ছড়া

নির্বাচিত ছড়া- লিয়ন আজাদ

সবাই যখন ঘুমিয়েছিলো পঁচাত্তরের রাতে,
— তাতে?
হঠাৎ করেই নামলো ঘাতক মধ্য-আগস্ট-প্রাতে।
ছুড়লো গুলি, উড়লো খুলি, লাল হলো খঞ্জর,
— তারপর?
রক্তে ভাসে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর।
লাশের পরে লাশের সারি রক্ত বয়ে যায়,
— হায়!
কাঁদে বাতাস, একলা পাখি নিঝুম নিরালায়।
ঘাতক হাসে অট্টহাসি, আনলো সর্বনাশ,
— ত্রাস!
এই জাতিকে আবার তারা বানায় ক্রীতদাস।
রক্তস্রোতে শিশুর লাশও যায় চলে যায় ভেসে,
— কে সে?
রাসেল নামের শিশুটিকেও মারলো অবশেষে।
শ্রাবণ শেষের রাতে ছিলো ঘোর আঁধারের চাপ,
— তাপ?
সেই শিশুটি রাসেল সোনা ছিলো যে নিষ্পাপ।
তবুও তাকে মারলো ঘাতক, হায় রে বর্বরতা,
— যথা?
বন্দি ছিলো একুশ বছর দেশের স্বাধীনতা।

আমার ধূসর আকাশটাতে মা
হাজার রঙের স্বপ্ন আঁকিস তুই
যেমন করে নকশিকাঁথার গা
দেয় সাজিয়ে লিকলিকে এক সুঁই।

অভাব যখন গিলে ফেলে ঘর
তখন মা তোর সুখপাখি নেয় ছুটি
ঘুমপাড়ানির গল্প শোনার পর
লাগত সেসব মাংস, ঝোল ও রুটি ।

রাত্রি গলে আঁধার যখন কাটে
পানি চেয়ে চ্যাঁচাই যদি খুব
চোখের জলে বুকটা মা তোর ফাটে
সেই জলেতে দেয় পিপাসা ডুব ।

মোষের মতো তেড়েই এলে মেঘ
বুকে রাখিস আগলে জুবুথুবু
চোখের দিঘি জলের কত বেগ!
বুকে মা তোর নৌকো ডুবুডুবু ।

বুকভাঙা ঝড় আসেও যদি কভু
হাসিমুখে দুঃখ করিস বরণ
কাজের চাপে ঘামিস যদি তবু
ভুলিস তখন দুঃখ-ব্যথার ক্ষরণ ।

কালচে মাদুর বিছিয়ে রাতে আসর জমায় তারা—
কাঁচাসোনা রঙ ছড়িয়ে করে পাগলপারা।
পিতলরঙা চাঁদের হাসি আলোর প্রদীপ জ্বালে,
কে হেঁটে যায় যায় না বুঝা ক্ষেতের চিকন আলে।

বুকের মাঝে জাগে নদী, সেই নদীটার নাম—
কেউ জানে না, তবু সে তো বইছে অবিশ্রাম।
নদীর কূলে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁকড়া চুলের গাছে—
হারিয়ে গিয়ে পাখপাখালি অধীর সুখে নাচে।

হঠাৎ ক’রেই ঈশানকোণে মেঘফুলেরা ফোটে,
গুডুম গুডুম গায়েবি এক বাঁশি বেজে ওঠে।
টিনের চালে টাপুরটুপুর জলের নুপূর বাজে
রঙধনু রং দেয় ছড়িয়ে নিঁখুত কারুকাজে।

মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পাহাড়, যেন আকাশ ছোঁবে,
নীল সাগরে মনের তরী ভাসে এবং ডোবে।
সেই তরীতে তুলে দিলাম ক্লেদ-কালিমা যত,
সেদিন থেকেই স্বপ্ন আমার প্রবল সমুন্নত।

দূর থেকে ওই ডাকে আমায় সূর্য-গলা রোদ,
ডাকে গহিন সন্ধ্যাতারার সিগ্ধ প্রীতিবোধ।
তখন আমার ভীষণ তাড়া, ঘরে ফেরার টান,
তবুও যেন হাতছানি দেয় দূরের পরিস্থান।

পেছন থেকে ভেসে আসে তোরাব মাঝির ডাক,
মুশলধারে ডাকে আমায় বৃষ্টিফোঁটার ঝাঁক।
ছুটে আসে জুঁই-জোনাকি ফড়িং ও গাঙচিল,
আকুল হয়ে ডাকে আমায় ওই আকাশের নীল।

সন্ধ্যা যখন আচঁড় কাটে মন-উঠোনে এসে,
থমকে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াই হেসে হেসে।
দিনমনি যেই ক্লান্ত হয়ে লুকায় নিজের মুখ,
নীলচে আকাশ কালির দোয়াত উল্টিয়ে পায় সুখ।

সন্ধ্যা কি আর চুপটি থাকে! থাকে এমন রোজ?
মিষ্টি বাতাস চুমকি ছড়ায় কেউ রাখে না খোঁজ।
দিবস এবং রাতের মাঝে সন্ধ্যা যে হয় সাঁকো,
আমি যে ভাই ব্যস্ত ভীষণ, আমায় কেন ডাকো?

পলাশতলীর মাঠ পেরিয়ে তিনপাহাড়ির বন,
আমার চোখের ঘুম ভাঙাতে জানায় আমন্ত্রণ।
পায় গতিবেগ
আমার আবেগ
করছি যতই মানা
এই হাতে নেই টগবগানো ঘোড়ার লাগামখানা।
চঞ্চলা ঢেউ বুকে তোলে নীল পিরানের নদী,
আবছা আলোর ভোর ছুড়ে দেয় রৌদ্র নিরবধি।
আমি স্বাধীন
নিজের অধীন
ছুটব বিশ্বলোকে
বিঘ্ন-বাধা ডিঙাব সব, স্বপ্ন আমার চোখে।
কে যেন পথ আগলে দাঁড়ায়, দেয় আমাকে বাধা,
সামনে সফেদ মেঘের ডানা তুলোর মতো সাদা।
মেঘের ডানায়
কানায় কানায়
এবার দেবো হানা
গুঁড়িয়ে দেবো তোমার সকল দম্ভ মুন্সিয়ানা।
আবিরমাখা লালচে আকাশ ছড়ায় আলোর বান,
নদীর বুকে নূপুর বাজায় ঢেউয়ের কলতান।
বিষন্ন রোদ
শান্ত-সুবোধ
তোমরা যখন শুধাও
দোর ভেঙেছি পাখির মতো হবই এবার উধাও।

পিঠ উঁচিয়ে শহর দাঁড়ায় মেঘ থাকে ঠিক নুয়ে,
ঘুম আসে না ঘুম আসে না চোখের পাতা ছুঁয়ে।
তিনশ’ ফিটের দীর্ঘ বুকে যাচ্ছে দুপুর হেঁটে,
লালচে মরিচ কে দিয়েছে আকাশপাড়ে বেটে?

তুলোর মতো উড়ছে ধুলো বাড়ছে মনে ক্ষয়,
বুকটা পিষে যাচ্ছে গাড়ি কোথায় হিমালয়?
জট ছাড়িয়ে ছুটছে মানুষ দলে কিংবা একা,
সমস্ত বিষ করছে হজম হারিয়ে সীমারেখা।

অট্টালিকার ফাঁকে ফাঁকে পোষা পাখির ঘুম,
হাতিরঝিলে সিজদাতে গাছ শান্ত সে নিজঝুম।
সন্ধ্যা যখন গড়িয়ে পড়ে বুড়িগঙ্গার কোলে,
ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শরীর উল্লাসে হাত তোলে।

চাঁদটা যখন উপুড় হয়ে ঝিলিক মারে চোখে—
স্বপ্ন আঁকা কিশোরটাকে কে আর বলো রোখে!
হালকা মেঘের ঘোমটা টানে আকাশরানি চাঁদ,
শান্ত কিশোর তুলছে কী শোর তার কী যে আহ্লাদ!

মনের গহীন মণিকোঠায় স্বপ্নেরা হাত বাড়ায়,
ফ্লাইওভারে পিলার যেমন বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়।
পাই জীবনে উৎসাহ আর মেট্রোরেলের গতি,
মন হয়ে যায় রঙিন ডানার মুগ্ধ প্রজাপতি।

রঙিন জীবন রঙের জগত এলিভেটেড ওয়ে,
স্বপ্ন নিয়ে ছুটছে জীবন দুরন্ত নির্ভয়ে।
সেই জীবনের গতিপথে স্বপ্ন যখন ছোটে—
কিশোর-মনেও সম্ভাবনার গোলাপ ফুটে ওঠে।

আকাশ ভরা নীলের ইজেল সবুজ ভরা মাঠ,
আম্মু বলেন আমি নাকি দুরন্ত সম্রাট।
কারো কথায় কান না দিয়ে বেড়াই হেসে খেলে,
ইচ্ছে হলেই গিয়ে উঠি কু-ঝিকঝিক রেলে।

রেলের বাড়ি চিতলমারি পাশেই বিরাট নদী,
সেই নদীতে ঢেউয়ের মিছিল যাচ্ছে নিরবধি।
সেই মিছিলে যাই হারিয়ে পায় না খুঁজে কেউ
রেলগাড়িতে বসেই আমি গুনছি নদীর টেউ।

এমনি ক’রেই সময় কাটে নদীর পাড়ে পাড়ে,
চুমকুড়ি দেয় মিষ্টি হাওয়া একলা চুপিসারে।
ভালো লাগার আবেশ এসে উদাস করে মন,
বুকে তখন বাজে আমার শান্তি অকিঞ্চন।

দুপুর যখন রোদের জরি গা’য় মাখিয়ে হাসে,
মেঘ যেন ঠিক হাঁসের মতো স্বচ্ছজলে ভাসে।
ভাবসাগরে যাই হারিয়ে শুনে নদীর গান,
চতুর্দিকে ফেরেশতারা ছড়ায় আলোর বান।

সূর্য তখন লালের আভায় ডুবছে ধীরে ধীরে,
মায়ের ছেলে আবার আমি ঘরেই আসি ফিরে।

কাঁকনির ঐ বিল পেরিয়ে হারিয়ে যাবো দূরে,
যেমন ক’রে হারায় পাখি নীলের সমুদ্দুরে।
পুবের হাওয়া গায়ে মেখে ছুটবো আপন মনে,
ক্লান্ত হ’লে জিরিয়ে নেবো ডাব-সুপারির বনে।
বনবাদাড়ে ঘুরে-ফিরে খুঁজবো পাখির ছানা,
আড়াল হয়ে দেখবো তাদের, ভাঙবো বাসা? না না।

আমি হবো মুক্ত স্বাধীন, লাটাই ছেঁড়া ঘুড়ি,
ইচ্ছেমতো এদিক-সেদিক করবো ওড়াউড়ি।
আগুনপাখি রোদের ডানা যেই গুটিয়ে নেবে—
কোথায় গেল, কই হারালো! উদাস হবো, ভেবে।
ডাকবে তখন চাঁদের পিদিম—মোমের জ্যোৎস্নাধারা,
পথ হারাবো, পথ দেখাবে
ইলশেগুঁড়ি তারা।

ঠিক তখনই আসবে ভেসে মায়ের রাগীস্বরে—
‘রাত হয়েছে, কই রে খোকা? নেই কেন তুই ঘরে!’

চর জাগানো একটা নদী পুষি বুকের মাঝে,
মন বিষিয়ে গেলে হঠাৎ উথলে ওঠে তা যে।
চোখ নিভিয়ে বসে আছি তারই শীতল কূলে,
জাগতিক যা দুঃখ আছে গেলাম সেসব ভুলে।

দুপাড়ে তার কাশের শোভা, প্রাণে জাগায় দোলা,
স্বচ্ছ বুকের মাঝে যেন মেঘের কলস তোলা।
পথভোলা এক বাতাস এসে ঢেউ খেলে যায় বাঁকে
মনের শালিক নেমে তখন জলের গুড়ো মাখে।

আলোর ছানা খেলছে এসে পদ্মপাতার বুকে,
জলপিপিরা ডানা ভেজায় শাপলা ফোটার সুখে।
নিঃসঙ্গ এক তালগাছেতে বাবুই বোনে বাসা,
ঘাসগালিচায় শিশির যেমন বিছিয়ে রাখে আশা।

মেঘের দলা সরিয়ে দিয়ে সূয্যটা দেয় উঁকি,
যেভাবে ঠিক জানলা খুলে তাকিয়ে থাকে খুকি।
খুকির কথা ভাবতে গিয়ে বোনকে মনে পড়ে,
কদিন ধ’রে খেলছে না সে ভুগছে ভীষণ জ্বরে।

তাই তো আমার মন ভালো নেই, মন বিষিয়ে আছে,
দুঃখ ভোলার জন্য এলাম পোষা নদীর কাছে।

স্তব্ধ আকাশ, নিথর বাতাস, আটকে আছে শ্বাস,
সিঁড়ির উপর গড়িয়ে পড়ে জাতির পিতার লাশ।

বিশ্বাসীরা কেউ আসেনি, তাই ঘাতকের তেজ,
আস্থাভাজন সব প্রিয়জন গোটায় তাদের লেজ!

অরক্ষিত লাশের ওপর কেউ টানেনি চাদর,
খুব নীরবে বাতাস এসে দেয় বুলিয়ে আদর।
মধ্য আগস্ট গভীর রাতে হামলে পড়ে দানব,
টুঙ্গিপাড়ার নিঝুম গাঁয়ে ঘুমায় মহামানব।

পিতা তোমার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দিলাম ঢেলে,
প্রতিরোধে ব্যর্থ ছিলাম আমরা তোমার ছেলে।

অক্ষমতার সেই যাতনায় আজও সবাই জ্বলি,
জনক তোমার আদর্শকে দিইনি জলাঞ্জলি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *