শিশুতোষ গল্প।। প্রভাতফেরি।।অরণ্য প্রভা
আজ বৃহস্পতিবার। স্কুল বন্ধ। বন্ধের সঠিক কারণ জানা নেই। স্কুল বন্ধের কথা শুনে আনন্দের সীমা থাকে না মধুর। তখনই শুনতে পায়- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।’
স্লোগানে মুখরিত সেই মিছিল বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে যায়। পিছু পিছু মধুও ছোটে। মিছিলটা যখন বাঁক নিয়ে বন্দরের দিকে চলে যায়, তখন আর ও-পথে পা বাড়ায় না মধু। স্লোগানের কোনো অর্থই বোঝে না সে। ফিরে এসে টুলের ওপর ঝুপ করে বসেপড়ে। মাকে প্রশ্ন করে, ‘মা’রে, ওরা হগলে মিল্যা চিল্লায়া চিল্লায়া কী কয়?’
‘অরা চিল্লায় নাই, মিছিল হরছে।’
‘মিছিল কারে কয়?’
‘দাবি আদায় অরতি মিছিল করতি হয়।’
‘তাইলে বাংলা ভাষার জন্যি মিছিল হরছে ক্যান? আমরা তো বাংলাতেই কথা কই।’
‘হ, বাংলাতে কথা কইলেও তা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার হরে না। আমাগো রাষ্ট্রভাষা কিন্তু উর্দু। আর এই বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করতে যাইয়াই ঢাহায় অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ ম্যালা ছাত্রনেতা আডক অয়।’
আটকের কথা শুনে মধু এবার দ্বিধায় পড়ে যায়।
‘মা রে, তাইলে তোমারে আর মা কইয়া ডাকতে হারবো না? বাবারে আর কহনো বাবা কইয়্যা ডাহা যাইবে না!’
মধুর এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই মায়ের। পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট চলছে। চরম আশঙ্কা আর অস্থিরতার মধ্যে দিনশেষে খবর আসে ঢাকায় পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গুলিতে জব্বার, রফিক, বরকত ও শফিকের মৃত্যু, আর সালামকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
এমন কথা মধুকে সংশয়ী করে তোলে। মা অনুরোধ মেশানো কণ্ঠে বলেন, ‘মধু বাইরে যাইস নারে বাবা, ঢাহায় পুলিশ গুল্লি কইরা মানুষ মারার লাগছে। মিছিলের পিছনে যাইস না। যদি এইহানেও গুল্লি হরে?’
আবার মিছিল আসে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ভাই শহিদের খুনীদের বিচার চাই, বিচার চাই; হত্যাকারীর বিচার চাই।’ এবার স্লোগানে মুক্তির বদলে যোগ হয় হত্যাকারী।
এ ঘটনার দু’তিন দিন পরই অম্বিকা ময়দানের পূর্বপাশে যেনতেন ভাবে ভাষাসৈনিক আবদুস শুকুরের পরিকল্পনায় একটা শহিদ মিনার বানানো হয়। এটাই এখানকার প্রথম শহিদ মিনার।
সেদিন গুলিবিদ্ধ সবার মৃত্যু হলেও সালাম চৌদ্দদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মারা গেলেন। ওরা জীবন দিয়ে গেলেন, তাই ওরা শহিদ। জীবনের বিনিময়ে বাংলাভাষাকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করার পথ দেখিয়ে গেলেন। সে কারণেই হয়তো আমরা বাংলা বলতে পারছি।
মায়ের এমন ভারি ভারি কথাগুলো মধুকে প্রশ্ন করতে শেখায়। সে কারণেই মধু কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে মাকে বলে, ‘শহিদ কারে কয়?’
‘শহিদ মানে হইলোগা মহুত কোনো কামের জইন্যে জীবন উৎসগগো করা। মানে অইছে, জীবনের বদলে কিছু এ্যাডা পাওয়া। ভাষার জন্যেই ওগো জীবন দিতে অইছে। হেই অতথে অরা শহিদ। হেই জন্যেই মিছিলে কইছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ভাই শহিদের খুনীদের বিচার, বিচার চাই, হত্যাকারীর বিচার চাই।
মধু মনে মনে ভাবে তাইলে আমিও কি সোলোগান দিব আমার গুলতির জইন্যে?
