তিন রঙের তিনটি পাথর-পর্ব চার।। সোনালি পাথরের হারিয়ে যাওয়া।। মালেক মাহমুদ
সোনালি পাথরের কথা ভুলেই গেছে কাশেম।
কাক যে তিনটি পাথর দিয়েছিল তার একটির রঙ ছিল সোনালি।
একটির রঙ ছিল লাল।
আর সেই লাল পাথরের কারণে লাল হাঁস।
একটি রঙ ছিল নীল। আর সেই নীল পাথরের কারণে নীলমাছ।
নীলমাছের আদলে কাশেম তৈরি করেছে নীলঘুড়ি। নীলঘুড়ি কাশেমের আনন্দ আয়োজন। প্রতিটি কর্ম কাশেমকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়। নীলঘুড়ি নীল গগনে উড়ে। নীলঘুড়ি উড়িয়ে বেশ আনন্দ অনুভব করে কাশেম। লাটাই হাতে নিয়ে বসে থাকে। ঘুড়ি উড়তে থাকে। নীল নীলিমায় মিশে যেতে চায় ঘুড়ি। উড়ন্ত ঘুড়ির মত কাশেমের মন। লাল হাঁস তৈ তৈ করে ঘুরে বেড়ায় পুকুর জলে। হাঁস আর ঘুড়ি। এই দুটি বিষয় নিয়ে কাশেমের সময় চলে যায়।
আনন্দের সময় ছুটে চলে তাড়াতাড়ি। দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। সময় চলে যেতে লাগল। সময় কারো দিকে তাকিয়ে থাকে না। সময় চলমান। বাড়ির পাশেই একটি আম গাছ বেড়ে উঠতে থাকে। অযত্নে অবহেলায়। সেই দিকে কারও খেয়াল নেই। দেখতে দেখতে তিনটি বছর চলে গেল। সময় থামে না। তিন বছর পর আম গাছে এলো আমের মুকুল। এত এত আমের মুকুলের ভেতর থেকে কুড়ি এলো অল্প। এই অল্প কুড়ি থেকে আম টিকে থাকলো মাত্র সাতটি। সাতটি আম থেকে কাচাকালেই ঝরে গেল চারটি কড়া আম। তিনটি আম নিয়ে গাছ দাঁড়িয়ে রইলো। তিন বছরের আম গাছে ফল এসেছে তিনটি। আমের রঙ হয়েছে সোনালি। কাচা আম কাচা সোনালি। আম যেই আম পাক ধরেছে তখনই পুরো সোনালি রূপ ধারণ করে আম। আম তিনটি বেশ বড় বড়। দেখে মন জুড়িয়ে যায়। আমের সুন্দর্য্য কাশেমকে পাগল করে তোলে। কাশেম ভাবে, এত সুন্দর আম কতইনা মিষ্টি হবে।
কাশেমের বাবা কাশেমকে বলে, আগামীকাল তুই ঐ নতুন গাছের আম পেড়ে নিয়ে আসবি।
জি, বাবা। এই গাছের আম বেশ মিষ্টি হবে।
তা, তুই কীকরে বুঝলি?
এ রঙের আম তো এর অাগে দেখিনি।
আমিও দেখিনি।
পরদিন, বাবার কথা মতো তিনটি আম পেড়ে নিয়ে আসে কাশেম। মুগ্ধ করা আমের ঘ্রাণ। এই আমের ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়েছে সারাবাড়ি। আম খাওয়ার আয়োজনে তিনজন ছাড়া কেউ নেই। খুব আনন্দ সহকারে আম খেলো। সারাবাড়ি যেন আনন্দের বিজয় নিশান উড়ছে। সুখ মানুষকে দুঃখের দিনের কথা ভুলিয়ে রাখে।
কাক কা কা করে উড়ে গেল।
আম খেয়েই কাশেম চলে যায় ঘুড়ির কাছে। বাড়ির সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। জিহ্বায় লেগে থাকে আমের স্বাদ।
কাশেমের কাণ্ড দেখে মোটেও খুশি হলো না কাক। তাই আম গাছের ডালে বাসা করে কুচকুচে কালো কাক। পরের মাসে আম গাছে আবার মুকুল এলো। সাতদিন পরে আমের মুকুল ঝরেই দেখা যেতে লাগলো ঝুপা ঝুপা কড়া আম। সোনা রঙে রঙিন হয় গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কাশেম। এত তাড়াতাড়ি কীকরে আম এলো। এত মজাদার আম। এতো তাড়াতাড়ি ফলন দেখে কাশেমের বাবাও চমকে ওঠে।
গ্রামের মানুষও অবাক হলো। সবাই বলাবলি করতে লাগলো এরকম আম আর আমরা এর আগে দেখিনি। গ্রামের মানুষের আনাগোনায় কাশেমের বাবা অতিষ্ঠ হয়ে গেল। সে মনে করতে লাগলো, এ গাছের আম এত মিষ্টি যদি গ্রামের মানুষ জানতে পারে তবে আর রক্ষে নেই। আমের রঙ সোনালি হওয়া যেভাবে গ্রামের মানুষ বিচলিত হয়ে দেখতে আসছে। কাচা আম পাকা করাই হবে দ্বায়। তাই আম গাছ পাহারা দেয়ার জন্য কাশেমের উপর দায়িত্ব দেয়া হলো।
কাশেম একটি লোক নিয়োগ করলো। লোকটি গাছের পাশে একটি টুল পেতে বসে থাকতো। দুদিন পরে লোকটি চোখে পড়লো একটি কাকের বাসা। কাক একটি পাকা আম ঠুকরিয়ে খেয়ে ফেলেছে। অর্ধেক খাওয়া আমটি হাতে নিয়ে কাশেমের কাছে যায়। কাশেম আমটি হাতে নিয়ে তেড়ে আসে। গাছের কাছে এসে দেখে কাকের বাসা। এই কাকই করেছে এই কাজ। এই কাক যদি এই গাছে বাসা করে থাকে তবে আমার আম আর আম থাকবে না। তাই পাহাদারকে হুকুম দেয় কাকের বাসাটি ভেঙে দিতে। যে হুকুম সেই কাজ। পাহাদার ভেঙে গুড়িয়ে দেয় কাকের বাসা। কাক ভাবতে থাকে, সোনালি পাথরের বদৌলতে এই গাছটি। এই কথা কাশেমের মোটেও মনে পড়ছে না। লাল পাথরের হাঁস কী সুন্দর আগলে রেখেছে। নীল পাথরের নীলমাছও কী সুন্দর আগলে রেখেছে।
সোনালি পাথরের কথা ভুলেই গিয়েছে। কীকরে মনে রাখবে কালো কাকের কথা! যার সম্পদের পাহাড় গড়ার নেশায় ধরে, সে ভুলে যায়। মনো করতে পারে না দুখের দিনগুলি। সামনে এসে দাঁড়ায় না মানবতা নামক শব্দ। কাক উড়ে দূরে সরে যায়। রাতের ঝড়ে সব আম পড়ে যায় মাটিতে। কাশেম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আমের দিকে তারপর ঘরে যায়, দেখে তার সেই সোনালি রঙের পাথরটি নেই।