শিশুতোষগল্প।।বন্ধু।। জহির টিয়া
অসীম, আবিদ, তালহা তিন বন্ধু। প্রতিদিন সাইকেলে চড়ে ইশকুলে যাওয়া-আসা করে। তারা খুব ভালো বন্ধু। এবার তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। হুমায়ুন রেজা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তারা রানীনগর চৌকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে এবার পিএসসি পাশ করেছে। অসীম ও তালহার বাড়ি একই গ্রামে। আর আবিদের বাড়ি ওদের পাশের গ্রামে। কিন্তু একই রাস্তা দিয়ে তাদেরকে ইশকুলে যাতায়াত করতে হয়। অসীম ও তালহাকে, আবিদদের গ্রামের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। আবিদ, ইশকুল যাবার সময় হলে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে। যখন বন্ধুরা আসে তখনই একসাথে টুংটাং টুংটাং করে সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে ইশকুলে যায়।
কখনো তিনজনে পিঁপড়ের মতো লম্বা সারি বেঁধে, কখনোবা পুরো রাস্তা ঘিরে সাইকেল চালায় ওরা। রাস্তাতেও জনসমাগম খুব একটা বেশি নয়। অটো, অটোরিকশা, সিএনজি এইগুলোই বেশি যাতায়াত করে। মাঝেমধ্যে দুই-একটা ট্রাক বা ট্রলি যায়। ফাঁকা রাস্তাতে বেশ খোশমেজাজে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারে তারা।
হঠাৎ একদিন স্কুল হতে ফেরার পথে সিএনজির ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো আবিদ। পাশ কেটে চলে যাওয়ায় কোনোরকমে আঘাত হতে বেঁচে গেল অসীম ও তালহা। বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল আবিদের। ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশে জোরেশোরে আঘাতে ভেঙে গেল। আবিদের প্রচণ্ড চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেল। আর বন্ধুর জন্য অসীম ও তালহার আহাজারিতে কেঁপে ওঠলো আশপাশ। কেঁপে ওঠলো রাস্তার দু’ধারের গাছপালা। কিচিরমিচির করতে লাগল গাছের পাখিরা। স্তব্ধ হয়ে গেল খাঁখাঁ দুপুর।
দ্রুত রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো আবিদকে। সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসার জন্য তাগাদা দেওয়া হলো ডাক্তারকে। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেও পা-টা বাঁচাতে পারলেন ডাক্তারেরা। শেষ পর্যন্ত পা-টা কেটে ফেলতে হলো। সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গেল আবিদ।
এখন আবিদকে স্টিলের ক্যাচার ওপর দুই বগল রেখে, ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। ইচ্ছে করলেও আর আগের মতো দূরন্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে পারবে না। রোজ বিকেলে একসাথে খেলত আবিদেরা তিন বন্ধু গ্রামের অন্যদের সাথে। এখন আবিদ খেলা মাঠে যায় না। কিন্তু ইশকুলে যেতে কোনো সমস্যা হয় না। কারণ, এখন প্রতিদিন অসীম বা তালহার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। তারাও নিয়মিত আবিদকে সাইকেলে চড়িয়ে ইশকুলে নিয়ে যায়। এমন কী কোনো জায়গায় ঘুরতে গেলও সাথে নিয়ে যায়। তিল পরিমাণও তাদের মাঝে বন্ধুত্বের ছেদ কাটেনি। এলাকার লোকজন থেকে শুরু করে ইশকুলের শিক্ষকেরাও তাদের প্রসংশা করে।
এভাবেই যাচ্ছে আবিদের দিনকাল। পা হারানোর পর হতে গ্রামের ফুটবল মাঠে একদিনও যায় নি। যেহেতু সে খেলাধুলা করতে পারবে না। তাই মাঠে যায় না। এই সময়টা সে বাড়িতে বসে বসে সৃজনশীল কিছু করার চেষ্টা করে। কখনো ছবি আঁকে। কখনো মনের মধ্যে যা আসে তা দিয়ে ছন্দ বানানোর চেষ্টা করে। ছন্দ হতে ছড়াও সৃষ্টি হয়ে যায়।
একদিন বিকেলবেলা বন্ধুদের খুব মিস করছিল আবিদ। এই সময় কতই না বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে আনন্দ-ফূর্তি করেছে। কিন্তু গত আটমাস যাবৎ কোনো খেলাধুলা তো দূরের কথা মাঠেও যাওয়া হয়নি। পুরনো স্মৃতিগুলো ভেতরে নাড়া দিতেই ধীরেধীরে পৌঁছে গেল খেলার মাঠে। গিয়ে দেখে, অসীম, তালহাসহ আরো অনেকেই ফুটবল খেলছে। মাঠের এককোনায় গিয়ে দাঁড়ালো আবিদ। আবিদের দিকে প্রথমে চোখ পড়লো তালহার। দেখেই সে বলে ওঠলো, দেখ, দেখ আবিদ এসেছে। তালহার মুখে আবিদের কথা শুনে ছুটে গেল সবাই। আবিদকে ঘিরে ধরলো। অনেকদিন পর, আবিদকে খেলার মাঠে পেয়ে আনন্দ মুখরিত হয়ে ওঠলো খেলার মাঠ। অসীম বললো, চল আবিদ। মাঠের ভেতরে। আবিদ মনটা ভার করে বলল, বন্ধু তোরা খেলা কর। আমি এখানে বসেই তোদের খেলা দেখি। আমি তো খেলতে পারবো না। আবিদের মুখে কষ্টের ছাপ দেখতে পেল বন্ধুরা। তালহা ভাবতে লাগল, কীভাবে আবিদকে নিয়ে খেলা যায়! ভাবতে ভাবতে পেয়েও গেল। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে তালহা বলল, তোরা শুন, আবিদকে নিয়েও আমরা খেলতে পারি। কিন্তু আমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। সবাই বলে ওঠলো, কীভাবে বল, বল? তালহা বলল, এক পা দড়ি বা অন্যকিছু দিয়ে হাঁটুর ওপর ভাঁজ করে পেছনে বেঁধে রাখবো আমরা। আর আবিদের মতো করে দুই হাতে লাঠি নিয়ে আবিদের মতো হয়ে একসাথে খেলতে পারি। তালহার কথায় সবাই সমর্থন জানালো। যেই ভাবনা সেই কাজ। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ খেললো আবিদকে নিয়ে তার বন্ধুরা।
খেলা শেষের পর, তালহা বললো, আজ আমরা খেলাটা অনেক ইনজয় করলাম। অনেক দিন পর আবিদকে মাঠে পেয়ে। আরেকটা কথা, আগামীকালকে আমার জন্মদিন। তোরা সকলেই বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসবি।
তালহার নিমন্ত্রণ সকলে গ্রহণ করে নিজ নিজ বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
পরদিন বিকেলে সবাই তালহাদের বাড়িতে হাজির। জন্মদিনের কেক কাটলো তালহা। সবাই সবার মুখে কেক তুলে খাওয়ালো। অনেক আনন্দ-ফূর্তি করলো ওরা। এরপর যে যা গিফট নিয়ে এসেছে, তালহার হাতে তুলে দিচ্ছে। আর তালহা প্রতিটি প্যাকেট খুলে খুলে দেখছে। আর সকলে হৈ-হুল্লোর করছে। সবার শেষে আবিদ এ-ফোর আকারের একটা লাল টুকটুকে খাম তুলে দিলো তালহার হাতে। সবার মনের মাঝে প্রশ্ন, আবিদ আবার খামের ভেতরে কী নিয়ে এসেছে? খামের এক মাথা কাঁচি দিয়ে কেটে যা বের করলো তালহা, তাতে তার চক্ষু আনন্দে ছলছল করে ওঠলো।
আবিদের নিজ হাতে আঁকা একটা ছবি। সাদা আর্টপেপারের ওপর কালো কোট আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা তালহার ছবি। পিএসসি পরীক্ষার সময় এই ধরণের একটা ছবি তুলেছিল তালহা। সেই ছবিটার একটা কপি আবিদের কাছে ছিল। তা দেখেই হুবহুব ছবিটা এঁকেছে অতি যত্নে। ছবির নিচে লেখা জন্মদিনের একটা ছোট্ট ছড়া।
“জন্মদিনে দিলাম তোরে
নানান ফুলের গন্ধ,
হাজার বছর বেঁচে থাকিস
জীবন পাক ছন্দ।”
তালহাকে সবাই জড়িয়ে ধরলো। কারো কারো চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি। তালহা চোখ মুছতে মুছতে বললো, আঁকা-লেখা কবে শিখলি? আবিদও চোখ মুছতে মুছতে বললো, কী করবো বল? খেলাধুলা তো আর করতে পারি না। তাই সেই সময়টা কাজ লাগাই এভাবে। তোরা যেমন আমার জন্য অনেক কিছু করছিস, আমি কি তোদের জন্য এইটুকু করতে পারবো না?