বাবা আসামাত্র হাত উপরে তুলে মধু চিৎকার করে লাফাতে লাফাতে বলতে থাকে, ‘রাটটো ভাষা বান্লা চাই, আজবন্দিদের মুক্টি চাই।’
বাবা কাঁধের ভারটা নামিয়ে রেখে বলেন, ‘এইগুলান তোরে কিডা হিগাইছে?’
‘ক্যান, কত্ত অইরা কইলাম তুমি আর গুলতিডা নিয়ে আইলা না। হ্যার লাইগাই তো মিছিল হরবারলাকসি! মা কইছে, মিছিল হইরাই নাকি দাবি আদায় হরতি অয়। বাবা, তুমি আমারে মিছিলে নিয়্যা যাবা?’
‘আইচ্ছা নিয়ে যাইবানে।’
এরপর অনেক একুশ এসেছে, কিন্তু মধুর কখনই মিছিলে যাওয়া হয়নি।
২.
ছুটিতে মামাবাড়ি এসে লেখাপড়া তো কিচ্ছু হয় না, শুধু শুধু মনকে বুঝ দেয়ার জন্যই দু-একটা বই সাথে নিয়ে আসা। এর মধ্যে অবশ্য একটা কৌশলও কাজ করে। পড়ার কথা বলে বলে মামার কাছ থেকে সব বায়না মিটিয়ে নেয়া। আজ নতুন একটা বায়না মেটানোর জন্য মামার অনুরোধে ছড়াটি পড়তে থাকে মধু
“আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও-
রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা, ভেন্নাপাতার ছানি
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।…”
এতটুকু পড়তেই অদূরে কোনো গাছে ঘুঘু পাখির ঘু-ঘু ডাক মধুকে মনোযোগী করে তোলে। ছড়াটির চিত্রকল্প ছাপিয়ে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে গুলতি, বারান্দার থাম্বার সাথে ঝুলিয়ে রাখা বাটুল রাখার খুতি। ব্যস, অমনি বই বন্ধ করে। দুদিন আগে লালমাটির কাদায় মারবেলের মতো ছোট ছোট গোলা করে বাটুলগুলো শুকিয়েছে। সিথানের কাছ থেকে গুলতিটা নিয়ে থাম্বার কাছে যেতে আবারো ডাকে ঘু-ঘু, ঘু-ঘু।
মেঘভাঙা ফাগুনের আগুনঝরা রোদে মধুর মুখখানি চিকচিক করে ওঠে। আর মনের খুশিতে চুপি চুপি অভিজ্ঞ শিকারির মতো ঘুঘুর ডাক অনুসরণ করে কড়ই গাছের নিচে হাজির হয়।
একটামাত্র বাটুলের বিনিময়েই ঘুঘু পাখিটা মধুর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। ঘুঘু পাখিটার ধরফড়ানিতে কোনো মায়াই হয় না। শুধু ঘুঘু পাখি কেন এরকম অনেক পাখিই শিকার করে এনেছে। পাখি শিকারই নয়, মাছ ধরাতেও সে কম পারদর্শী নয়। এই তো কদিন আগেই মধুমতি থেকে ইয়া বড় একটা শোল মাছ ধরে এনেছিল। সেদিন মধুর মামাবাড়িতে বেশ ভিড় জমেছিল।
ঘুঘু পাখিটা নিয়ে বীরদর্পে মা মা বলে চিৎকার করতে করতে মায়ের কাছে এসে হাফিয়ে পড়ে। মা তখন উঠোনে বসে শাক বাছছেন। মধুর এ আনন্দে সায় দেয়ার কথা থাকলেও কোনো কথা বললেন না।
‘মা, ঘডনাডা কি, তুমি খুশি অও নাই?’
মা আবারো চুপ করে থাকেন। মধু মায়ের আরো কাছে আসে।
মধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘হ, বহুত খুশি হইছি।’
‘তাইলে তোমার চোহে পানি ক্যান, কি অইছে আমারে কও?’
‘না বাজান তুই হুইনা আর কি অরবি?’
‘না, তুমি কও।’
মা জানে মধু নাছোড় বান্দা। এই কান্নার হেতু না শোনা পর্যন্ত কোনো কাজই করতে দেবে না তাকে। তাই বলেন, ‘চাইরদিকে পুলিশ ঘোরাফিরা করবার লাগছে, কহন যে কারে ধইরা নিয়্যা যায়…! তোর মামা অ্যহনো বন্দর থিইকা আহে নাই।’
‘ও… তাই ভাববার লাগছো, খামোকা চিন্তা কইরো না, মামা এহনি চইল্যা আসবেনে।’
ছুটি শেষে এবার মধুর ফেরার পালা। মামাবাড়ি ছেড়ে যেতে হবে আবার রসুলপুরে। হ্যাঁ, সেই রসুলপুর, যেখানে পল্লীকবি জসীম উদদীনের আসমানীরা থাকেন।
ছইঅলা মহিষের গাড়িতে করে চলছে মা-ছেলে। মধুর চোখ জলে ভরে উঠেছে। রসুলপুরে নাড়িপোঁতা হলেও মধুমতির জল-হাওয়ার সাথেই তার হৃদ্যতা বেশি।
গাড়ি চলছে। মধুর চোখের দিকে তাকিয়ে মায়ের কল্পনায় ভাসতে থাকে মধুর পরনের হাফপ্যান্ট দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। ঠ্যাংয়ের পেছনের দিকটায় কাদা শুকিয়ে গিয়ে ধূসর রং ধারণ করেছে। মধু পকেটের মধ্যে হাত দিয়ে কয়েকটা টাকি, পুঁটি, বাইলা মাছ বের করছে।
লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সম্বিৎ ফিরে পান মা। অনুমান করেন এটা কানাইপুর। বাড়ি ফেরার পর জানতে পারেন ভাষার দাবিতে যারা মিছিল করতে বেরিয়েছিল তাদের কয়েকজনকে পুলিশ খুঁজতে এসেছে।
৩.
পূর্ববাংলায় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে উত্তাপ বাড়তেই থাকে। আর এরই মধ্যে ঈশান গোপালপুর স্কুলমাঠে চলে শহিদ মিনারের কাজ। মধুর আনন্দের সীমা থাকে না। বাবাকে বলে, ‘বাবা, তুমি কাল আমাগো স্কুলে যাবেনে। খুব সকালে। সূর্য ওঠার আগে; খালি পায়ে। আমরা স্কুলে নতুন শহিদ মিনার বানাইছি।’
বাবা বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে বলেন, ‘হেইডা তুই কি কস? এত তাড়াতাড়ি শহিদ মিনার বানানো যায়নি?’
‘আরে না না, আমরা হগলে মিইল্যা শহিদ মিনার বানাইছি। কলা গাছ দিয়া। হেইডার উদ্বোধন করবেন আমাগো স্কুলের হেডমাস্টর। হেরপর আমরা মানে স্কুলের হগোল ছাওয়াল-পাওয়াল ভাষা আন্দোলনে শহিদদের জন্যি শ্রদ্ধা জানাবো।’
আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মধু আবার স্কুলমাঠে যেতে চায়, যেখানে বানানো হয়েছে শহিদ মিনার। উঠোনে পা বাড়াতেই কোকিলের মোহিনী কণ্ঠ বিমোহিত করে। স্কুলের সামনে হলুদ রঙে ছেয়ে যাওয়া সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি আর হরেক রকম প্রজাপতির আনাগোনা মধুকে আকুল করে তোলে। গেটের ওপাশে শিমুল গাছের লাল হয়ে ওঠা নিত্যাসঙ্গী টিয়াপাখিকে দেখে মধুর একবার গুলতির কথা মনেপড়ে। এমন টিয়া সে অনেকদিন দেখেনি। মধুমতির তীরে যে বিশাল অশ্বত্থ গাছটা আছে সেখানেও না। আমের বোলের মৌ মৌ গন্ধ আর মাছিদের গুঞ্জরণ এক প্রকার মাদকতাই ছড়িয়ে যায়। রবির কিরণ তখনো ফুরিয়ে যায়নি। স্কুল গেট পেরিয়েই যা দেখতে পেল, তা বিশ্বাস করতে চায় না মধু। অনেক মিলিটারির সমাগম সেখানে। কলাগাছ দিয়ে বানানো শহিদমিনারকে ঘিরে অচেনা সব লোকের আনাগোনা। কাউকেই চিনতে পারে না। মিলিটারিকে প্রশ্ন করবে সে সাহস কি তার আছে?
হ্যাঁ, এবার মায়ের কথাই মনেপড়ে যায় মধুর। মা তাকে বলেছিলেন, ‘মধু, এত্তসব করতে যাইস না, সময় ভালা না। মায়ের পেটের মইধ্যে থিক্যা মায়ের সাথে যুদ্ধ কইর্যা কোনোদিন কেউ জিতবার পারছে? আমরা হগলে হয়তো হেইডাই করবার লাগছি।’
মায়ের এমন শঙ্কা-আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার কথা মধুর স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে। এমন গূঢ় অর্থের ব্যাখ্যা মধুর সরল মনে ধারণ করা কঠিনই বটে।
৪.
সাতকোটি মানুষের প্রত্যাশা যখন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তখনই ঘটে গভর্নরি শাসনের ক্ষমতা হস্তান্তর। তারপর দৈনন্দিন কর্মসূচি বাংলাভাষায় মুদ্রণের দাবি মধুর মাকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকলে মধু মায়ের কাছে জানতে চায়, ‘মা রে, সত্যি সত্যি কাল প্রভাতফেরিতে যাইতে পারবো?’
‘হ। পারবি।’
‘আবার যদি পুলিশ…’
‘না অ্যহন আর সে সাহস পাবে না রে। হুনছি আজ রাইতেই ঢাহায় মওলানা ভাসানী, বরকতের মা হাসিনা বেগম শহিদ হওয়ার জাগাত ফিরবার ভিত্তি গড়বে।’
এবারই প্রথম একুশের দিনটি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ছুটির আনন্দে দুলতে দুলতে মায়ের কোলে এসে লাফিয়ে পড়ে মধু।
যে শব্দটা মধুর জীবনে এতদিন স্বপ্ন আর কল্পনা হয়ে গেঁথেছিল, আগামীকাল তা সত্যে রূপান্তরিত হবে। মধু এবার সত্যি সত্যি মিছিলে যাবে, শহিদ মিনারে যাবে।
মধুর আবেগ আর ধরে রাখা যায় না। খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘সত্যি মা!’
মায়ের চোখে তখন আনন্দাশ্রু।
নির্ঘুম রাত। ঘুমের ঘোরে মধু শুনতে পায়,
‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়,
ওরা কথায় কথায় শেকল পরায়- আমার হাতে পায়…’
আড়মোড়া ভেঙে চিৎকার করে ওঠে মধু। মা উঠে বসেন মধুর কাছে। মধু চোখ ঘষতে ঘষতে বলে, ‘ওই তো হগলে মিইল্যা গান গায়া শহিদ মিনারের দিকে যাবার লাগছে।
‘কী কস? কীসের গান?’ মধুর মা প্রশ্ন করেন।
ঘুমঘোরে শোনা গানটি তখন আর শুনতে পায় না মধু।
‘গানডা কইতে পারবি?’
‘হ।’
‘ক তো।’
‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়…’
‘ও… এইডা তো আব্দুল লতিফের গান। হেয় তো পথে পথে ঘুইরা ঘুইরা গান গাইয়া বেড়ায়। একবার আমিও হুনছিলাম। কই চল তো দেহি!’
মা-ছেলে দুজনেই উঠোনে এসে দাঁড়ায়। তখন অদূরে মিনার থেকে ভেসে আসে, আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম …