শিশুতোষ গল্প

ধারাবাহিক: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ‘লাহোর টু গোপালগঞ্জ’ আহমেদ রিয়াজ

১২ অক্টোবর ১৯৪৯। ভোর হতে তখনও অনেক সময় বাকি। ১৫০ মোগলটুলী। আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিস। অফিসেই ঘুমিয়ে ছিলেন শেখ মুজিব। হঠাৎ…

প্রচ- হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। সূর্য মিয়ার গলা, ‘জলদি উঠুন! শিগগির উঠে পড়–ন!’

সকাল হয়ে গেছে? নড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নড়তে পারলেন না মুজিব। পুরো শরীরে প্রচ- ব্যথা। জ¦র এসেছিল। বাধ্য হয়ে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়েছেন। তবু শরীর ব্যথা যায়নি। এ সময় ঘুমটা খুব দরকার। ঘুমালে শরীরটা ফিট হয়ে যাবে। আবার পুরোদমে পার্টির কাজ করতে পারবেন। কিন্তু সূর্য মিয়া তো সব জানে। তবু ঘুম থেকে ডেকে তুলতে চাইছে কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো? ওরা আবার পার্টি অফিসে আক্রমণ করে বসেনি তো! ওরা মানে মুসলিম লীগের গু-ারা। ওদের সঙ্গে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। মারামারির শুরুটা ওরাই করেছিল।

এগারই অক্টোবর আরমানিটোলা ময়দানে সভা আহ্বান করেছিল আওয়ামী লীগ। ঘোড়ার গাড়িতে করে আওয়ামী কর্মীরা সভার প্রচার করছিল। ঘোড়ার গাড়ি নবাবপুর আসতেই প্রচার গাড়ি আগলে দাঁড়াল একদল মুসলিম লীগ কর্মী। আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে মারধর শুরু করে দিল। তারপর নূরুল ইসলামের কাছ থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা ছুটে এলো মোগলটুলী আওয়ামী লীগ অফিসে।

মুজিব তখন অফিসেই ছিলেন। আট-দশজন কর্মী নিয়ে আলোচনা করছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে এক কর্মী বললেন, মুজিব ভাই মুজিব ভাই, ওরা আমাদের মেরে মাইক্রোফোন নিয়ে গেছে।

ওরা কারা?

মুসলিম লীগের গু-ারা। ওদের চিনতে পেরেছি। আমরাও তো একসময় মুসলিম লীগ করতাম। ওদের চিনব না?

এ তো বড় অন্যায়। চল, আমি এদের কাছে জিজ্ঞাসা করে আসি আর অনুরোধ করি মাইক্রোফোনটা ফেরত দিতে। যদি দেয় ভাল, না দেয় কি করা যাবে! থানায় একটা এজাহার করে রাখা যাবে।

সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলেন মুজিব। সঙ্গে ছাত্রলীগের নূরুল ইসলাম, চকবাজারের নাজির মিয়া এবং সিটি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুল হালিম। খবর নিয়ে মুজিব জেনেছেন ওরা এখন ওদের অফিসেই আছে। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ওদের অফিস। সঙ্গীদের নিয়ে ওদিকেই চললেন মুজিব।

কো-অপারেটিভ ব্যাংকের উপর তলায়ই তারা ওঠাবসা করে। ওখানে গিয়ে মুজিব দেখলেন ওরা আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। ওই তো ইব্রাহিম আর আলাউদ্দিন। মুসলিম লীগের কর্মী। কদিন আগেও মুজিবদের সহকর্মী ছিল।

শেখ মুজিব জানতে চাইলেন, ‘আমাদের মাইক্রোফোনটা নিয়েছ কেন? এ তো বড় অন্যায় কথা! মাইক্রোফোনটা দিয়ে দাও।’

ইব্রাহিম আর আলাউদ্দিন বলল, ‘আমরা নেই নাই।’

‘তাহলে কে নিয়েছে?’

‘কে নিয়েছে জানি না।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে নূরুল ইসলাম বললেন, ‘মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার সময় আপনারাও ছিলেন। তখন কথা কাটাকাটি চলছিল।’

আবারও অস্বীকার করল ওরা, ‘বললাম তো আমরা নেই নাই। কে নিয়েছে সেটাও জানি না। এবার ভাগো!’

নাহ। ওরা তো আচ্ছা শয়তানি শুরু করেছে! কী করা যায় ভাবতে লাগলেন মুজিব। হঠাৎ…

আরে! ওই তো ইয়ার মোহাম্মদ খান। সঙ্গে হাফিজুদ্দিনও আছে। হাফিজুদ্দিন আওয়ামী লীগ কর্মী। রিকশায় করে কোথাও যাচ্ছেন দুজন।

ঢাকার পুরনো বাসিন্দা ইয়ার মোহাম্মদ খান। বংশমর্যাদা, অর্থবিত্ত, লোকবল-কোনো কিছুরই তাঁর কমতি নেই। ইয়ার মোহাম্মদ খানকে ডাক দিলেন মুজিব, ‘ইয়ার মোহাম্মদ ভাই, দেখে যান মুসলিম লীগের কর্মীরা কীরকম গু-াগিরি শুরু করেছে!’

রিকশা থেকে নেমে ছুটে এলেন ইয়ার মোহাম্মদ খানও হাফিজুদ্দিন। মুজিবের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলেন। এবার ইব্রাহিম আর আলাউদ্দিনকে বললেন, ‘কেন তোমরা মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়েছ, এটা কি মগের মুল্লুক?’

ইব্রাহিম নাকি আলাউদ্দিন, কেউ একজন বলে বসল, ‘নিয়েছি তো কি হয়েছে?’

ব্যস। আর যায় কোথায়? ইয়ার মোহাম্মদ খান বলে কথা। এইটুকুন ছোকরা তাঁর সঙ্গে বেয়াদবের মতো কথা বলছে! প্রচ- রেগে গেলেন ইয়ার মোহাম্মদ। ঠাস করে ছোকরার গালে বিশাল এক চড় বসিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ আগে মার খেয়ে ছুটে আসা হালিমের রাগও তখন তেতে উঠেছে। সুযোগ পেয়ে হালিমও হাত চালালেন। ঘুষি মেরে বসলেন ছোকরার গায়ে। কিন্তু এ কী! পিছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন মুজিব ও তাঁর সঙ্গীরা। ইব্রাহিম ও আলাউদ্দিনের পিছন থেকে বেরিয়ে এলো অনেকগুলো মুখ। ষ-ামার্কা। চোখে মুখে ক্রোধ।

ওরা আবার কারা? ওরা এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিল?

এসব ভাবার সময় কোথায়? ততক্ষণে হালিম ছুটে চলে গেল ওখান থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘দাঁড়াও, আমিও দেখাচ্ছি।’

মুজিব বুঝলেন, হালিম তাঁর মহল্লায় ছুটে গেছেন। নিজের মহল্লা থেকে লোকজন নিয়ে হাজির হবে খানিক বাদে। কিন্তু ততক্ষণে ষ-াগুলো আক্রমণ করে বসল মুজিবদের।

অবস্থা বেগতিক। প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির মালিক হুমায়ুন সাহেব বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। ইয়ার মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরির ভিতর।

আর মুজিব রিকশা নিয়ে ছুটলেন আওয়ামী লীগ অফিসে। লীগ অফিসে দশ-বারোজন কর্মী আছে। ভাগ্যিস ওখান থেকে সরে গিয়েছিলেন মুজিব। নইলে তাঁকেও ওরা ছাড়ত না।

মুসলীগ লিগের গু-ারা অনেক দিন ধরেই বিরক্ত করছিল আওয়ামী কর্মীদের। বিশেষ করে রায় সাহেব বাজারে মুসলিম লীম অফিসের কাছে ওদের গু-ামি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওখান দিয়ে কেউ নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারত না। চাঁদাবাজি তো করতই, টাকা খেয়ে ছাত্রদের মারধরও করত। আর আওয়ামী কর্মীদের পেলে তো কথাই ছিল না। ওখান দিয়ে ছাত্র শোভাযাত্রা বা আওয়ামী কর্মীদের দেখলেই ধাওয়া করত। নাগালে পেলে মারপিট করত। ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে অনেক আওয়ামী কর্মী নাজেহাল হয়েছিল।

কখন যে হাফিজুদ্দিনও ছুটে গিয়েছিলেন, কেউ টেরই পায়নি। হাফিজুদ্দিন গিয়েছিলেন ইয়ার মোহাম্মদের মহল্লায় খবর দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইয়ার মোহাম্মদের ভাই আর আত্মীয়স্বজন হাজির। যে যে অবস্থায় ছিলেন, সে অবস্থাতেই ছুটে এলেন। কিন্তু এ কী! ষ-াগুলো নেই। একটু আগেই লাইব্রেরির সামনে জড় হয়েছিল সবাই। বাইরে থেকে গালাগালি করছিল ইয়ার মোহাম্মদকে। দূর থেকে ইয়ার মোহাম্মদের লোকজন আসতে দেখেই সটকে পড়েছে। কাউকে খুঁজেই পাওয়া গেল না।

ঘটনাস্থলে মুসলিম লীগের একজন মন্ত্রীও ছিলেন। উপরের তলায় বসে দলের লোকজনের কীর্তিকলাপ দেখে মজা পাচ্ছিলেন মন্ত্রী মশাই। মনে হয় মন্ত্রী সাহেবই পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। পুলিশও হাজির।

একটু পর মুজিবও এলেন দলবল নিয়ে। মুজিবের পক্ষের লোকজন এখন অনেক। সুযোগটা কাজে লাগালেন ইয়ার মোহাম্মদ। শোভাযাত্রা করে রায়সাহেব বাজার এলাকার মুসলিম লীগ অফিসে হামলা চালালেন ইয়ার মোহাম্মদ। কয়েকটা গু-াকে বাগে পেয়ে ধরেও ফেললেন। বিচার বসল মহল্লায়। ঢাকার মহল্লার বিচার। অভিযোগকারীদের ধরে নিয়ে মসজিদে হাজির করা হতো। বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে মারধর করা হতো। পুরান ঢাকায় এরকম বিচারকে বলে কোর্টকাচারি। ওই কোর্টকাচারিতে গু-াদের শায়েস্তা করা হলো।

ভাবতে লাগলেন মুজিব, তাহলে কি ওই গু-ারা প্রতিশোধ নিতে এসেছে?

আবারও সূর্য মিয়ার গলা, ‘পুলিশ এসেছে তোমাদের গ্রেফতার করতে।’

যাক। মুসলিম লীগের গু-ারা আসার সাহস পায়নি। মনে মনে খুশিই হলেন মুজিব। মুসলিম লীগের গু-াদের আগের মতো অতো বুকের পাটা নেই। একটা দীর্ঘশ^াস ফেললেন মুজিব। পুলিশই এসেছে। আবার অবাক হলেন, এই শেষ রাতে পুলিশ কেন? তবে অবাক হলেও মোটেও ঘাবড়ালেন না শেখ মুজিব। পুলিশ আসতেই পারে। পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে পালানোর মানুষ তিনি নন। এ পর্যন্ত অনেকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। জেলও খেটেছেন। এবার আর একটুও নড়লেন না তিনি। নড়লেই শরীর ব্যথা করে। যেভাবে ছিলেন, সেভাবেই শুয়ে রইলেন। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যাক। ধরে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তো বিশ্রাম করতে পারবেন!

ওই বছরের ২৩ জুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ। অবশ্য যখন সম্মেলন করে দল গঠন করা হয়, তখনও তিনি জেলে ছিলেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই নতুন দল গঠনের খবর পান তিনি। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দলের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। দল ঘোষণার পরদিন পত্রিকায় তাঁর নামের পাশে লেখা হয়েছিল নিরাপত্তা বন্দি। নতুন দল গঠনের পর প্রথম সভা হয়েছিল ২৪ জুন। আর দ্বিতীয় বারের মতো সভা হলো গতকাল এগারই অক্টোবর।

২৪ জুনের সভায় মজার এক কা- ঘটেছিল। প্রথম সভার ঘটনা মনে পড়ল মুজিবের। মুজিব তখনও জেলে। নতুন দল গঠনের পর সেটাই প্রথম সভা। আরমানিটোলা ময়দানে সভা। মাওলানা ভাসানী প্রথম ঢাকায় বক্তৃতা করবেন। আরমানিটোলা ময়দান লোকে লোকারণ্য। ঘাবড়ে যায় মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগ যাতে সভা করতে না পরে, সে জন্য গু-ামীর আশ্রয় নেয় মুসলীম লীগ। সভা শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একদল ভাড়াটিয়া গু-া মাইক্রোফোন নষ্ট করে দিয়েছিল। প্যান্ডেল ভেঙে দিয়েছিল। অনেক কর্মীকে মারধরও করেছিল।

তখন ঢাকার নামকরা গু-া ছিল বড় বাদশা। বাবুবাজারের বাদামতলী ঘাটের বাসিন্দা। বড় বাদশার বিশাল বড় গ্যাং। বড় বাদশাকে বোঝানো হয়েছিল, যারা আওয়ামী লীগ নামের সংগঠন তৈরি করেছে এবং আওয়ামী লীগের সভা করছে তারা পাকিস্তানের ভালো চায় না। তারা চায় পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। কাজেই এদের সভা করতে দেয়া হবে না। তাদের সভা ভ-ুল করার দায়িত্ব পায় বাদশা মিয়া। যদিও বাদশা মিয়া খুব ভালো বংশের সন্তান। কিন্তু খারাপ সঙ্গে পড়ে এবং ঢাকার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় যুক্ত হয়ে খারাপ রাস্তায় চলে গিয়েছিল। দাঙ্গার কারণে অনেক মামলার আসামীও হয়েছিল।

সভায় গোলামাল বাধিয়ে চলে গেল বাদশা মিয়া। যাওয়ার আগে হুমকিও দিয়ে গেল, আবার সভা করার চেষ্টা করা হলে পরিণতি আরো খারাপ হবে।

এ তো মহা মুসিবত! একে তো নতুন দল। তার ওপর দেশে দু:শাসন কায়েম করেছে মুসলীম লীগ সরকার। দু:শাসনের কবলে পড়ে মানুষ হাঁসফাস করছে। সাধারণ মানুষের কাছে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দু:শাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে মানুষ জেগে উঠতে চাইছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তো জানাতে হবে, আওয়ামী লীগ কী করতে চায়। কেমন করে দেশের মানুষের মুক্তি অর্জন করতে চায়। সভা না হলে কিভাবে বোঝাবে?

বাদশা মিয়ার মহল্লায় থাকতেন আরিফুর রহমান চৌধুরী। অমায়িক তার ব্যবহার। খেলাফত আন্দোলন থেকে রাজনীতি করছেন। দেশের রাজনীতি করতে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। জন্ম নিয়েছেন বরিশালের উলানিয়া জমিদারি বংশে। বুকভরা সাহসও আছে তাঁর। আরিফুর রহমান গেলেন বাদশা মিয়ার কাছে। বললেন, বাদশা মিয়া, আমাদের সভা একবার ভেঙে দিয়েছেন। আমরা আবার সবকিছু ঠিক করে সভা আরম্ভ করেছি। আপনি আমাদের কথা প্রথমে শুনুন। যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলি বা দেশের বিরুদ্ধে বলি, তাহলে না হয় আপনার যা ইচ্ছে করবেন। চাইলে সভাও ভাঙতে পারেন।’

যুক্তির কথা। মানতে রাজি হলো বাদশা মিয়া। দলবল নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সভার বক্তৃতা শুনতে লাগল। বক্তৃতা শুনতে শুনতে উসখুস করতে লাগল বাদশা মিয়া। এর মধ্যেই কয়েকজন বক্তৃতা দিয়েছেন। আর স্থির থাকতে পারল না বাদশা মিয়া। মঞ্চের কাছে এসে জানাল, আমারও কিছু কথা আছে। আমাকে বলতে দিতে হবে।

বাদশা মিয়া কথা বলতে চায়। আরমানিটোলা ময়দান তার রাজত্বের মধ্যে। তাকে বাধা দেয় কে? কিন্তু কী বলতে চায় বাদশা মিয়া? যা-ই বলুক, বলতে তো তাকে দিতেই হবে। কাজেই বাদশা মিয়াকে বলতে দেয়া হলো।

মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে বাদশা মিয়া বলতে শুরু করল, ‘আমাকে মুসলমি লীগ নেতারা ভুল বুঝিয়েছিল আপনাদের বিরুদ্ধে। আপনাদের সভা ভাঙতে আমাকে পাঁচশ টাকা দিয়েছিল। এ টাকা এখনও আমার পকেটে আছে। আমার পক্ষে এ টাকা গ্রহণ করা হারাম। আমি এ টাকা আপনাদের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।’

বাদশা মিয়ার কথা শুনে উপস্থিত সবার চোখ ছানাবড়া। এ কী বলছে বাদশা মিয়া। এভাবে কেউ হাটে হাঁড়ি ভাঙে? বুকের বিশাল পাটা না থাকলে কেউ পারে না। বাদশা মিয়ার বুকের পাটা সেরকমই বিশাল। শুধু তাই নয়, এরপর বাদশা মিয়া যা করল, তাতে আরো অবাক হলো সবাই। সত্যি সত্যি পকেট থেকে পাঁচশ টাকা বের করে ছুঁড়ে মারল সবার সামনে। একশটা নোট। সবগুলোই পাঁচ টাকার। সবার সামনে সভার মধ্যে টাকাগুলো উড়তে লাগল ফড় ফড় করে। কেউ কুড়িয়ে নিল। তবে বেশিরভাগ মানুষই ছিঁড়ে ফেলল। হারামের টাকা বলে কথা।

চোখের পলকে পাঁচশ টাকা উধাও করে ফেলল বাদশা মিয়া। তারপর আবার বক্তৃতা শুরু করল, আজ থেকে আমি আওয়ামী লীগের সভ্য হলাম। দেখি আরমানিটোলায় কে আপনাদের সভা ভাঙতে পারে?’

এবার সবার চোখ উঠে গেল কপালে। হই হই করে উঠল সবাই। বাদশা মিয়ার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিল সাধারণ মানুষ। নতুন করে উজ্জীবিত হলো মানুষ। মুসলিম লীগের প্রতি আরো বেশি ঘৃণা জন্মাল সাধারণ মানুষের। আর আওয়ামী লীগের প্রতি আরো বেশি আস্থা তৈরি হলো। অধিকার আদায়ে হলো আরো বেশি সাহসী।

গু-ামীর আশ্রয় নিয়েও আওয়ামী লীগের সভা বন্ধ করতে পারেনি মুসলিম লীগ। এরপর তারা অন্য পথ ধরল। আওয়ামী লীগের সভা হলেই ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশি নির্যাতন শুরু করল। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রথম মফস্বলের সভা এভাবেই পন্ড করে দিতে পেরেছিল। জেল-জরিমানা দিয়ে হয়রানী করল আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীকে। আর এতে আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন বাড়তে লাগল হুহু করে।

হঠাৎ নিজের অজান্তেই একটা মুচকি হাসি দিলেন মুজিব। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার প্রথম সভার কথা। জামালপুরের উকিল হায়দার আলী মল্লিক সাহেব জেলা আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। ওখানেও আওয়ামী লীগের সভা হবে। সভা সফল করার জন্য ছাত্রনেতা হাতেম আলী তালুকদারকে নিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করলেন। সেই পরিশ্রমের নমুনা ওখানে গিয়েই দেখতে পেলেন মুজিব। সভায় বিরাট জনসমাগম। এত মানুষ দেখে মনটা ভরে গিয়েছিল সবার। আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকসহ সবাই উৎফুল্ল। কিন্তু, সেই পুরনো কৌশল অবলম্বন করল মুসলিম লীগ সরকার। সরকারি বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের কাজে লাগাল। পুলিশ এসে মাওলানা সাহেবকে একটা কাগজ দিল। ১৪৪ ধারা জারির সরকারি নির্দেশ। মানে সভা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৪৪ ধারা।

বেঁকে বসলেন শেখ মুজিব। বললেন, ‘মানি না ১৪৪ ধারা। আমি বক্তৃতা করব।’

অমায়িক এক মুচকি হাসি দিলেন ভাসানী। ওই হাসিতেই বুঝিয়ে দিলেন, রসো বাছা। দেখো না আমি কী করি। আমার কৌশলটা দেখো শুধু। মুখে কিছু বললেন না।

সভামঞ্চে দাঁড়ালেন মাওলানা ভাসানী। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে বললেন, ‘১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না।’

এ কী বলছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তবে কি সরকারের দমন-পীড়নের কাছে মাওলানা হেরে গেলেন! কিন্তু তা তো হবার কথা নয়। মাত্র একবছর আগে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আইনসভার দক্ষিণ টাঙ্গাইলের একটি আসন শূন্য হয়ে যায়। ওই আসনের নির্বাচিত সদস্য অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ পদত্যাগ করেন। মুসলিম লীগের প্রাথী করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীর বিপক্ষে উপনির্বাচনে জয়ী হন ভাসানী। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চর ভাসানে থাকার কারণে তাঁর নামের শেষে ভাসানী। ভাসান চরে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী হিসাব দাখিল না করার অজুহাতে ভাসানীর নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে সরকার। ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল আবার উপনির্বাচন হয়। এবার জমিদার পন্নীর বিপক্ষে মুসলিম লীগের তরুণ নেতা শামসুল হক নি:স্ব ও সহায় সম্বলহীন হয়েও জয়লাভ করেন। আবারও নির্বাচন বাতিল করে সরকার। এবারের অজুহাত ছিল ভাসানীর সই জাল করে ইশতেহার বিলি। মুসলিম লীগ সরকারের এরকম ন্যাক্কারজনক কর্মকা- মেনে নিতে পারেননি মুসলিম লীগেরই উদারপন্থীরা। তারাই গঠন করলেন নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। আর এখন আওয়ামী লীগকে সভাও করতে দেয়া হচ্ছে না। সেই ভাসানী বলছেন, ‘আমি বক্তৃতা করতে চাই না।’ কী আশ্চর্য!

এরপরই ভাসানী বললেন, ‘তবে আসুন আপনারা, মোনাজাত করুন, আল্লাহ আমিন।’

বলেই মোনাজাত শুরু করলেন ভাসানী। জোরে জোরে মোনাজাত করছেন ভাসানী। মোনাজাতে জানিয়ে দিচ্ছেন মুসলিম লীগ সরকার কী কী কুকীর্তি করছে। কিভাবে দেশের মানুষকে নির্যাতন করছে। দেশে দু:শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও এই মোনাজাতের মাধ্যমেই জানিয়ে দিলেন মাওলানা সাহেব। সভার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন মুজিব। পুলিশ অফিসার ও সেপাইরাও হাত তুলে মোনাজাত করছেন মাওলানা সাহেবের সঙ্গে। মুচকি হাসলেন মুজিব। মাওলানা সাহেবের পাল্টা কৌশলের কাছে সরকারের ধূর্তামি ধোপেই টিকলই না। পুলিশ প্রশাসন ও মুসলিম লীগ ওয়ালারা সেদিন বেয়াকুফ হয়ে গিয়েছিল।

আবারও হাঁক দিল সূর্য মিয়া। ‘পুলিশ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। জলদি পালাও সবাই।’

গত রাতে সূর্য মিয়ার উপর দিয়েও কম ধকল যায়নি। রাত দুটো পর্যন্ত তাঁর খুব সেবা করেছে। ফরিদপুরের দত্তপাড়ার জমিদার বংশের ছেলে সূর্য মিয়া। আসল নাম সাইফুদ্দিন চৌধুরী। সূর্য মিয়া নামেই পরিচিত।

গতকালের আরমানিটোলা ময়দানের সভায় প্রচুর মানুষ হয়েছিল। পুরো ময়দান তো ভরছেই, আশপাশের রাস্তাও ভরে গিয়েছিল। সভায় গোলমাল হওয়ার মতো সেই আগের ভয়টা আর নেই। বাদশা মিয়ার উপরে কথা বলার কেউ নেই। তবু ঝুঁকি নেয়া হলো না। গোলমালের হবার ভয়ে মাওলানা ভাসানী প্রথমে বক্তৃতা করেছেন। শামসুল হকের পর বক্তৃতা করেছিলেন মুজিব। বক্তৃতা করতে যাওয়ার আগে ভাসানী মুজিবকে বলেছিলেন, ‘শোভাযাত্রা করতে হবে সেইভাবে বক্তৃতা কর।’

বক্তৃতা শুরু করলেন মুজিব। যা বলার বললেন। তারপর একটা প্রশ্ন করলেন জনগণকে, ‘যদি কোন লোককে কেউ হত্যা করে, তার বিচার কী হবে?’

জনগণ জবাব দিল, ‘ফাঁসি হবে।’

আবার প্রশ্ন করলেন মুজিব, ‘যারা হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর কারণ, তাদের কী হবে?’

জবাব পেলেন মুজিব, ‘তাদেরও ফাঁসি হওয়া উচিত।’

মুজিব বললেন, ‘না, তাদের গুলি করে হত্যা করা উচিত।’

তারপর বক্তৃতা শেষ করে মুজিব বললেন, ‘চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্ব বাংলার লোক কী চায়!’

কদিন আগেই তাঁর খবর পেয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা আসবেন ১১ অক্টোবর। আর ওই দিনই আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সাংবাদিকরা তাঁর কাছে আওয়ামী লীগের কথা জানতে চাওয়ায় লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ কি তিনি জানেন না।

সভার পর শোভাযাত্রা শুরু হলো। সবার সামনে মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও মুজিব। আরমানিটোলা থেকে মিছিল নিয়ে নবাবপুর রেলক্রসিংয়ে এসে সবাই দেখলেন, রাস্তা বন্ধ। পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে গুলি করতে পারে।

সেদিন আইন ভাঙার কোনো কর্মসূচী আওয়ামী লীগের ছিল না। এছাড়া পুলিশের বিপক্ষে গোলমাল করার ইচ্ছাও নেই। এবার মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হলো রেল স্টেশনের দিকে। নতুন পরিকল্পনা হলো নাজিরাবাজার রেললাইন পার হয়ে নিমতলিতে ঢাকা মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে নাজিমুদ্দিন রোড হয়ে আবার আরমানিটোলায় ফিরে আসা। কিন্তু নাজিরাবাজারে এসে আবার থামতে হলো। রাস্তা বন্ধ। পুলিশ এখানেও রাস্তা আটকে রেখেছে। মিছিল নিয়ে এগোতে দেবে না। ওদিকে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে গেছে। রাস্তার উপরই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন মাওলানা ভাসানী। শামসুল হকও দাঁড়ালেন সাথে সাথে। তখনই হঠাৎ, বিনা উস্কানিতে টিয়ার গ্যাস ছাড়ল পুলিশ। খেপে যায় জনগণ। পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসে পুলিশ। পুলিশের আঘাতে আহত হলো অনেক কর্মী। তিরিশজন কর্মীকে গ্রেফতার করল পুলিশ। পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে একদল কর্মী মাওলানাকে কোলে তুলে নিল। তারপর একটা হোটেলের ভিতর নিয়ে রাখল। ওদিকে পুলিশের লাঠির আঘাত খেলেন মুজিবও। আঘাতের চোটে প্রায় বেহুঁশ হয়ে একপাশের নর্দমায় পড়ে গেলেন। কয়েকজন লোক তাঁকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে মোগলটুলী নিয়ে এলো।

মুজিবের পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। মুজিবের পায়ে রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেল কর্মীরা। কয়েকজন জানতে চাইল, কী হয়েছে?

একজন বলল, মনে হয় গুলি লেগেছে।

আরেকজন বলল, নাহ। মনে টিয়ার গ্যাসের শেল সরাসরি আঘাত করেছে।

সম্ভবত পড়ে গিয়ে কেটে গেছে।

ডাক্তার এসে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করলেন। তারপর ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মুজিবকে। কারণ ব্যথায় প্রচ- কষ্ট হচ্ছিল তাঁর।

এবার দরজায় খুব জোরে জোরে শব্দ হলো। ওই শব্দে আর শুয়ে থাকা সম্ভব নয়। অনেক কষ্টে শোয়া থেকে উঠলেন মুজিব। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে?

সূর্য মিয়া বলল, অনেকক্ষণ থেকেই তো বলছি, পুলিশ এসেছে। দরজা খুলতে বলছে। দরজা ভেঙে ফেলতে চায়। কিন্তু ওই দরজা ভাঙা এত সহজ নয়। লোহার দরজা। ভিতরে তালা।

‘দরজা খুলে দাও।’

অবাক হয়ে মুজিবের মুখের দিকে তাকাল সূর্য মিয়া। বলল, ‘পুলিশ ভিতরে ঢুকলে তো রেহাই নেই।’

মুজিব বললেন, ‘কী আর করবে? বড়জোর গ্রেফতার করবে। আমি গ্রেফতারে ভয় পাই না। তুমি তো জানো, পুলিশের কাছ থেকে পালানোর অভ্যাস আমার নেই। আজ পর্যন্ত পালাইনি। কাপুরুষেরাই পালিয়ে বেড়ায়।’

সূর্য মিয়া বলল, কিন্তু এখন গ্রেফতার হওয়া যাবে না। পালাতেই হবে।

কেন?

মাওলানা সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। বাকিরা গ্রেফতার হোক সমস্যা নেই। শুধু মুজিব যেন গ্রেফতার না হয়।

অবাক হলেন মুজিব। ভীষণ অবাক হলেন। মাওলানা সাহেব তাঁকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু কেন?

খটাখট। খটাখট। পুলিশের বুটের শব্দ। ধড়াম ধড়াম। দরজা ভাঙার শব্দ।

মুজিব এখন কী করবেন?

গ্রেফতার? নাকি পলায়ন?

২ thoughts on “ধারাবাহিক: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ‘লাহোর টু গোপালগঞ্জ’ আহমেদ রিয়াজ

  • pissing girl

    I think the admin of this website is truly working hard in support of his website, as here every material is quality based material.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *