শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প।। শিয়াল দাদুর সভা।। আলমগীর খোরশেদ

তখন মধ্যরাত। আকাশে চাঁদ না থাকলে ও কোটি তারার সামিয়ানায় ঢাকা জনপদকে, ঘুটঘুটে অন্ধকার বলা যায়না। ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে যেনো, পুরো গ্রামটা। বাঘমারা গ্রামের চৌধুরী বাড়ির জঙ্গলটি এলাকার সবচেয়ে বড় জঙ্গল। চৌধুরী বাড়ির বড় কর্তা নিজ হাতে বাঘ মেরেছিলেন বলেই, গ্রামের নাম বাঘমারা হয়ে যায়। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে গেলেও জঙ্গলের প্রাণীদের কারো ঘুম নেই। আজ জরুরী সভা ডাকা হয়েছে জঙ্গলে। বুলবুলি, চন্দনা আর ভোঁদড় জঙ্গলের সবাইকে সভায় আসার জন্য দাওয়াত দিয়ে এসেছে। জঙ্গলের সবচেয়ে বয়স্ক, পন্ডিত, জ্ঞানী, মুরুব্বী, শিয়াল দাদু সভার প্রধান।
বন মোরগ, বন বিড়াল, শালিক, ডাহুক, বেজি, দোয়েল, কাঠবিড়ালি, গুইসাপ, সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ সবাই এসেছে আজ। কয়েকটা চিল আর প্যাঁচা গাছের উঁচু ডালে বসে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। সজারুকে জঙ্গলের সীমান্ত এলাকায় রাখা হয়েছে। তার শরীরে লম্বা ধারালো কাঁটা। সজারু বার বার কাঁটা গুলো ফুলিয়ে দেখাচ্ছে, বহিঃশত্রুর আক্রমনে তার যথেষ্ট সামর্থ্যতা রয়েছে।
আজ সভার আলোচ্য বিষয় হলো– ‘ বন উজাড় ও প্রাসঙ্গিক করণীয় ‘। প্রধান আলোচক শিয়াল দাদু ছাড়া ও বক্তৃতা দেবে আর্কিটেক্ট পাখি বাবুই, বাদুড়, প্যাঁচা, সজারু, কচ্ছপ ও বক। সভার উপস্থাপনার দায়িত্বে আছে বন বিড়ালের মেয়ে। শিয়াল দাদু বুড়ো হওয়ায় হাঁটা, চলা অসুবিধা। শরীরে জোর ও পান না আগের মতো। তাই শিয়াল দাদুর বাসার সামনেই আজকের সভা।
বন বিড়াল একটা গাছের গুঁড়ির উপর দাড়িয়ে। সবাই অযথা কথা বলে হৈচৈ বাধিয়ে দেবার উপক্রম। ধমক দিয়ে উঠে বন বিড়াল ‘ এতো কথা কেন? আমাদের চরম দুর্দিন আজ। ভাইসব, চুপ করুন, আমাদের সভার কাজ এক্ষুনি শুরু হবে। আমাদের আজকের প্রধান বক্তা আমাদের সবার মুরুব্বি শিয়াল দাদু। উনার আগে এখন আপনাদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন, আমাদের আকির্টেক্ট পাখি বাবুই। ‘ বাবুই পাখি বসে ছিলো একটা ঝাও গাছের মগ ডালে। নীচে নেমে এসে বল্লো, ‘ ভাইসব, আজ যেভাবে মানুষ বন জঙ্গল কেটে সব উজাড় করে দিচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বাসা বানানোর জায়গা থাকবেনা। কোথাও তাল গাছ নাই এখন। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা আখ ক্ষেতে থাকতে হচ্ছে। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে নিরাপত্তাহীন কতোদিন থাকা যায়? আমাদের কি করণীয়, মুরুব্বীরা জানাবেন দয়াকরে। আমি আমার বক্তব্য এখানে শেষ করলাম। সবাইকে ছালাম।’ —বাবুই পাখি হাঁপাতে থাকে কথাগুলো বলে। বনবিড়াল বাবুইকে ধন্যবাদ জানায়, তার সুন্দর বক্তব্য রাখার জন্য। শালিক এগিয়ে আসে, ‘ ভাতিজি, বন বিড়াল, আমার কিছু কথা বলার আছে। ‘ —–বনবিড়াল তার মাথার ফিতা ঠিক করতে করতে বল্লো, — ‘শালিক আংকেল বলেন। কোনো সমস্যা নাই।’ শালিক সবার সামনে উঁচু গাব গাছের ডাল থেকে নীচে নেমে এলো।
‘ কি বলবো, আমাদের জঙ্গলবাসীদের এখন দূর্দিন। আমাদের বাসা বানানোর জন্য গাছ নাই, সব গাছ কেটে ফেলছে। ইট ভাটার ইট পুড়ানোর জন্য সব গাছ, বড় না হতেই কেটে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে লোকজন।’ সামনে বসা সবাই বলে উঠলো, ‘ ঠিক কথা, এইভাবে গাছ কাটা চলতে থাকলে, বনায়ন থাকবেনা। পরিবেশের সমস্যা হবে।’
‘ কি বলবো ভাইসব, জমিতে কীট নাশক দেওয়ার নামে বিষ দেওয়া হয়, আমাদের পাখি ভাইরা এসব কীট পতঙ্গ খেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে। আমরা অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবো।’ বক তার সাদা পাখা মেলে ধরে ইশারা দিলো বনবিড়ালকে, কিছু বলবে সে। ‘ এবার আমাদের সামনে মূল্যবান বক্তব্য রাখবেন, আমাদের বক আংকেল। আংকেল প্লিজ শুরু করেন। বক বল্লো, ‘ কোথাও একটু বাসা বানানোর বড় গাছ নাই, বাঁশ ঝাড় ও কেটে ফেলতেছে। মাছ, ব্যাঙ কিছুই পাইনা খাওয়ার জন্য। ব্যাঙ এর এতো অভাব হবে কেন, নদ নদী, খাল বিলের এই দেশে? আমি মনে করি, আমাদের ও অস্থিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে, কি করণীয়, ভাইসব, আমাদের জানান। দূরে কোথাও চলে যাওয়া যায় কিনা, গেলে ও কোথায় যাবো? আপনারা বলে দিন। আমার বক্তব্য এখানে শেষ। সবাইকে ধন্যবাদ।
বন বিড়াল বলে উঠলো, ‘ ভাইসব, আমরা যে বিপদে আছি, তা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দিকনির্দেশনা দিবেন, আজকের সভার মুরুব্বি, আমাদের নেতা, দাদু, পন্ডিত শিয়াল দাদু।’
সজারু, কচ্ছপ শ্লোগান ধরলো, ‘ আমার নেতা, তোমার নেতা, ‘ —–সবাই একসাথে বলে উঠলো, ‘ শিয়াল দাদূ, শিয়াল দাদূ।’
শিয়াল দাদূ ‘র শরীরটা দূর্বল। কাশিটা ও বেড়েছে। ভাঙ্গা চশমাটা দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে কেউ। নাকের উপর চশমাটা বসিয়ে, চশমার উপর দিয়ে চারপাশটা দেখে নিলেন শিয়াল দাদু।
লিস্টে বক্তৃতায় বাদুড়ের নাম, তবুও সে সভায় এলোনা। ইদানীং কথাবার্তা কম শুনছে বাদুড়টা। ভোঁদড় কে সামনে পেয়ে শিয়াল দাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কিরে ভোঁদড়, বাদুড় কে দেখছিনা কেন রে?’
‘ সবাইকেই বলা হয়েছে দাদু, আমরা কাউরেই বাদ দেই নাই।’
শিয়াল দাদু কিছুক্ষণ কাশলেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘ জঙ্গলের বেবাক ভাইবোনরা শোনো, আমাদের সামনে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। যতোদিন চৌধুরী বাড়ির এই জঙ্গল আছে, আমরা শান্তি। কাজেই এতো ব্যতিব্যস্ত হওয়ার দরকার নাই। আমরা সবাই এক থাকতে হবে।নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ লাগা যাবেনা। একজনের বিপদে আরেকজন, থাকতে হবে। যদি এই জঙ্গলে কোন সমস্যা আসে, আমরা তখন অন্য সিদ্ধান্ত নিবো। ‘ —- কথা গুলো বলে শিয়াল দাদু কাহিল হয়ে, জোরে দম ফেলতে লাগলেন। সাপ কিছু বলার জন্য দাড়ালো, বনবিড়ালের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারা দিলো, তার বলার আছে।
বনবিড়াল বল্লো, ‘ সাপ আংকেল বলুন’।
সাপ বার বার জিহবা বের করে আবার মুখে ঢুকিয়ে এপাশ পাশ ও দেখে নিয়ে বল্লো, ‘ যেভাবে পুকুর, জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে, মাছ নাই, ব্যাঙ নাই। খামুডা কি?’
ভোদড়ের ভীষণ ক্ষিধা লেগে গেছে। সভাটভা ভালো লাগছেনা তার। তারপর ও সামাজিকতা বজায় রাখা বলে কথা। বাদুড়ের কথা সব বলেনি শিয়ালদাদুকে। কি দরকার একই জায়গায় থেকে ঝগড়া বাড়ানো। শিয়াল দাদু আবার আসলেন। আসনে বসলেন। সবাইকে কাছে আসতে বল্লেন, ‘ শোনো তোমরা, আমার বয়স হয়েছে। এই জঙ্গল, আমাদের এই পন্চায়েত, তোমরা ধইরা রাখবা। সবাই এক থাকবা। চোখ কান খোলা রাইখা চলবা। আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সাপ আর চিল পাখিকে ন্যাস্ত করলাম। চিল উপর থেকে আর সাপ নীচে থেকে সব খেয়াল রাখবে। চিল আমাদের গোয়েন্দা শাখা প্রধান। মানুষ একসময় বুঝবে, গাছ কাটা, বনায়ন ধবংস, এসব পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। অক্সিজেন ফক্সিজেন, কার্বন ডাই কি যেনো সব বলে, এসবেও প্রভাব ফেলবে বনায়ন না থাকলে। কাজেই, চিন্থার কিছুইনাই। ‘ — এতক্ষণ ধরে কথা বলতে বলতে কাশি উঠে যায় শিয়াল দাদুর। হাঁফাতে থাকে বুড়ো বেচারা। দাদু বলতে থাকেন,’ সভা এখানেই শেষ। তোমরা বাড়ি যাও, সবাই। রাত অনেক এখন। ‘
উপস্থাপনা থেকে বনবিড়াল সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। সভা শেষ হয়।
জঙ্গলটা কেমন যেনো নিশ্চুপ হয়ে যায়। কারোর মনে সুখ নেই, মুখে হাসি নেই। ডাকা ডাকি করেনা পাখিরা মন খোলে, আগের মতো। সবাই আগত দুর্দিনের অপেক্ষায় থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *