেই নিরব। হাসান অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ক্যামেরার আলো ঘরের চারিদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে।
কোথাও কিচ্ছু নেই। কেউ নেই। শুধু গ্রীল ছাড়া জানালাটা খোলা। বাইরে ঝড়বৃষ্টির গর্জন।
হাসানের হাতের ক্যামেরার আলো কমে আসছে। বোধ হয় ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। কম সময় তো আর কাজ করা হচ্ছে না।
হঠাৎ মনে হলো জানালার কাছে কিছু একটার শব্দ হচ্ছে। শব্দটা ঝড়-জলের শব্দ না। জানালা গলিয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর কেউ ঢুকলে যেরকম শব্দ হয় সেরকম।
আমার বলা লাগল না। হাসান ক্যামেরার নিভু নিভু আলোর মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে নিল।
যে দৃশ্য দেখলাম তাতে তখনই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ডাক্তারী পড়তে পড়তে বোধ হয় নার্ভ শক্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। প্রচণ্ড ভয়াবহ কোন ঘটনার মুখোমুখি হলে হঠাৎ করে মানুষের ভয় উবে যায়। এক জাতীয় এনজাইম শরীরে চলে আসে। সেই এনজাইম গ্লুকোজ ভাঙতে সাহায্য করে। প্রচুর গ্লুকোজ ভাঙতে শুরু করে। শারীরিক শক্তি চলে আসে। ভয় কমে যায়। অনেকসময় পুরোপুরি চলে যায়।
আমাদের দুজনেরই হঠাৎ করে ভয় চলে গেল। আমরা বেশ স্বাভাবিক ভাবে দেখলাম আমাদের খোলা জানালা গলিয়ে একটা চামড়া ছাড়ানো মৃতদেহ ভেতরে ঢুকছে। মৃতদেহর ছাড়ানো চামড়ার চর্বির স্তরের উপর দিয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির পানি ঝরছে।
মৃতদেহের মুখটা হামিদ ভাইয়ের।
চামড়া ছাড়ানো মৃতদেহটা টুপ করে জানালা গলিয়ে ভেতরে লাফিয়ে পড়ল। গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ ভেসে এল। আর তখনই ক্যামেরার লাইট পুরোপুরি নিভে গেল।
আমরা ডুবে গেলাম অন্ধকারে। এখন আমাদের দুজনের সাথে ঘরে আছে মুখ পিঠ বাদে বাকি শরীরের চামড়া ছাড়ানো একটা পরিচিত মৃতদেহ। যে মৃতদেহটা এতদিন এই ঘরেই বাস করতো।
দুজনের মধ্যে আবার ভয় ফিরে এসেছে। এক খাটের উপর দুজনে জবুথুবু হয়ে বসেছি। একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে।
ঘরের মধ্যে ‘আহ, উহ’ শব্দ করতে করতে হামিদ ভাই হাঁটাহাঁটি করছে। এই ঘর হামিদ ভাইয়ের পরিচিত। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় বাথরুম বা রান্নাঘরের দিকে একবার গেল। আবার ফিরেও এল মনে হয় কিছুক্ষণ পর।
হঠাৎ হামিদ ভাইয়ের পরিচিত গলা শোনা গেল ‘বড় যন্ত্রণা। ছোটভাই, বড় যন্ত্রণা শরীর জুড়ে। বড় তেষ্টা পেয়েছে। একটু পানি খাওয়াতে পারেন।’
আমাদের মুখে কথা সরে না।
‘ওহো, বাইরের বাতাস শরীরে লাগলেও জ্বলে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে যেন গোটা শরীর। ওহ কি যন্ত্রণা। ওহ!
হামিদ ভাইয়ের গলা দিয়ে একজাতীয় জান্তব আওয়াজ বের হতে থাকে।
আমি কিছুটা সাহসে ভর দিয়ে ডাকি, ‘হামিদ ভাই?’
ঘরের কোণ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব আসে, ‘বলেন ছোটভাই। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ওহ অসহ্য যন্ত্রণা। চামড়া চাই। চামড়া। দিতে পারেন ছোটভাই।’
হাসান পাশ থেকে বলে উঠল, ‘তুমি হামিদ ভাই নও। তুমি আমাদের চোখের ভুল। তুমি মরা লাশ। মর্গের টেবিল থেকে আমরা তোমাকে তুলে নিয়ে এসেছি। কাজ করতে করতে আমাদের দুজনেরই মাথা আওলা হয়ে গেছে বলে সব ভুল দেখছি। তুমি কিছু না। চোখের হ্যালুসিনেশন।’
ঘরের কোণা থেকে অতিকষ্টে হাসির শব্দ ভেসে আসে। এই শব্দের সাথেও আমি পরিচিত। হামিদ ভাইয়ের হাসি। সব মানুষের কান্নার ধরণ এক। হাসি ভিন্ন। একেক মানুষের হাসি একেক রকম।
হামিদ ভাই টেনে টেনে অতিকষ্টে বলে, ‘লাশকাটা ঘরের ট্রলির উপরে আমিই ছিলাম। রাতে ওখানেই ঘুমাতাম আমি। ওর চাকায় ইট দিয়ে রেখেছিলাম যাতে না নড়ে।’
হঠাৎ আমার ইটের কথা মনে পড়ে গেল। আমি বললাম ‘ইটগুলো আমি দেখেছি।’
হামিদ ভাই টেনে টেনে বলে ‘যেখানে লাশ আনতে যাওয়ার কথা ওখানে লাশ না পেয়ে তাড়াতাড়ি মেডিকেলে ফিরে আসি। এসে মর্গ খোলা পাই। ভেতরে ঢুকে কিছু করার নেই দেখে আমার ট্রলিতে শুয়ে পড়ি। হালকা আলো চোখ লাগছিল বলে সাদা চাদর মুড়ি দেই। ঘুমিয়ে পড়ি। আর ওই মড়া টানা ট্রলিতে ঘুমিয়ে পড়লে আমার যে কি হয় ঠিক মরার মত হয়ে যাই আমি। শরীরে সব মৃতের লক্ষণ চলে আসে। সকালে আবার ঠিক হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঘটলেও কোন ক্ষতি হচ্ছে না ভেবে কাউকে জানাই নি। তাতে চাকরি চলে যেতে পারে। ওখানে আমার ঘুমানোর কথা না। আজও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মরার ঘুম। তারপর ঘুম ভাঙতেই দেখি আমি এই অন্ধকার ঘরে। শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা। কিছু বুঝে উঠার আগে জানালা গলিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়লাম। বৃষ্টির ফোঁটা চামড়া ছিলা শরীরে পড়তেই যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেল। আবার ফিরে এলাম ঘরে। একটু পানি খাব। বড়ই তেষ্টা।’
আমি ঢোক চিপে কোন মতে বললাম, ‘হামিদ ভাই আমার টেবিলের উপর জগ গ্লাস আছে। নিয়ে খাও।’
অন্ধকারে কিছু সরসর করে সরে যেতে থাকে। পা টেনে টেনে হাঁটার শব্দ হয়। তারপর ঢকঢক করে পানি খাওয়ার শব্দ। পুরো জগই শেষ করে ফেলেছে বোধ হয়।
পানি খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘ছোটভাই, আমার চামড়াটা আমারে দিয়ে দেন। চামড়া ছাড়া বড় কষ্ট। ’
তারপর অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটা কিছু যেন হাতড়াতে থাকে। এঘর ওঘর রান্নাঘর করতে থাকে।
একসময় বৃষ্টি থামে। আর বিদ্যুৎ চমকের আলোয় আমরা দেখি চামড়া বিহীন মূর্তিটা জানালা দিয়ে ‘বড় কষ্ট’ বলে লাফ দেয়। তার হাতে কি যেন ধরা।
এই সময় ফজরের আজান পড়ে।
ঝড় থামায় ইলেকট্রিসিটি চলে আসে।
ঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখি গোটা ঘর বিধস্ত। তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজেছে কেউ। এখানে ওখানে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।
আমি উঠে যেখানে ছাড়ানো চামড়া রেখেছিলাম সেই বাস্কেটের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখি। কিছু নেই। কেউ সব কুড়িয়ে নিয়ে গেছে।
হাসান উঠে ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জে দিয়ে তার ভিডিওকৃত অংশ দেখে।
পুরো রিল ফাঁকা। কিছুই ওঠেনি তাতে।