ঈদ সংখ্যা ২০২১-এর গল্প-করোনাকালে মায়ের সারপ্রাইজ- রণজিৎ সরকার
করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল গেটে ঝুলল তালা। বন্ধ হয়ে গেল অনাবিল মুক্তি আর আনন্দের প্রাঙ্গণটি। রইল না শিক্ষার্থীদের কোলাহল। হারিয়ে গেল বন্ধুরা। হারিয়ে গেল টিফিন ভাগ করে খাওয়া, কেড়ে খাওয়ার মজার সব আনন্দ। চারদিকে লকডাউন। সবার মতো ঘরবন্দি হয়ে গেল কনক ও তার বোন কাকলী। কনক পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। আর কাকলী পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। করোনার কবল থেকে কবে মুক্তি মিলবে ওরা জানে না। ওদের মা পেশায় একজন ডাক্তার। এই দুঃসময়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছেন।
কনক আর কাকলীকে বাসায় রেখে হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন ওদের মা। যারা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছেন তারা ডিউটির দিনগুলোয় টানা সাত দিন বাসায় যেতে পারবেন না। এরপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় টানা ১৪ দিন। হাসপাতালে চিকিৎসক কম থাকায় কাউকে কাউকে আবার একটানা এক মাসেরও বেশি সময় দায়িত্বপালন করতে হয়। আপন মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। কিন্তু মন থেকে দূরে থাকা যায়, যায় না। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মুঠোফোন। কনক আর কাকলী তাদের মায়ের সাথে মোবাইল ফোনে প্রতিদিন কথা বলে। তাতে কি আর মা ও সন্তানদের মন ভরে, ভরে না। সারাদিন বাসায় থাকে, মাকে খুব মিস করে ওরা। ভাইবোন দিনে যতবার মায়ের সাথে কথা বলে, তখন আশা দিয়ে মা বলেন, এই তো চলে আসব। কোনো চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। তোমরা নিয়মিত পড়ালেখা করো, ছবি আঁকো, কার্টুন দেখ, গেমস খেলো, বইমেলা থেকে গল্প-উপন্যাসের বইগুলো কিনেছ, সেগুলো পড়ে ফেল আর প্রতিদিন বাংলা, ইংরেজি ডিকশনারি থেকে দশটা করে শব্দ মুখস্থ করো। খারাপ লাগলে রাবেয়া বুয়ার সাথে বেশি বেশি গল্প করবে। তোমাদের টুলু, ভুলুকে নিয়ে ভালো সময় কাটাবে…।
টুলুম ভুলু হলো বাসার পোষা কুকুর। কনক আর কাকলীর বাবা সরকারি চাকরিজীবী। সরকারের বড় কর্মকর্তা। তিনি কারোনাকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করছেন। তিনিও কনক ও কাকলীকে সময় দিতে পারেন না। তাই বাসায় সব সময় কাজের রাবেয়ার সাথেই ওরা গল্প করে। রাবেয়া তাদের দেখাশোনা করেন। ওরা দুজন টিভি দেখে, বিশেষ করে টুলুম ভুলুর সাথে দুষ্টুমি বেশি করে।
কনক আর কাকলী বুঝতে পারে। মা মানবসেবা করছেন। ওদের বাবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস করছেন।
বাবা ওদের নিয়ে বসে গল্প করছেন, এমন সময় কনক বলল, ‘আচ্ছা বাবা, তুমিও চাকরি করো। মাও চাকরি করে। তুমি প্রতিদিন বাসায় আসত পার। মা প্রতিদিন না এসে এতদিন পরপর বাসায় আসে কেন?’
বাবা বললেন, ‘তোমাদের মা যে করোনা ভাইরাসের সম্মুখযোদ্ধা। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। তাই ঝুঁকি বেশি। হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন বাসায় আসা মহাবিপদ। করোনা ভাইরাস তো ছোঁয়াচে রোগ। তোমাদের মা যদি কোনো কারণে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত অবস্থায় যদি বাসায় আসে, তাহলে আমরাও আক্রান্ত হয়ে যাব। তাই পরিবারকে রক্ষা করার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাক্তাররা সেবা দেবে কিন্তু সহজে বাসায় যেতে পারবে না। ডাক্তারদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা করেছে। নিজে বাঁচতে হবে। অন্যকেও বাঁচাতে হবে। পরিবারের সবাইকে নিরাপদ রাখতে হবে। তাই তোমাদের মা এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পারে না।’
কনক মাথা নেড়ে বলল, ‘এবার বুঝলাম। তাহলে তো আমাদের মায়ের মতো অনেক মা আছেন হাসপাতালে।’
বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ। শুধু মা নয়, বাবারাও আছেন!’
কাকলী বলল, ‘আচ্ছা বাবা, এই কারোনাকালে এসে আমার মনে হচ্ছে ডাক্তারি পেশা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা?’
বাবা বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ মামণি। ঝুঁকির মধ্য দিয়ে ডাক্তাররা মানবসেবা করছেন। এই মুহূর্তে ডাক্তার ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
কনক বলল, ‘বাবা ডাক্তারদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কি সঠিকভাবে পাচ্ছে?’
বাবা বললেন, ‘এ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে তারা দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে? প্রয়োজনেই তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এদের মনোবল চাঙা রাখতে যা যা করা দরকার তা করতে হবে। বাড়িয়ে দিতে হবে সহযোগিতার হাত। ডাক্তাররা সুস্থ থাকলে সেবা দিতে পারবে। সারাবিশে^ প্রচ- চাপের মধ্যে আছেন চিকিৎসকরা। আমাদের দেশে তো এমনিতেই চিকিৎসকের অভাব।’
কাকলী বলল, ‘তাহলে তো অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। মায়ের মতো আমিও ডাক্তার হব। দেশের ডাক্তারের অভাব পূরণ করব। দেশের সেবা করব।’
বাবা বললেন, ‘ভালো করে পড়ালেখা করো। অবশ্যই তুমি ডাক্তার হবে।’
কাকলী বলল, ‘স্কুলছুটি তাতে কি আমি কিন্তু নিয়মিত পড়ালেখা করছি।’
বাবা কাকলীকে ধন্যবাদ দিলেন।
কনক বলল, ‘বাবা, আমার মনে হয় এই সময় বিশেষভাবে ডাক্তারদের উপযুক্ত মর্যাদা না দিলে ভবিষ্যতে মেধাবী ছাত্রছাত্রী এ পেশায় আর আসবে না।’
বাবা বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ।’
কাকলী বলল, ‘বাবা এই কারোনাকালে কি শুধু ডাক্তাররা বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করছেন?’
বাবা বললেন, ‘না, হাসপাতালে ডাক্তাররা আর বাইরে সামাল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাঠে আছেন ব্যাংককর্মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরাও সংবাদ সংগ্রহ করছেন।’
কাকলী বলল, ‘বাবা, নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধরত সম্মুখসারির এই যোদ্ধাদের ত্যাগের কথা জাতি কি মনে রাখবে?’
বাবা বললেন, ‘অবশ্যই মনে রাখবে। রাত অনেক হলো এখন তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো।’
বাবার কথামতো কনক আর কাকলী ঘুমাতে গেল।
পরদিন সোফায় বসে কাকলী টুলু, ভুলুর সাথে দুষ্টুমি করছে। কনকও সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছে। রাবেয়ার মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলল রাবেয়া।
বাসায় ঢুকে পেছন দিক দিয়ে চুপি চুপি সন্তানদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মা কল্পনা। একেবারে কনক আর কাকলীর পেছনে এসে তাদের চমকে দেন মা। মাকে দেখেই ভাইবোন আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। কাকলী তো যেন কয়েক মুহূর্ত বিশ্বাসই করতে পারেনি, মা ঘরে ফিরে এসেছেন। মা এসে এভাবে সারপ্রাইজ দেবেন। সন্তানকে জড়িয়ে ধরে মা আনন্দে কেঁদে ফেলেন। মাও সন্তানদের কাছে পেয়ে যেন আর ছাড়তে চাইছেন না। এতদিন পর মাকে দেখতে পাওয়ার সেই আনন্দের মুহূর্ত ভিডিও করছেন রাবেয়া। ওদের বাবা বাসায় এলেন। তখন ভিডিওটা দেখালেন। তখনই ওদের বাবা ভাবলেন, এমন আনন্দের মুহূর্ত মানুষকে দেখানো উচিত। তাই তিনি ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক লাখ ভিউ হয়ে গেল চিকিৎসক মায়ের দেওয়া সারপ্রাইজের মুহূর্ত।