শিশুতোষ গল্প

মুক্তিযুদ্ধের শিশুতোষ গল্প।। কুড়িয়ে পাওয়া গ্রেনেড।। ওবায়দুল সমীর

খটখট খটখট বিকট শব্দে বাড়ির গাছগাছালির উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে যায়। হেলিকপ্টারের শব্দ কানে আসামাত্র দৌড়ে গিয়ে ব্যাংকারে আশ্রয় নেয় লোকজন। যতক্ষণ শব্দটা দূরে মিলিয়ে না যায় ততক্ষণ ওরা ঘাপটি মেরে থাকে ব্যাঙ্কারে। প্রতিটি বাড়িতেই ব্যাঙ্কারে কাটা আছে। বিভিন্ন ইংরেজি অক্ষরে আদলে তৈরি সব ব্যাঙ্কারে।
স্কুল বন্ধ। রুবেল,সোয়েব,সোহেল,মাশকুর,সুকুমার,দীপক,নাজিম,সৌমিত্র, ওপেল,সমু সবাই মিলে বাড়ির উঠানে হা-ডু-, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কখনো কখনো মার্বেল, ডাংগুলি খেলায় মেতে ওঠে। উড়োজাহাজের শব্দ পেলেই ইঁদুরছানার মতো দৌড়ে ব্যাঙ্কারের সরু খোলামুখ দিয়ে পিলপিল করে ঢুকে পড়ে সবাই।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাজাকার আলবদরের অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার খবর আসছে। খালপারের বড়রাস্তার কালভার্টের নিচে প্রায়ই ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যাচ্ছে। পাড়ার পেছন দিয়ে চলে যাওয়া জামালপুর মহাসড়কের উপর দিয়ে শা শা করে ছুটে যায় বন্দুক তাক করা পাকিস্তানি সৈন্যদের জলপাই রঙের জীপ। মাঝে মাঝে জীপগুলো ধুলোয় চারদিক ঢেকে দিয়ে গ্রামের মেঠোপথে ঢুকে পড়ে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলা ফেলে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখে।
গতরাতে মিয়াবাড়ির পাশেই মালাকার এবং কুমারবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে আলবদরের লোকজন। সুকুমার, দীপক মালাকারসহ বড়োরা পালিয়ে গেলেও দীপকের বুড়ো ঠাকুরমা পালাতে পারেননি। পাষণ্ডরা তাকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে লুটেপুটে নিয়ে গেছে সবকিছু। দীপক, সুকুমাররা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল, রুবেলরা আর জানতে পারেনি।
খেলাধুলায় আর আগের উচ্ছ্বলতা নেই। খেলতে গেলেই দীপক, সুকুমারদের কথা মনে পড়ে। ঝিমমেরে বসে থাকে সবাই। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। দীপকের ঠাকুরমার কথা মনে পড়ে। কত আদর করতেন সবাইকে। কী অপরাধ ছিলো এই বুড়ো মানুষটার!

গভীর রাত। সুনসান নীরবতা ভেঙে হঠাৎ দ্রুম-দ্রাম প্রচণ্ড শব্দে বাড়ির সকলেই জেগে ওঠে। বাড়ির উঠোনে জড়ো হয়। আশেপাশের কোথাও গোলাগুলি হচ্ছে। কুকুরগুলো ভয়ে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। থেমে গেছে হুতুম আর ঝিঁঝিঁর ডাক।
কিছুক্ষণ পরেই “বীরবাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা; জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে বাড়ির পাশের মেঠোপথ দিয়ে একটা ঝটিকা মিছিল কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো। বড়োরা বলাবলি করতে থাকেন- মুক্তিযোদ্ধারা আশেপাশে কোথাও অপারেশন করে ফিরে যাচ্ছে। সকালে খবর পাওয়া যায়- পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে শেরপুরে সহজেই ঢুকতে না পারে, সেজন্যেই মুক্তিযোদ্ধারা মৃগী নদীর উপর শেরীপুল গুড়িয়ে দিয়েছে।
বাড়ির কাউকে কিছু না বলে সকালে ওরা দল বেঁধে গুড়িয়ে দেয়া শেরীপুল দেখতে যায়। বর্ষা আরম্ভ না হওয়ায় নদীতে তেমন পানি নেই। শুকনো নদীর উপর মুখথুবড়ে পড়ে আছে শেরীপুল। পুলের নিচে বালিতে হাঁটতে গিয়ে নাজিমের পায়ে কিছু একটা লাগে। বালির নিচে লোহার গোলকের মতো কিছু দেখতে পায়। বালি সরিয়ে গোলকটা হাতে নেয় নাজিম। বেশ ভারী। এতে একটা আংটার মতো লাগানো।এ কটা জিনিস পেয়েছি বলতেই রুবেল, সোহেল, সোয়েব, মাশকুর, সমু, ওপেল সবাই ছুটে আসে।
সোয়েব দেখেই চিৎকার করে উঠে- খবরদার! আংটা টানিস না। এটা সম্ভবত গ্রেনেড। কার কাছে যেনো শুনেছি, আংটা খুলে নেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এটি ব্লাস্ট হয়ে লোকজন মারা যায়। মনেহয় মুক্তিযোদ্ধারা পুল উড়িয়ে দিতে এটি ব্যবহার করতে গিয়ে অবিস্ফোরিত রয়ে গেছে। এটা নিজেদের কাছে রাখা নিরাপদ নয়। পানিতে ফেলে দিয়ে চল আমরা বাড়ি ফিরে যাই।
নাজিম বলে না- আমি এটা নিয়ে যাব। নাছোড়বান্দা নাজিম গ্রেনেডটা নিয়ে গায়ের গেঞ্জি দিয়ে পেচিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
একধরনের উত্তেজনা খেলা করে যায় নাজিমের শিরা-উপশিরায়। কিছুই ভালো লাগে না ওর। ঝটিকা মিছিলের স্লোগান কানে বাজে। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা; জয় বাংলা।”
বিকেলে সবাই এসে নাজিমকে ঘিরে ধরে।
বল, ওটা কোথায় রেখেছিস? কেউ জানতে পারলে আমাদেরকে তো মারবেই, বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেবে। ওটা কোথাও ফেলে দিয়ে আসি চল। নাজিম নির্বিকার। কোনোকথা বলে না। যেনো গভীর ভাবনায় তলিয়ে আছে ও। মেঠোপথের ধারে খালপাড়ে একাএকা বসে থাকে। কখন পাকিস্তানি সৈন্যদের জীপ যাবে এ পথ দিয়ে। অপেক্ষায় থাকে। দুদিন পরেই সুযোগটা এসে যায়। গাড়ির শব্দ কানে আসতেই দেখতে পেলো- খা খা দুপুরে চারদিক ধুলোয় ঢেকে দিয়ে ছুটে আসছে আর্মির জীপ। একছুটে আমবাগান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গ্রেনেড নিয়ে খাল পারের বেতশ ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে নাজিম।
সামনের জীপটা দেখা যাচ্ছে। পেছনের জীপগুলো ধুলোর কারণে ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না। প্রথম জীপটি চলে যাওয়া মাত্র ধুলোয় ঢাকা দ্বিতীয় জীপের উপর জয় বাংলা বলে পিন খুলে গ্রেনেডটি ছুড়ে মারে নাজিম। খোলা জীপের সৈন্যদের মাঝখানে পড়ে মুহুর্তেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডটি। জীপটি পাশের নাড়াওঠা ধানক্ষেতে আছরে পড়ে। সামনের জীপটি কিছুদূর গিয়ে থেমে গেলেও পেছনের তৃতীয় জীপ থেকে আর্মিরা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো আশেপাশে এলো পাথারি গুলি ছুড়তে থাকে। নাজিম বেশিদূর যেতে পারেনি। দৌড়ে সুপারি বাগানের কাছে এসে ঢলে পড়ে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা তড়িঘড়ি হতাহত সৈন্যদের জীপে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়।
আশেপাশের লোকজন এবং বড়োদের সাথে রুবেল, সোহেল, সোয়েব, মাশকুর, সমু, ওপেল ওরাও ছুটে আসে। সুপারির বাগানের পাশে ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ নাজিমের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
পরদিন স্বাধীনবাংলা বেতারের খবরে জানা যায়- এক কিশোরের সাঁড়াশি আক্রমণে সাতজন পাকিস্তানি হায়েনা নিহত হওয়ায় সৈন্যরা সূর্যদীর ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *