শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প।। প্রভাতফেরি ও হারমোনিয়াম।। ফখরুল হাসান

আমি আর আনিস তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছি, তখন প্যাচাল পটল আমাদের পেছন থেকে থাকলো। “কিরে পোলাপান কই যাস ? ” আমার কাছে প্যাচাল পটলের কথাবার্তা মোটেও ভালো লাগে না। তার নাম ফজলুর রহমান। সাইজে আমাদের থেকে বেশ ছোট। আর আমাদের সব কাজে বেজাল করাই তার কাজ। তাই আমরা সকল বন্ধু তাকে প্যাচাল পটল বলে ডাকি। তবুও খানিকটা বিরক্তির সুরে বললাম, “স্কুল মাঠে” প্যাচাল পটল জিগেস করলো ” স্কুল মাঠে কেন? তোরা না হাই স্কুলে পড়িস? তাছাড়া আজকে শুক্রবার না? ” আমরা বললাম “হ্যাঁ “। কিন্তু, আমরা সকল বন্ধু মিলে স্কুল মাঠে শহীদ মিনার বানাবো তাই যাচ্ছি ” প্যাচাল পটল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো “কী বানাচ্ছিস? ” আমরা দুইজন একসাথে বললাম ” শহীদ মিনার”। প্যাচাল পটল কিছুটা রেগে গিয়ে বললো। গ্রামে শহীদ মিনার বানাবে ? তোদের কত বড় সাহস। ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ? এসব কাজ তো মালাউনরা করে। তোরা না মুসলমান? মুসলমানের বাচ্চা হয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিবি? প্যাচাল পটলের কথা গুলো শুনে আমার মনমেজাজ চরম খারাপ হয়েছে। কারণ, হিন্দুদের হিন্দু না বলে মালাউন ডাকে সে। আর শহীদ মিনারে মুসলমান ফুল দিতে পারে না। এই কথাটি শুনে। তবুও চুপচাপ রইলাম। কারণ, তার সাথে কথা বলে এখন সময় নষ্ট করতে চাই না। আমাদের হাই স্কুলটি আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। তাই ইচ্ছা থাকলেও আমাদের গ্রামের হাইস্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা। কখনো প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই, গ্রামের সব ছাত্রছাত্রী মিলে এবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুল মাঠে শহীদ মিনার বানাবো। কিন্তু, স্কুলের শিক্ষকদের রাজি করানো ও শহীদ মিনার বানাতে তো বড়দের সহযোগীতা দরকার। শেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম। টুটন ভাইয়ের কাছে যাবো। তিনি ঢাকা শহরের বড় কলেজে পড়েন। আমাদের সবকথা শুনে টুটন ভাই দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। এবং খুব খুশি হলেন। তার পর, টুটন ভাই কীভাবে জানি স্কুল মাঠে শহীদ মিনার বানাতে ও প্রভাতফেরি করতে শিক্ষকদের রাজি করিয়ে ফেলেছেন। আজ আমাদের সবাইকে স্কুল মাঠে শহীদ মিনার বানাতে ডেকেছে। স্কুল মাঠে গিয়ে দেখি টুটন ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা যাবার সাথে সাথেই। টুটন ভাই বললো তাহলে সবাই মাটি কাটা শুরু করো। আমি, নাজিম, রায়হান , আনিস,স্বপন, সোহাগ, নয়ন, লিমন, জহিরুল সবাই মিলে মাটি কেটে। মাঠের এক কোনায় উঁচু করে একটা ভিটের মতন তৈরি করেছি। সবাই যেন মহা উৎসাহে যোগ দিয়েছে মাটি কাটায়। পাশে দাঁড়িয়ে স্বর্ণালী দেখছে আমাদের মাটি কাটা। এখন কাঠমিস্ত্রি দরকার। শহীদ মিনার বানাতে। কিন্তু আমাদের বন্ধু লিখন পড়াশোনার পাশাপাশি তার বাবার সাথে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। তাই কাঠমিস্ত্রি নিয়ে সমস্যা নেই। স্বর্ণালী , গেলো লিখনকে ডেকে আনতে। লিখন আসতেই শহীদ মিনার কিভাবে বানাতে হবে কাগজে এঁকে বুঝিয়ে দিলো টুটন ভাই। তার পর বললো কাজ শুরু করতে। তার আগেই আমরা গ্রাম থেকে বড় বড় বাঁশ কেটে এনেছি। লিখন করাত দিয়ে বাঁশ গুলো কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কাঠপেন্সিল আর ইঞ্চিটেপ দিয়ে মেপে মেপে বাঁশগুলো কেটে নিলো। লিখনকে শহীদ মিনার বানাতে দাঁড়িয়ে থেকে সহযোগীতা করলো ভাই টুটন। বিকালের মাঝে শহীদ মিনারটা দাঁড়িয়ে গেল। সবার মাঝে আনন্দের জোয়ার। শহীদ মিনার অনেকটা মইয়ের মতন, শুধু মইয়ের কাঠিগুলো আড়াআড়ি না হয়ে লম্বা লম্বি। মাঝখানে দুইটা, তার দুই পাশে একটু ছোট আরো দুইটা । টুটন ভাইকে জিগ্যেস করলাম “এইটাই শহীদ মিনার? ” টুটন ভাই বললো ” এইটা আমাদের শহীদ মিনার। একেক জায়গায় একেক রকম শহীদ মিনার হয়। পিলারগুলো একটু চিকন হয়েছে, কারণ আমরা বাঁশ দিয়ে করেছি। মোটা হলে আরেকটু ভালো হতো। ” ভাইয়া শহীদ মিনার তো শেষ ” এখন কী করবো? ” টুটন ভাই আমাকে বললো হোসেনপুর বাজারে গিয়ে রং কিনে আনতে আর লালসালু কাপড়। “রং আর লালসালু কেন ভাইয়া? ” বোকা ” বাঁশগুলো সাদা রং করতে হবে। পেছনে একটা লাল সূর্য দরকার। তাই রং আর লালসালু লাগবে। শহীদ মিনার এর সবকাজ শেষ। টুটন ভাই আমাদের সবাইকে নিয়ে বসলো আলোচনায়। তিনি বললো ” একুশে ফেব্রুয়ারির দিন সবাই, খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে ফুল দেব। ” একুশে ফেব্রুয়ারি যতই এগোতে লাগলো আমাদের উত্তেজনা ততই বাড়তে লাগলো। কারণ, যাদের গানের গলা আছে তাদেরকে সবাইকে টুটন ভাই প্রভাতফেরির গান শেখাতে লাগলো। আমাদের পুরানো খাতায় কালো কালিতে একুশে ফেব্রুয়ারির উপর পোস্টার লেখা হলো। আমরা সেগুলো সারা গ্রামে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে। প্রভাতফেরির গানকে ধরবে? বা হারমোনিয়াম কে বাজাবে? আমাদের মাঝে একমাত্র স্বর্ণালীই পারে হারমোনিয়াম বাজাতে। কিন্তু, একেবারে অন্ধকার থাকতে প্রভাতফেরি শুরু হবে। তাই সে আসতে পারবে না। কারণ, স্বর্ণালীর পরিবার হিন্দু। প্যাচাল পটলের বাবার ভয়ে স্বর্ণালীর বাবা মা তাকে দিতে রাজি হবে না। প্যাচাল পটলের বাবা নাকি ৭১ সালে খুব খারাপ মানুষ ছিলো। যদিও এখন গ্রামের সবাই উনাকে সম্মান করে।
৭১ এর পর অনেক টাকার মালিক হয়ে। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যানও হয়েছে। স্বর্ণালীর বাবা মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিলেন টুটন ভাই। আমাদের সবাইকে নিয়ে স্বর্ণালীদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা বুঝিয়ে বললে তিনি রাজি হয়ে যান। আজ ২০ শে ফেব্রুয়ারি বিকালে আবার সবাইকে ডেকেছে টুটন ভাই,
স্কুল মাঠে। প্রভাতফেরির গান শিখাতে। আমরা সবাই গোল করে বসে পড়লাম। স্বর্ণালীর সবার মাঝে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে শুরু করলো, ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি! ‘ এবার আমরা সবাই স্বর্ণালীর সাথে যোগ দিলাম। যদিও আমাদের গলায় সুর নাই, কিন্তু তাতে সমস্যা কী? সন্ধ্যায় পর্যন্ত চললো গান শেখা।
এবার আমাদের চিন্তার বিষয় ফুল। আনিস আমাকে জিগ্যেস করলো, “ফুল পাবি কই?” আমাদের ধুলজুরী গ্রামে কেউ ফুল গাছ লাগায় না। বনে জঙ্গলে, রাস্তাঘাটে কিছু জংলি ফুল আছে। তবে দেব নাথ বাড়িতে কিছু ফুলগাছ আছে। পূঁজার কাজে লাগে। তাই তারা ফুলগাছ লাগিয়েছে। আনিসকে আমি বললাম, রাতের অন্ধকারে তাপস দেব নাথদের বাড়ি থেকে। আমি ফুল চুরি করবো। মহৎ কাজের জন্য এই রকম ছোটকাটো চুরিচামারিতে দোষ হয় না। কথা মতো আমি আবছা অন্ধক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *