নির্বাচিত ছড়া -হিমাদ্রি হাবীব
পেলে
আহারে পেলে! আহারে পেলে! সোনার টুকরো ছেলে,
ভাগ্যহারাকে উৎসাহ দিতে অবতার হয়ে এলে।
ডাকনাম ‘ডিকো’ সোনার ছেলের বস্তি পাড়ায় বাস,
তোমার মৃত্যু ইতিহাস বইয়ে ‘নতুন সর্বনাশ’।
হাঁটুর ব্যথায় খেলোয়াড় বাবা হয়েছিল সুইপার,
ভাঙাচোরা ঘরে ঘুম পাড়ো তুমি, তবু তুমি অবতার।
পাড়ার ছেলেরা ব্যঙ্গ করেই নাম দিয়েছিল ‘পেলে’
সেলাই-পালিশ করেছিলে জুতো, ঝাড়ু দিয়েছিলে রেলে।
কাজ করেছিলে চায়ের দোকানে, ফুটবল ছিলো না যে!
তোমার ছবিটা লুকিয়ে রেখেছি আমার মনের ভাঁজে।
মোজার ভিতরে কাগজ ঢুকিয়ে ফুটবল বানাবে না?
হ্যাংলা মুখের কিশোর ছেলেটা সকলের চিরচেনা।
তোমার ছিলো না নতুন জামা, চড়োনিকো সাইকেলে
বস্তি পাড়ায় লুকিয়ে ছিলে আহারে সোনার ছেলে!
আহারে কৃষ্ণ! আহারে গরীব! বস্তির ছেলে সেরা
কী করে এতই ফুটবল পারে দরিদ্র মানুষেরা!
খুঁজবো কোথায় এমন ছেলেকে! আহারে আমার পেলে!
ফুটবলে তুমি নতুন রূপেই সুধা দিয়েছিলে ঢেলে।
তোমার কীর্তি মানুষেরা জানে; আমি আর বলবো না
তোমার বুকেই ঘুমিয়ে থাকবে মেসি আর মারাদোনা।
এই পৃথিবীর মনটা খারাপ, আহারে মহান পেলে!
স্বর্গের বুকে বেড়াইও তুমি প্রিয় ফুটবল খেলে।
শুভ নববর্ষ
হাতি নাচে, ঘোড়া ওড়ে; সম্প্রীতি ওঠে গড়ে
বকুলতলার মোড়ে কাগজের মাছ সাঁতারায়,
বাঘ মামা ওঠে কোলে, রঙ মেখে পেঁচা দোলে-
মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
বলীখেলা, ঘুড়ি তোলা, পুতুলের চুল খোলা
সার্কাসে লেজঝোলা খেতে থাকে কোকা কোলা,
ঢুলিদের কাছে কাছে, ঢাক নাচে ঢোল নাচে
রঙ ফোটে ফুল গাছে শিল্পীত ক্যানভাসে,
আলপনা আঁকা আছে শহরের পাকা রাস্তায়;
পান্তা-ইলিশ আহা আসে নাস্তায়।
বৈশাখী গান ধরো, জামা পরো, জুতো পরো
আব্বু, মেলায় চলো; কেন এত দেরি করো?
লাল ফিতে, সরু চুড়ি, কিনে দেবে গুড়মুড়ি
কিনে দেবে ঢোলগাড়ি, লাটিম আর বল-
আনন্দ এই মনে দিল মিসকল।
ছায়ানট কাছাকাছি, ‘ভালো থেকো, ভালো আছি’
আহা! নববর্ষতে শুভ কামনার কথা, রঙমাখা গাল-
রমনায় সেজে আসে নতুন সকাল।
হাসপাতাল কি সুস্থ?
মৃত্যুটা যদি জানতো-
শোক সংবাদ সইতে সইতে পৃথিবী বড়ই ক্লান্ত!
সন্তান বওয়া অসহায় কাঁধ পিতার
সাঁঝবাতি-জ্বলা সজ্জিত রূপ কবর অথবা চিতার।
রবীন্দ্র আর নজরুল কেঁদে মর্মর
তাঁদের ছেলেরা, মেয়েরাও মরে? মৃত্যু বড়ই বর্বর!
পাখিরাও মরে, পাখিরাও কাঁদে; নদী মরে যায় নিত্য
হাউমাউ করে পশুরাও কাঁদে, দেখছি মৃত্যু-নৃত্য।
মৃত্যু! মৃত্যু! হোলি উৎসব! ললাটের ভাঁজে চিন্তা
মলাটের মতো গায়ে জড়িয়ে রাখতেছি প্রতিদিন তা!
মৃত্যুর সাথে খাচ্ছি-দাচ্ছি, মৃত্যুর সাথে থাকছি
হয়তো শত্রু মৃত্যুর ফুল পকেটে কুড়িয়ে রাখছি!
মৃত্যু দেখছি, মৃত্যু শুঁকছি, মৃত্যুকে রোজ চিনছি
তুলতুলে গালে মৃত্যু আঁকছে লিওনার্দো ভিঞ্চি।
কোটি কোটি লাশ পৃথিবীর কাঁধে
শহিদ জননী জাহানারা কাঁদে
এমনি করেই কেঁদেছিল কবি, গায়ক রজনীকান্ত;
মৃত্যুটা যদি জানতো!
মৃত্যু নিজেই মৃত্যুকে দেখে দুই চোখে পানি আনতো।
শোক সংবাদ সইতে সইতে দুপুর জুড়িয়ে ঠান্ডা
রাত নিভে যায় মধ্যরাতেই ডুকরে কাঁদলে প্রাণটা।
বুদ্ধিদীপ্ত শিশুগণ যদি বেশি দিন বেঁচে থাকতো!
স্বর্গ-দেবতা ক’টা দিন যদি মৃত্যুকে বেঁধে রাখতো!
কবিতা-ফবিতা টিকবে না অত মৃত্যু যতটা টিকবে
ভিখারি মরলে কোন লোককবি মর্সিয়া গীতি লিখবে?
দুলালি মরছে, দালাল মরছে, মরছে দুখিনী-দুস্থ
হাসপাতাল কি মৃত্যু ঠেকায়? হাসপাতাল কি সুস্থ?
আহারে মৃত্যু! ঠিকানা কোথায়? কোথা গ্রাম, কোন থানা?
মৃত্যু কি আজ ফিলিস্তিনেই গেঁড়েছিস আস্তানা?
মৃত্যুটা কবে মরবে?
মৃত্যু মরলে ‘জীবন’ একলা বসে বসে কী করবে!
ছবি
ভোরবেলা তুতুলের ভেঙে যায় ঘুম
ঘুমভাঙা মুখখানা মাছুম মাছুম।
আড়মোড়া দিয়ে যেই তোলে এক হাই
তক্ষুনি ঘুম বলে, আজ গুডবাই।
দুচোখের ক্যামেরায়
দৃশ্যরা ভরে যায়,
ফকফকা আলোতেই ছবি হয় জুম,
আকাশের চাঁদোয়ায় লাল কুমকুম।
তুলতুলে ফুলকলি জেগে ওঠে ঐ,
তার সাথে পাতা নাচে তাতা-থৈথৈ।
পাখির রেওয়াজ চলে গাছের ডালে
ভেসে যায় কলতান হাওয়ার তালে।
ছাদের বাগান জুড়ে
রোদ আসে পাতা ফুঁড়ে,
বাতাসের মল বাজে রুমঝুম ঝুম-
গাছেদের ছায়া খেলে কাটুম-কুটুম।
ঝাঁকে-ঝাঁক বক মেলে ইচ্ছেডানা
আকাশের গায় খোঁজে নীল সীমানা।
ভোর দেখে তুতুলের ভরে যায় মন
খাতায় রঙিন ছবি করে অঙ্কন।
গ্রীষ্মের রবি দাদু
বর্ষায় করে যাদু-
মেঘের কাঁথায় দেয় নাকডাকা ঘুম
শীতকালে সূর্যটা ডিমের কুসুম।
প্রজাপতি
আমি মিষ্টি প্রজাপতি,
আমার শান্ত মতিগতি।
আমি নরম-মোলায়েম
আমি আনন্দ ও প্রেম।
আমার আলপনারই ডানা
রঙের নেই কোনো সীমানা।
আমায় দেখবে তুমি যত-
আমি স্বপ্ন-পরীর মতো।
আমার দশ খণ্ডের দেহ
সেটা ভাবতে পারো কেহ।
আমি মৌ দেখে উন্মাদ,
আমার মনটাও নিখাদ।
আমি ফুলে ফুলে ঘুরি
আমার নেইকো বাহাদুরি।
জানো কেউ কি এ সংবাদ?
আমি পা দিয়ে নিই স্বাদ।
কোনো সিক্ত কাদা থেকে
আমি পানি করি পান,
আমার চার পর্বে জীবন-
যেন চারটা কলির গান।
আমার বারো হাজার চোখ
শুনে আঁৎকে ওঠে লোক।
আমি প্রথম ছিলাম ডিম
যেন থমথমে পিদিম।
পরে হলাম শুঁয়োপোকা
তখন নাদুস-নুদুস বোকা।
আরও পাল্টে গেল দেহ-
সেটা ‘পিউপা’ বলে কেহ।
পরে হলাম রূপবতী
সেটা দারুণ প্রজাপতি।
আরও ছয় ঘণ্টা ধরে
ওড়ার করেছি চেষ্টা,
আমার চর্চা করার ফলে
পেল সাফল্য শেষটা।
তাতে লাগলো সময় বেশি-
তবু নেইতো আমার ক্ষতি!
আমার অধ্যবসায় গুণে-
আমি দারুণ গুণবতী।
বলির পাঁঠা
বড় কবি হতে হতে হয়ে উঠছি না
সহমত! ঠিক ঠিক! স্যার স্যার! জি না!
ব্যাকরণ পড়ে আমি ব্যা-করণবাসী
গলায় আঁটকে আছে প্রচলিত ফাঁসি।
খোঁটায় লটকে থেকে ঘাস খাই মাঠে
কারা কারা ব্যা-ব্যা পারো এই তল্লাটে?
এ মাঠের ম্যাগাজিনে আমি ঘাসচাটা
গিলে ফেলি স্বরে-আটা, ছড়াগোল্লাটা!
‘সব ভাষা বদলাবে’ লেখা ব্যাকরণে-
(পুঁথিগত কথাটুকু পড়ি মনে মনে);
বাদবাকি সব লেখা পড়া হয় জোরে
হাই তুলে ছড়া পড়ি ভোরের খবরে।
‘আইন মানে না ভাষা’ ব্যাকরণে লেখা-
(না দেখার মতো করে এ লাইন দেখা।)
“ভিনদেশী ছড়া লেখা কোন বৃত্ততে?”
বলির পাঁঠারা চুপ ব্যাকরণ-স্রোতে।
তাই বড় হতে চেয়ে ছোট কবি হই
ভাষাকে খাঁচায় ভরে মহা হইচই!
তানা-নানা, ফুল-পাতা; পেট ড্যাবড্যাবা
সহমত! সহ-মদ! জি হুজুর! ব্যা ব্যা!
হেমন্তের শহর
হেমন্ত যে কী!
মাউস দিয়ে হেমন্তের এক শহর এঁকেছি।
সেই শহরে তুষার ওড়ে,
পিঠার দোকান মোড়ে মোড়ে,
রিক্সা গাড়ির হুডের উপর শিশির দেখেছি।
সকাল-বিকাল হাওয়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় রোদ,
রাতের বেলা নকশা-আঁকা কম্বলে আমোদ।
গ্রাম থেকে কিনে আনা
খেজুর গুড়ের মিহিদানা-
একটি বছর পরে আবার একটু নিলাম স্বাদ;
চারুকলার বকুলতলায় তোকেই আশীর্বাদ।
হঠাৎ যদি ঠান্ডা খেয়ে বরফ হয়ে যাই!
লিস্টি থেকে আইসক্রিম বাদ দিয়েছি তাই।
বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আজ নবান্ন উৎসব,
শিক্ষার্থীর মনন-জুড়ে মিষ্টি অনুভব।
শীতের দেয়াল ভেঙেচুরে
সব মার্কেট ঘুরে ঘুরে
আতপ চালের প্যাকেটগুলোর ভাঙলো হঠাৎ ঘুম-
হেমন্তকাল নিয়ে এল নবান্ন-কুটুম।
ওরে আমার কুসুম-গরম হেমন্ত লক্ষ্মী,
তুই যে নরম রঙিন-ডানার অতিথি পক্ষী।
ছাদের উপর শান্ত আলো ছাইরঙা-সন্ধ্যায়,
হিমেল হাওয়ায় পাঞ্জাবিটা ঠান্ডা হয়ে যায়।
ল্যাম্পোস্টের পায়ের কাছে
একটা ছোট বন্ধু আছে-
উলের কাপড় বেচতে গিয়ে ঢুলছে রাতে চোখ-
হেমন্তের এই ছবি নিয়ে বইয়ের কভার হোক।
বাঘ ও ভূত
একটা ভূতের ছা
টিঙটিঙে দুই পা
বাঘকে দেখে ভূত বললো
‘পারলে আমায় খা।’
বাঘ বললো ধুস!
তুই কোনো মানুষ?
তোর কি আছে মাংস-মগজ,
কলিজা, ফুসফুস?
ভূত বললো থাম!
সাহসটা দেখলাম।
ভূত ধরতে ভয় পাবি তুই
আগেই তা জানতাম।
বাঘ বললো ইশ!
বড্ড বকেছিস!
নাদুস-নুদুস স্বাস্থ্য হলে
তখন দাওয়াত দিস।
ছায়া
চোখ দুটি দূরবীন, মাথা হলো সংসদ, মন হলো মানুষের আয়না
রাগ করে, লোভ করে, হুট করে কক্ষনো ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না!
সেলুলয়েডের ফিতা মুছে দেওয়া যেতে পারে, উইপোকা খেতে পারে পাঠ্য
সময়ের শিলালিপি ঘটনাকে মেলে ধরে; অক্ষত এবং অকাট্য!
ইতিহাস শুধু এক বর্গীর ছড়া নয়, শিশুদের জেরি আর টম না
সিরাজুদ্দৌলার ইতিহাস মুছে দিতে চেষ্টা তো হয়েছিল কম না!
অলিখিত বর্ণনা হাত ধরে জেগে ওঠে, ভেসে ওঠে প্রস্তরখণ্ড
মানুষের ছায়া ঠিক মানুষের পিছু ঘোরে; গলার সাথেই গলগণ্ড!
রীতিমতো বায়ান্ন, স্বাধীনতা বেঁচে ওঠে; নয় ওটা চর্ব্য ও চোষ্য
ধামাচাপা দিয়ে রেখে রোদ ঢাকা যাবে নাকি? ইতিহাস কার থাকে পোষ্য!
আমার মতো
ঘরের চালে মাইক দিয়ে যতই ছাড়ো হাঁক
সংঘবদ্ধ কাক-
আমার দেহের সংস্কৃতি আমার মতোই থাক!
আমার বুকে পাখি থাকুক, পাখির ডাকাডাকি থাকুক
বোধের পাকাপাকি থাকুক, চোখের তাকাতাকি থাকুক
মনের ভিতর অট্ট-হাসুক নদী এবং নদ
খেলাচ্ছালে স্বপ্ন আঁকুক মিঠেল প্রচ্ছদ।
আমার ঠোঁটে বাঁশি থাকুক; বাঁশির ঠোঁটে গান-
চোখের ভাষায় রচিত হোক সুখের উপাখ্যান।
আমার চুলে বসন্ত থাক সমস্ত মৌসুম;
চোখের পাড়ায় দৌড়ে আসুক নিরপেক্ষ ঘুম।
আমার কিছু আশা থাকুক, আশাগুলোর ভাষা থাকুক
ভাষাগুলোর বাসা থাকুক গঙ্গানদীর চর-
আমার ভিতর গড়ে উঠুক শিশুর ঠাকুরঘর।