শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প।। চিৎকারে কেঁপে ছিল আমাদের উঠোন।। মালেক মাহমুদ

পনেরো আগস্ট। ঊনিশ শ পাঁচাত্তর সাল। সেই দিন চিৎকারে কেঁপে ছিল আমাদের উঠান। মিনুর দিকে তাকিয়ে বলতে ছিল মাইদুল।
কাকু, আমাদের উঠোন কেনো কেঁপে উঠে ছিল?
তখন আমি ছোটো ছিলাম। হাসিখুশি ভেতরে কেটে যেতো আমার সময়। দুখ কি জিনিস তা আমি বুঝি নি মোটেও। আমার দাদুর ভীষণ অসুখ ছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য। আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করছি, একাত্তর সালের আগে এই দেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। তারা বাঙালিদের ওপর নানারকম অত্যাচার নিপীড়ন করছে। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাঙালি জেগে ওঠে ছিল। দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনে ছিলেন তারা। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে কত তাজা প্রাণ চলে গেছে তার কোনো সঠিক হিসাব নাই।
দাদু আমাদের গৌরব তিনি মুক্তি যুদ্ধা। দাদা নাকি আমাকে আদুর দিয়ে রেখে গেছিল মুক্তি যুদ্ধে। আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন, দাদুকে দেখেছি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আমার কাছে দাদু যুদ্ধের গল্প করতো। কেনো গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। শেখ মুজিবকে দাদু, ভীষণ ভালোবাসতেন। মিনু কানপেতে শুনছে। মাঝে মাঝে হু হু করছে। যুদ্ধের বর্ণনা দেবার আগেই মাইদুল গল্প বলা রেখে চোখের পানি মুচছিল। মিনু কাকার দিকে তাকি বলতে লাগল, কাকু তুমি কাঁদছো?
না রে পাগলি চোখে এমনি জল এসে গেলো।
‘তালই’ কেনো মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল?
মানুষ, মানুষের প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসা সৃষ্টি হয় কর্ম গুণে। শেখ মুজিবুর রহমানের এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, মানুষকে ভালোবাসার। সাত মার্চে তিনি যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, তা এক অন্যান্য ইতিহাস। সেই ভাষণ মন কেড়ে ছিল দাদুর। সেই ভাষণের এক জায়গায় বললেন, “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।” দাদু শত্রু মোকাবেলা করতে মুক্তি যুদ্ধে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি রইলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। কোনো ভয়ের কাছে তিনি মাথা নত করেন নাই। আদর্শবান নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন বিবেকের আয়না।
দাদু যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধের ময়দানে বহু অপারেশনে যোগ দিয়েছেন দাদু। জয় ছিনিয়ে এনেছেন। বিজয়ের কাছাকাছি সময়ে দাদু হারায় একটি পা। গুলি লাগে হাতে, ক্যাম্পে চিকিৎসা নেয় দাদু। আর এই চিকিৎসা কালিন সময়ে জানতে পারে, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ। পূর্ণ গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু। বাঙালির বন্ধু হিসাবে তিনি এই উপাধি পান। মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করতে থাকেন।
দাদু, একজন যোদ্ধা হিসাবে নিজ ঘরে বসে শান্তির ঢেকুর তুলতেন। আমার সাথে যুদ্ধের গল্প করতেন। আমি শুনতাম যুদ্ধের কাহিনি। দাদু বলতেন, স্বাধীনতার স্বাদ এতো তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে না। আমরা যুদ্ধ করছি স্বাধীন হয়েছি। এখন আমাদের দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি, সেই লক্ষ্যে দেশ গড়ার কাজ চলছে। যার ডাকে আমরা মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছি তাকে সবাই মিলে সহযোগীতা করি। তবেই, আমরা পাবো অর্থনৈতিক মুক্তি। যুদ্ধে আহত দাদু, শেখ মুজিবের জন্য আর্শীবাদ কামনা করতেন। আমি ছুটে বেড়াতাম মাঠের ধারে। খেলাধুলা আর স্কুল। সেদিন আমার স্কুল ছিল না। ছিলাম বাড়িতেই।
দাদু রেডিও শুনতেন। খবর শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট। রেডিও ছাড়তেই খবর প্রচারিত হতে লাগল। শেখ মুজিবুর রহমান কে সহপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। শিশু রাসেল কেউ বাঁচার সুযোগ দেয়নি। তখন দাদুর চেহারায় ক্রোধের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল। চোখ মুখ লাল হয়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন। হায়রে পাসাণ্ড তোরা কি করে পারলি! মানুষের বন্ধু বঙ্গবন্ধুকে এমন নির্মম হত্যাকান্ড ঘটাতে। সিঁড়ির ওপর পড়ে ছিল জাতির পিতার নিথর দেহ! দাদু বিশ্বাস করতে পারছে না, রেডিওর খবর। তখন, বারবার একই খবর প্রচার হতে লাগল, এরই মাঝে দাদু জোরে চিৎকার দিলেন। আর এই চিৎকারের সাথে সাথেই দাদার প্রাণ পাখি উড়ে গেল। তখন গাছের পাতাও আর নড়ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে পাখির কিচিরমিচির। শুধু আমাদের উঠোন নয়, বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সারাবাংলা। সেই চিৎকারে ধ্বনি আজও কানে বাজে। থমকে দাঁড়াই পনেরো আগস্টে। অশ্রুগঙ্গায় ভাসে বুক। মাইদুলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিনু। গল্প আর শেষ হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *