রহস্য উপন্যাস

উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

ঘেরের মধ্যেই প্রায় সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যায়। কোদাল, শাবল সবই এখানে আছে। ঘেরের কাজেই লাগে ওগুলো। লাশ বয়ে আনতে বস্তাও জোগাড় হয়ে গেল একটা। চিংড়ি মাছের খাবার আনা হয় ওই বস্তায়। আনা হয় চুন।
চুনের বস্তা দেখেই ব্যাপারটা মাথায় খেলে গেল আমার। ইয়াছিন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চুন আছে নাকি ইয়াছিন ভাই?’
‘কতটুক?’
‘এই বস্তাখানিক।’
‘তা হবে। কিন্তু কি করবেন?’
‘চুনগোলা পানিতে লাশ ফেলে পানি ফুটালে হাড়ের গা থেকে সহজে মাংস ছাড়িয়ে যায় শুনেছি। মেডিকেলের মামারা নাকি ওভাবেই হাড়ের গা থেকে মাংস ছাড়ায়।’
বাবুল বলে উঠল, ‘গন্ধ হবে না?’
‘তা হয়তো হবে একটু। কিন্তু ঘেরের এই ফাঁকা জায়গায় গন্ধ হলেও তা শুধু আমাদের ছাড়া আর কারো নাকে লাগবে না। এই একশ বিঘের মধ্যে কারো ঘরবাড়ি নেই।
হামিদের ভাত নিয়ে ঘেরে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। এত জনের ভাত বলে নতুন করে রান্না করেই নিয়ে আসতে হয়েছে। খেয়ে গুছিয়ে উঠতে এগারোটা। তারপর ঘেরের আ’ল ধরে বিশাল ঘের ছাড়িয়ে গ্রামে ঢুকে গ্রামের শেষ মাথার বাগদী পাড়ায় পৌছতে পৌছতে রাত বারোটা বেজে গেল। এদিকে আবার ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে। যে কোন মুহূর্তে কালবোশেখী আক্রমণ করতে পারে। তা না করলেও বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে।
আমরা তিনজন এসেছি। ঘের পাহারা দিতে হবে বলে হামিদ আসেনি। তবে সে ঘেরে নিষ্কর্মা বসে থাকবে না। বস্তার চুন বড় পাত্রে ঢেলে সেটা পানি দিয়ে ফুটাতে থাকবে। যাতে আমরা ফিরে এসেই ওর মধ্যে লাশ ছেড়ে দিতে পারি। ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। আলকাতরা অন্ধকারে গাছের পাতাগুলো কালো ভূতের মত দুলছে। তিন ব্যাটারির টর্চের আলো ফেলে পথ চলছি। ঘের থেকে বাগদী পাড়া কম দূর নয়। ওরা অস্পৃশ্য বলে বোধ হয় গ্রামের শেষ মাথায় নদীর ধারটাতেই পাড়াটা গড়ে উঠেছে।
বাগদী পাড়ায় পৌছতে পৌছতে রাত বারোটা ছাড়িয়ে গেল। আমার আলো জ্বলা ঘড়িতে দেখে নিয়েছি। ছোট ছোট ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে চারিদিক আলোকিত করে দিচ্ছে। তারপর কবরের অন্ধকার। আমি একটু উষ্ম গলায় বললাম, ‘ইয়াছিন ভাই, বাগদীদের কবর খানাটানা কোন দিকে? তাড়াতাড়ি চলো সেদিকে। বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি এসে গেলে কিন্তু কাকভেজা হয়ে যেতে হবে।’
অন্ধকারে ইয়াছিন ভাইয়ের গলা ভেসে আসে, ‘ঘেরেই পড়ে থাকি ছোটভাই। বাগদী পাড়ার কোন জায়গায় কি ঠিক মনে নেই। অনেক আগে এসেছি তো!’
পাশ থেকে বাবুল বলে ওঠে, ‘টর্চটা আমার কাছে দেন ইয়াছিন ভাই, দেখি। আমি খুঁজে পাই কি না। ওদের তেমন বাঁধা ধরা কোন কবর খানা টানা নেই। নদীর ধারে পুঁতে রাখে শুনেছি। চিহ্ন-টিহ্ন আছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।’
এই বৃষ্টির রাতে এখন নদীর ধারে ধারে কবর খানা খুঁজে বেড়াও। মেজাজ খারাপ করতে গিয়েও সামলে নিলাম। এসেই যখন পড়েছি দেখি পাওয়া যায় কিনা। গেলে বেশ হবে। আব্বুর কাছ থেকে হাজার দশেক টাকা ঠিকই লাশ কেনা বাবদ আদায় করবো। শুধু শুধু লাশটা পেয়ে গেলে টাকাটা ডাইল কেনার কাজে রেখে দিতে পারব। ঢাকায় ডাইলের দাম কেমন কে জানে!
বাবুলের চোখ শকুনের চোখ। সে এই অন্ধকারেও শুধু টর্চের আলোয় ভরসা করে ঠিকই বাগদী বৌয়ের কবর খুঁজে বের করল। পাশাপাশি কয়েকটা কবর আছে ঠিকই কিন্তু নতুন কবর দেখলেই চেনা যায়। কবরের মাটি এখনো পাশের মাটির সাথে মিশ খাইনি। নদীর তীরে একটা অতিপ্রাকৃত দৃশ্যের অভিনয় হতে থাকে। টিপ টিপ বৃষ্টি এবং নদীর থেকে উঠে আসা হু হু বাতাসের মধ্যে কবরখানায় আমি দাঁড়িয়ে আছি টর্চ জ্বালিয়ে। ইয়াছিন ভাই কোদাল দিয়ে কবরের মাটি তুলছে আর বাবলু হাত দিয়ে দিয়ে সে মাটিয়ে সরিয়ে স্তূপ করে রাখছে পাশে।
কবরের মধ্যের ওটাকে কোনমতেই কফিন বলা চলে না। চারটে বড় সড় তক্তা দিয়ে কোন মতে একটা বাকসো মত তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে কেবল পচন ধরেছে বাগদী বৌয়ের যুবতী লাশ। আমি ভয়ে লাইটটা ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ইয়াছিন ভাই, তাড়াতাড়ি লাশটা তুলে বস্তায় পুরে ফেলো। এখন অত দেখার সময় নেই। ঘেরে নিয়ে দেখলে হবে কি অবস্থা।’
বাবুলের চোখ সত্যিই শকুনের চোখ। এই অন্ধকারেও সে বলে দিল ‘ইয়াছিন ভাই, ব্যস্ত হাত লাগান। ওয়াপদার রাস্তা দিয়ে কেউ এদিকে আসছে মনে হয়।’
শুনে ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলাম নাকি!
ইয়াছিন ভাই একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘এই সময় সাথে হামিদটা থাকলে ভাল হতো। ওর সাহস খুব। একা আমাদের সাথে লাগতে আসলে আরেকটা লাশ বেশি করে ফেলত। ছোটভাই এক্কেবারে টাটকা লাশ পেয়ে যেত।’
আমি টর্চ জ্বেলে আছি। ওরা দুজনে মিলে ধরাধরি করে বড় সড় বস্তায় যুবতী বৌয়ের ভারী লাশ পুরে মুখ বন্ধ করে ফেলে।
বস্তা নিয়ে রাস্তায় উঠতেই বাবুলের দেখা সেই রাতের আগন্তুকের সাথে দেখা হয়ে যায়।
ইয়াছিন ভাই গলা সপ্তমে তুলে টর্চ জ্বেলে বলে, ‘কে? এত রাতে কে যায়?
ওপাশের অন্ধকারের লোকটা কাঁচুমাচু কণ্ঠে বলে, ‘আমি। বাগদী পাড়ার সন্ন্যাসী বাগদী।’
ইয়াছিন ভাইয়ের বড় গলা। চোরের মায়ের, ‘এই রাত বিড়াতে এদিকে কি করছিস রে! কি মতলব?’
‘কবর খানার দিকে যাচ্ছিলাম।’
‘কবর খানায় কি? তুই কি কবরের পাহারাদার?’
সন্ন্যাসী কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘না মানে বাড়িরতে মনে হলো যেন কবর খানায় কারা ঢুকে কবর খুঁড়ছে। তাই এট্টু দেখতে আসলাম। আমার বউডার তো আবার দুদিন হলো কবর দেয়া।’
‘যা দেখে আয়। একা একা ভয় পাসনে যেন। একে তো কবর খানা। তারপর তোর বউ তো এনডিন খেয়ে মারা গেছে। কষ্ট পেয়ে মরেছে। দেখ কবর ফুঁড়ে উপরে উঠে বসে আছে কিনা।’
সন্ন্যাসী যেন একটু সাহস করে বলে ওঠে, ‘আপনারা কোন খানতে?’
‘আমরা? আমরা তো ঘেরের জন্য চুন আনতে গিয়েছিলাম। জানিসই তো ঘেরের কাজ। রাত বেরাতের কাজ। এই বস্তা ভর্তি করে চুন নিয়ে যাচ্ছি। যা যা তোর কাজে যা। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে। ঘেরে চুন দিতে হবে।’
যাক একটা ফাঁড়া তো কাটল।

ফাঁড়া যে কাটেনি পরদিন দুপুরে বুঝলাম। রাতে লাশ নিয়ে ফিরে সারারাত জেগে ফুটন্ত চুনের পানিতে লাশ সিদ্ধ করে মাংস ছাড়ানোর মত বিভৎস ব্যাপার স্যাপার। মাংসগুলো রাক্ষুসে আফ্রিকান মাগুরের মুখে ছেড়ে নিশ্চিহ্ন করা। পরিস্কার ধবধবে সাদা এক মানুষ ফ্রেশ হাড় গোড় নিয়ে বাড়িতে ফিরেছি। আমার সাধাসিধে মা উচ্ছংখল ছেলেদের ব্যাপারে নাক গলান না। কাজেই কংকালের বস্তা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাত জাগা ঘুম দিলাম।

পুলিশের ডাকে ঘুম ভাঙল। পুলিশের সাথে আব্বাও আছেন। আছে ইয়াছিন, বাবুল ও সন্ন্যাসীও। পুলিশ কি জন্য এসেছে মুহুতের্ই বুঝে গেলাম। চোখ মুখ ধুয়ে ভাল একটা শার্ট পরে ভদ্র হয়ে ড্রয়িংরুমে এলাম। আব্বা পুলিশের সাথে কথা বলছে। ইয়াছিন উঠে গেছে ডাব গাছে। ডাব পাড়তে। একজন কে যেন ছুটেছে বাজারে গরম গরম মিষ্টি আনতে। আব্বা নিজেও এখনও লাশের ব্যাপারটাতে ক্লিয়ার না। ইয়াছিন, বাবুলের কথা কিছুই বুঝেনি। শুধু এটুকু বুঝেছে ছোট ছেলেকে বাঁচাতে যা করার তাই করতে হবে। বড়টার মত ওটাকেও ফেরারী হতে দেয়া যাবে না।

পুলিশের সামনে ব্যাপারটা আমি খোলাসা করলাম। ডাক্তারী পড়তে মানুষের হাড়গোড় লাগে পুলিশও জানে। শুধু মাত্র পড়াশুনার জন্য যে আমি কবর খুঁড়ে লাশ তুলেছি শুনে পুলিশ আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আমি এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি যে ঢাকায় লাশ পাওয়া খুব দুষ্কর। যারা ডাক্তারী পড়ে তারা গ্রাম দেশ থেকে কবর খুঁড়ে লাশ তুলে নিয়ে যায়। আমার কথা ওরা বিশ্বাস করল। ইতিমধ্যে গরম গরম ছানার জিলাপী ও ডাবের পানি চলে এসেছে। আব্বার সাথে পুলিশ দুজনের কোন একটা চুক্তি হয়ে গেছে। সম্ভবত চুক্তি হয়ে গেছে সন্ন্যাসীর সাথেও। সন্ন্যাসী বারান্দায় উবু হয়ে বসে পুলিশের সাথে সাথে একখানা গরম জিলাপী গলাধঃকরণ করল। আর হে হে করে জানাল, ছোটকর্তা পড়ার জন্য আমার মরা বউয়ের লাশ তুলেছে জানলে কে আর ছোট কর্তার বিরুদ্ধে কথা বলতে আসে। ছোটকর্তা তার বউয়ের লাশ পড়ে বড় ডাক্তার হয়ে গ্রামের সেবা করুক সেটাই সবাই চায়।’

সন্ন্যাসীর এত হে হে করে চাটুকারিতার কারণ আছে। আব্বার তহবিলের নগদ কিছু ক্যাশ সন্ন্যাসীর পকেটে গেছে। সাথে আশ্বাসও। আবার একটা বাগদী মেয়ে বিয়ের সব খরচখরচা আব্বা দেবে। তাছাড়া কোন একটা ঘেরের কামলার কাজে টাজেও লাগিয়ে দেবে হয়তো। সন্ন্যাসী তো মহাখুশী। যে বউ বেঁচে থাকতে একটা পয়সা ঘরে আসেনি সেই বউ মরে যাওয়ায় এত টাকা-পয়সা, সুযোগ আসবে কে জানত! মরা বউ বড় পয়া!

Series Navigation<< উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। প্রথম পর্বউপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। তৃতীয় পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *