শিশুসাহিত্য

শিশুসাহিত্যিক রাইদাহ গালিবা স্মরণ সংখ্যা

রাইদাহ : একটি উজ্জ্বল প্রতিভা।। অসীম সাহা

রাইদাহ শুধু একটি নাম নয়। বিকাশমান একটি উজ্জ্বল প্রতিভা। মাত্র বারো বছরের জীবনে সে লেখালেখির জগতে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতে শুরু করেছিল। কিন্তু অর্থলোভী চিকিৎসক নামক এক পিশাচের লোভের শিকার হয়ে ভুল চিকিৎসায় এই শিশু প্রতিভাটি পৃথিবীর মাটি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় অনেক আশা নিয়ে পিতা-মাতা রাজধানীর একটি নামকরা ক্লিনিকে শুরুতেই তাকে ভর্তি করেছিল। কিন্তু চিকিৎসকের লোভের কাছে পরাজিত হয়ে এই বারো বছর বয়সী শিশুসাহিত্যিকের অকালমৃত্যু ঘটে। তার মা দেশের একজন উল্লেখযোগ্য কবি ও কথাসাহিত্যিক ,তারপরও সে তার মেয়ের সঠিক চিকিৎসা পায়নি এবং চিকিৎসকের চিকিৎসায় অবহেলা ও গাফিলতিতে তার মেয়েকে হারিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার উপায় নেই। ডাক্তার এবং ক্লিনিকের মালিক অনেক শক্তিধর। তাই এতো জঘন্য অপরাধ করা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কর্ধে;ও সন্তানের পিতামাতা এখনও ন্যায়বিচার পায়নি। দুর্বৃত্তদের শাস্তি হয়নি। সন্তানকে হারিয়ে পিতা-মাতা শোকস্তব্ধ। বুকে পাথর বেঁধে পিশাচ চিকিৎসকের উপযুক্ত শাস্তির প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছে। তারা তাদের সন্তানকে আর কোনোদিন ফিরে পাবে না। তাই বারো বছরের রাইদাহর উজ্জ্বল কর্মকাণ্ডের স্মৃতিচিহ্নগুলো বুকে ধারণ করে তাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে।


শিশু বয়স থেকেই রাইদাহ মুখে মুখে গল্প বলতো। এই বলাটা সম্পূর্ণরূপে তার আত্মমগ্ন অনুভবের বহিঃপ্রকাশ ছিল। সে কোনো বইপাঠ করে সেই গল্প বলতো না। এগুলোর ছিল তার স্বকল্পিত। শৈশব থেকেই সে লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত ছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। বারো বছর বয়সের মধ্যেই তার ছোটদের জন্য চারটি বই প্রকাশ পেয়েছিল। দেশের খ্যাতনামা পত্রিকাসমূহে যে বয়সে তার লেখা ছাপা হতে থাকে, তখন থেকেই পাঠক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করে এক শিশুপ্রতিভাকে। তখন থেকে প্রকাশকরাও আগ্রহের সঙ্গে তার কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়ে প্রকাশ করতে থাকেন। একজন শিশুপ্রতিভার জন্য এ এক বিরল সম্মান ও দুর্লভপ্রাপ্তি।
তার এই বিস্ময়কর প্রতিভার কারণে তার মা সহ সকলেই তাকে ‘কুইন‘ বলে ডাকতো। সত্যিই সে কুইন ছিল। গল্পের কুইন। মৃত্যুর আগেও সে তার মাকে বলেছিল, তার মাথায় অনেকগুলো গল্পের প্লট ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু পিতা-মাতা তো বোঝেননি, তাদের আদরের ধন এতো দ্রুত তাদের ছেড়ে চলে যাবে! আর রাইদাহও জীবনে কোনোদিন তার প্লটগুলো প্রকাশ করে যেতে পারবে না। ২০২৩-এর একুশে বইমেলায় রাইদারর ‘ভয়ংকর গাছ’ নামে একটি রূপকথার গল্পের বই প্রকাশ পেয়েছিল। গল্পটিতে সে যে ভয়ংকর গাছের কথা বলেছে, সেই গাছের কাছে গেলেই প্রাণসংহার হয়। গাছটি প্রতীকী। তবে কি রাইদাহ বুঝতে পেরেছিল, গাছের মতো ভয়ংকর এক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তারও জীবনসংহার হবে?
সেই জীবনসংহারই তার সৃষ্টির প্রকাশিত রূপকে তাকে দেখে যেতে দেয়নি! বেদনার কথা, বইটির বানান ও প্রুফ দেখার চূড়ান্ত পর্যায়ের দিনটিতেই রাইদাহর জীবনদীপ নিভে গেছে। এই বেদনার ভার বইবার শক্তি তার পিতা-মাতা ও নিকটজনের তো নেইই, এমনকি তার যারা শুভ্যানুধায়ী, তাদেরও শোকবিহ্বল করে দিয়েছে।
রাইদাহর মৃত্যুতে তার পিতা-মাতাকে সান্ত¡না দেবার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু শোকস্তব্ধ হৃদয়ে প্রত্যাশা করি, তার লেখাগুলো যেন শিশুকিশোররা পড়ার সুযোগ পায়; তার বই যেন সংরক্ষিত হয় আমাদের লাইব্রেরি ও পাঠাগারগুলোতে। আর প্রত্যাশা করি, যে লোভী ডাক্তার
রাইদাহকে চিকিৎসায় অবহেলা ও গাফিলতি করে হত্যা করেছে, তার যেন বিচার হয়!

অবাক শিশু─ রাইদাহ গালিবা।। খায়রুল আলম সবুজ

গাজার কোনো এক হাসপাতালের বেডে একটি শিশু মুখে ও বুকে তার ছোট্ট শরীরের লাল রক্ত নিয়ে কাঁদছে। আড়াই তিন বছরের একটি মেয়ে শিশু। একবার ছবিটার দিকে চোখ পড়েছে, দ্বিতীয়বার যে তাকাবো মানসিক সে শক্তি আমার ছিল না। তবু ফিরে দেখলামÑ রক্তে ভেজা শিশুটিকে- আবার। অন্তর জগতে আমার কী হলো তা আর কাউকে বোঝানো যাবে না। দুটি চোখে তার অপার বিস্ময় ও কান্না, কান্নাটা এখন থেমে আছে। রক্তমাখা মুখখানা যেন অমীমাংসিত একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন- কেন? কী করেছি আমি? স্থির ছবিটির মধ্যে এই প্রশ্নের প্রতিবাদী চিৎকারটা স্পষ্ট শোনা যায়। যে কেউ ছবিটি দেখলেই চিৎকারের শব্দটা শুনতে পাবে। কেন? কী করেছি আমি? এটা এক কঠিন, জটিল এবং সকল বিচারে ন্যায্য প্রশ্ন। অপরাধ না করলে তো শাস্তির বিধান নাই। তাহলে? তাহলে কেন এই রক্তস্নান, ব্যথা বেদনা অসহ্য যন্ত্রনা – সুস্থ দেহে মৃত্যু?? রাইদাহ গালিবা বারো বছরের ফুটফুটে মেয়ে। বাড়ন্ত সে- শরীরে এবং বোধে। তার বয়সের অনেক অনেক মেয়ে থেকে পলকেই তাকে আলাদা করা যায়। তার বেশির ভাগ বন্ধু যা করে তা সে করে না। তার কাজ এবং কাজের ধারাই বলে দেয় সে একটু অন্য ধরনের। ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী রাইদাহ গালিবা। সে গল্প পড়ে এবং গল্প লেখে। তার মা কবি ও গল্পকার। পরিবারের অন্যরাও বোধসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ। এমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে বলেই রাইদাহর শিশু মন কল্পনার বর্ণিল জগতে ঘুরে বেড়ায়। চারপাশের মানুষ সে দেখে নিজের মতো করে এবং মানুষেরা যে-সমাজে বসবাস করে সে-সমাজও সে নিজের মতো করে দেখে, কতকটা চেনেও। এই সব মানুষ নিয়েই সে তার গল্প সাজায়। পিটু ছেলেটা দরিদ্র কিন্তু তার জুতা পরার ইচ্ছা হয়। মাকে বললে মা তাকে পোষা পাখি বিক্রি করে জুতা কিনতে বলে। পিটু বাজারে পাখি বেচতে যায় এবং পাখির বিনিময়ে এক জোড়া যাদুর জুতা পায়। এই জুতা পরে পিটু যা চাইবে তাই পাবে। সুতরাং পিটুর টাকা পয়সা পেতে আর দেরী হয় না। এজন্য তাকে কোনো পরিশ্রমও করতে হয় না, জুতা পায়ে গলিয়ে শুধু চাইতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা পূরণ।

‘ধনী হয়ে পিটু গরিব মানুষদের হিংসা করতে শুরু করলো। তাদের দেখলে সে ভ্যাঙাতো।’

ধনী হয়ে পিটুর চরিত্র পাল্টে গেল। এর কিছু দিন পর পিটু জুতাকে তার জন্য একগাছি সোনার চেইন আনতে বললো কিন্তু জুতা তার কথা শুনলো না। পিটু রেগে জুতাকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেবে বললো, সে কথা শুনে জুতা বললো, তুমি ধনী হয়ে গরিবদের ভ্যাঙাচ্ছো… তুমি আর

আমার কাছ থেকে কিছু পাবে না পিটু।’ এমন কথা

বলার জন্যই মূলত: পিটুর গল্পের জন্ম প্রায় আট বছর বয়সের মানুষের এমন বোধ এবং এই নিয়ে গল্প লেখা; চরিত্র সৃষ্টি করে তাদের মুখে নিজের মনেরকথা বসিয়ে দেয়া মোটেও হাল্ধসঢ়;কা ব্যাপার নয় বরং এমন কাজ বিরল গুণের আভাস দেয়─ এ বয়সেই ন্যায় অন্যায়

বুঝে ফেলা, পক্ষ নেয়া ন্যায়ের।

‘পিটুর যাদু জুতা’ কিশোর গ্রন্থ হিসাবে

বেরিয়েছিল ২০২০ সালে, দেশে তখন করোনা চলছে। এরপর

২০২১ সালে এক যে ছিল মুচি’, ২০২২ সালে ইমা ও

দৈত্য’ এবং ‘ভয়ঙ্কর গাছ’ বেরিয়েছে ২০২৩ সালে।

এছাড়াও আরো একখানা লেখা হয়েছিল, নাম তার

‘আন্ডোরে রাজ্যের কথা’। এখনো তা গ্রন্থাকারে বের হয়নি। একটি বইয়ে শিশু কিশোরদের জন্য একটি করে গল্প। গল্পের মানুষেরা আমাদের চারপাশের মানুষদের মতো। কিন্তু গল্প পড়লে মনে হয় এরা অনেকটাই রূপকথার মানুষদের মতো চলে, ফেরে, কথা বলে। তার গল্পে প্রাণীরা ঈশপের গল্পের প্রাণীদের মতো মানুষের ভাষায় কথা বলে। অন্য প্রাণীর মুখে মানুষের ভাষা না বসালে তাদের মনের কথা বোঝার তো আর কোনো উপায় নেই। সে কারণেই রাইদাহ গালিবার ঘোড়া কথা

বলে, বানর কথা বলে, পিপড়ে, হাঁস, দৈত্য সবাই কথা বলে। মানুষের সঙ্গে তারা মানুষের ভাষায় কথা বলে আর তাতেই ঝিলিমিলি আনন্দে জীবন্ত হয়ে ওঠে রাইদাহর কল্পনার জগৎ। এমন সন্তানের জন্য গর্বে বুক ভরে ওঠে বাবা মা পরিবার পরিজনের। কিন্তু কি অনিশ্চিত মানুষের জীবন, জগৎ! আলো ঝলমলে উজ্জ্বল দিন কেমন অনায়াসে ঘিরে ফেলে অবাঞ্ছিত অন্ধকার! সুস্থ মেয়ে রাইদাহ গালিবার জ্বর হলো। ডেঙ্গুজ্বর। তাকে ডাক সাইটে হাসপাতালে শুরুতেই ভর্তি করা হলো।

চিকিৎসা চললো, কিন্তু মনের সুখে কল্পনার বর্ণিল জগৎ গড়ছিলো যে রাইদাহ গালিবা সে আর ঘরে ফিরে এলো না- আসবেও না কোনোদিন। কিন্তু কেন? অপরাধ না থাকলে শাস্তির বিধান নেই, আর যদি থাকে?

সে ক্ষেত্রে গাজার শিশুটির মতো কেউ একজন তো বলবেই

–কেন, কী করেছি আমি?

খায়রুল আলম সবুজ
বিশিষ্ট নাট্যজন ও বাংলা একাডেমী পদকপ্রাপ্ত লেখক

ক্ষুদে লেখকবন্ধু রাইদাহ গালিবাকে ভুলব না কখনো অদ্বৈত মারুত

‘সন্তান হারানোর জ্বালা, তোমরা কি করে বুঝবে?/ তোমাদের কি পায়ের তলার মাটি সরে গেছে?/ যে চোখ দুটো দিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখ,/ সে দুটো তো এখনও অন্ধ হয়ে যায় নি,/ তিল তিল করে যেগুলো সঞ্চয় করেছ,/ সেগুলো তো কর্পূরের মতো এখনও উবে যায় নি,/ তোমাদের ঘরের ছাদ, দেওয়াল, এগুলো/ এখনও তো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েনি।’ সন্তান হারানোর এই জ্বালা বুঝেছিলেন কবি সুবীর ভট্টাচার্য্য আর এখন হৃদয় দিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন কথাসাহিত্যিক, কবি কানিজ পারিজাত! মাত্র বারো বছরের বিরলপ্রজ ও ক্ষণজন্মা রাইদাহ গালিবাকে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন চিকিৎসকের চরম অবহেলায়। মৃত্যু অমোঘ সত্য কিন্তু অবহেলায় মৃত্যু কীভাবে মেনে নেবেন মা; যদি স্পষ্টত সন্তানটির ভেতরে দেখতে পান অমিত সম্ভাবনার শক্তি? যার অবহেলায় প্রাণ দিতে হলো ছোট্ট শিশুটিকে, তার কি কঠিন শাস্তি হবে না? রাইদাহর ডাক নাম ছিল কুইন। তারা ছিল দুই ভাইবোন। রাইদাহ ছিল বড়। কুইন রাজরানী হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল। জন্মেই সে ঘর আলোকিত করেছিল। এক-দুই করে তার বয়স যত বাড়তে থাকে, তেমনি বড় হতে থাকে শারীরিক কাঠামোয়। দুই-তিন বছরের শিশুর দৈহিক গড়নে যতটুকু বড় হওয়ার কথা, রাইদাহ বাড়তে থাকে তার দ্বিগুণ হয়ে। দৈহিক গড়নের সঙ্গে বড় হতে থাকে তার ছোট্ট মনটিও। দৈহিক গড়ন আর বাড়ন্ত মনের রসায়নের খবরটি কেবল একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কানিজ পারিজাত, রাইদাহর মা। কন্যাকে নিয়ে তাই তার মনে তৈরি হয়েছিল বিপুল আশা। রাইদাহ মায়ের বেঁচে থাকার প্রাণসঞ্চারি হয়ে উঠতেছিল। ভবিষ্যতের নির্ভরযোগ্য অবলম্বনও ভাবতে শুরু করেছিলেন মা কানিজ পারিজাত। ছোট্ট রাইদাহ মুখে মুখে গল্প বলত। তার মুখে সৃষ্টি করা গল্প সে সবাইকে শুনিয়ে বেড়াতে লাগলো, কিছুদিন পার হবার পর মা খেয়াল করলেন রাইদাহর মুখে বলা গল্পগুলো আসলে পরিপূর্ণ রূপকথার গল্প হয়ে উঠেছে । এভাবেই মেয়ের মধ্যে গল্পকারসত্ত্বা খুঁজে পান কানিজ পারিজাত। অত্তটুকুন রাইদাহ গণিত, বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ও ভালোবাসতে শুরু করেছিল। তার জানার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। দ্রুত আত্মস্থ করতে পারত। মুখস্থবিদ্যা তার ছিল একদম অপছন্দ। যা পড়ত, বুঝেশুনে পড়ত। ফলে মুখস্থের প্রয়োজন হতো না। রাইদাহ প্রকৃতিকে ভালোবাসত। ক্ষুদ্র প্রাণীর মৃত্যুও সে সহ্য করতে পারত না। অথচ প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস! তার ছোট্ট প্রাণটাই খেলো হয়ে গেল? মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে নেওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল ছোট্ট মেয়েটির। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নিজের শ্রেণির পড়া শেষ করে ওপর ক্লাসের বইপাঠ নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অন্য শিশুদের থেকে সে ছিল অগ্রসর; যেমন পঠনপাঠে, তেমনি সৃজনে ও মননে। যেমন ছিল শান্ত, তেমনি ধীরস্থির।

এত্তটুকুন বয়সেই দেশের নামকরা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় রাইদাহ গালিবার অনেকগুলো গল্প ও ছড়া-কবিতা। ছয় বছর বয়সে তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমির শিশু-কিশোরদের জন্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশ’-এ। গল্পটির নাম ‘বাঘ ও দৈত্য’। একাধিক গল্প প্রকাশ পায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকায়। পরে প্রতিটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় আলাদা আলাদা গল্পবই। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো হলো- ‘পিটুর জাদু জুতা’, ‘এক যে ছিল মুচি’, ‘ইমা ও দৈত্য’। রাইদাহর চতুর্থ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের কথা ছিল ২০২৩ সালের বইমেলায়। ধুন্ধমার প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু তার আগেই অকালে ঝরে গেল এই তরতাজা প্রাণ! আর নেওয়া হলো না তার নতুন বইয়ের ঘ্রাণ! রাইদাহ পড়ত ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে, পঞ্চম শ্রেণিতে। ২০২২ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। হঠাৎ জ্বর এলো রাইদাহর। শুরুতেই ডাক্তার দেখিয়ে রক্তের পরীক্ষাও করা হলো, জানা গেল ডেঙ্গুজ্বর! দেরি না করে সাথে সাথেই তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো দেশের নামিদামি বিশেষায়িত এক বেসরকারি হাসপাতালে, বিশেষজ্ঞ (!) এক চিকিৎসকের অধীনে। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ (!) চিকিৎসক ও তার অধীনস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সুস্পষ্ট অবহেলায় ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে অর্থ্যাৎ ১ ডিসেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে রাইদাহ চলে গেল না ফেরার দেশে! আর এর মধ্য দিয়ে নীরবে হারিয়ে গেল উজ্জ্বল প্রতিভার এই মেধাবী শিশুটি। মিশিয়ে/ মিলিয়ে গেল দূর আকাশের লাখো তারার মাঝে। সৃষ্টিকর্তাকে বলি- ক্ষুদে এই শিশুসাহিত্যিক বন্ধুটির আত্মা শান্তিতে রেখো। হে প্রভু, রাইদাহকে যেখানেই রাখো, ভালো রেখো, আনন্দে রেখো। আর রাইদাহর মতো বিরলপ্রজ প্রতিভা যার চরম অবহেলায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিল, তাকেও কঠিন শাস্তি দিও।

স্বাতী তারা হয়ে জ্বলবে তুমি রাইদাহ।। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্রীক উপকথায় অলিম্পিয়ান দেব দেবীদের মধ্যে এথেনা দেবীর নামপাওয়া যায়। তিনি ছিলেন শুদ্ধতমা কুমারী দেবী। বিভিন্ন গ্রীক কাহিনীতে পাওয়া যায় এথেনা দেবী জ্ঞান,ন্যায়বিচার ও পবিত্রতার দেবী। শান্তির প্রতীক হিসাবে ইনি ধারন করতেন জলপাই গাছের ডাল। আমি কেন দেবী এথেনার প্রসঙ্গ টেনে আনলাম? যাকে নিয়ে দুটো কথা লিখতে চলেছি সেই রাইদাহ গালিবার কেন জানি একটা মিল খুঁজে পেয়েছি। চেহারা অবয়বে,আচরনে,কথায়,অভিব্যক্তিত্বে- এত অল্প বয়সেই তার মধ্যে এই সমিল ও ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়েছে। আমি তাকে কতটুকুই
বা দেখেছি, জেনেছি যে তার সর্ম্পকে এমন কথা বলছি। বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে কবি ও গল্পকার কানিজ পারিজাতের সাথে আলাপ ছিল, বইমেলায় তার প্রকাশিত একাধিক গ্রন্থের মোড়ক; উন্মোচন অনুষ্টানে আমি আমЯিত অতিথি ছিলাম, রাইদাহ গালিবাকে সেখানে দেখেছি মায়ের সাথে, মা কানিজ পারিজাত রাইদার সর্ম্পকে বলতেন,তার লেখা গল্পের কথা বলতেন । তখন ’শিশু’ পত্রিকায় প্রকাশিত রাইদাহর লেখা গল্প আমাকে পড়বার জন্য দিয়ে দেন। আমি রাইদাহর গল্প পড়ে তো চমৎকৃত ও অভিভ’ত। এই এত অল্প বয়সে কী করে সে ধারন করে গল্পের প্লট, কাঠামো, বুনন? কীভাবে এই কম বয়সী বালিকা রাইদাহর মাথায় আসে? এ ব্যাপারে রাইদাহর মা কানিজ পারিজাত বলেছিলেন,তাকে কোন কিছু দেখানোর চেষ্টা করেননি
তিনি, রাইদাহর নিজ উদ্যোগেই শিশুদের উপযোগী চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রাইদাহর লেখা শেষ গল্পটার প্রকাশিত বইটি আমি পড়ে দেখেছি – অসাধারন তার ভাবনা ও সৃৃজন, এই গল্পের বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিয়েছিলাম এবং বইটি সর্ম্পকে কথাও বলেছিলাম। কিন্তু ততদিনে রাইদাহ এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অন্য জগতে পাড়ি দিয়েছে।

চিকিৎসার অব্যবস্থায় এই অকাল পরিসমাপ্তি ঘটলো; কি নিদারুন শোকাবহ এক ঘটনা! আমি এখনও ভাবতেও পারছিনা, মেনে নিতে পারছি না! কাকে সান্তনা দেব– মাকে, বাবাকে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের? যার যায় এ কষ্ট শুধু তাদের বুকেই বাজবে, যতদিন বেঁচে থাকবেন তারা,ততদিন তারা এই কষ্ট বহন করে চলবেন! রাইদাহ তার ছাপা বইটা দেখে যেতে পারলো না, আর এটি ছিল এপর্যন্ত তার প্রকাশিত চতুর্থ বই। তার প্রকাশিত বইগুলো পিটুর জাদু জুতা’, এক যে ছিল মুচি’, ইমা ও দৈত্য’ এবং সবশেষটি ছিল ভয়ংকর গাছ’।
কানিজ পারিজাতের কাছেই শুনেছি তিনি কখনই রাহদাহ কি লিখবে কোন বিষয়ে লিখবে এ নিয়ে কোন কথাই বলতেন না। কানিজের ও তার মেয়ের লেখালেখির জগৎ সর্ম্পূন আলাদা ছিল। কানিজের ভ’মিকা ছিল রাইদাহর লেখা পান্ডুলিপিটি প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। রাইদার মাথার ভিতরে গল্পের প্লট সারাক্ষনই ঘুরপাক খেত। ছোটবেলায় ছবি আঁকতো -তার এই বয়সেই একটা নিজস্বতা তৈরী হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল ব্যক্তিত্ব , তার অবয়বে ছিল সহজ সরল সুন্দর এক স্বর্গীয় অভিব্যক্তি।
তাইতো রাইদাহকে সেই গ্রীক উপকথার শুদ্ধতমা কুমারী দেবীর সাথে তুলনা করেছি আজ – যেখানে শুদ্ধতা, পবিত্রতার প্রতিমূর্তি হলো রাইদাহ, যার জ্ঞান,বুদ্ধি ও ন্যায়বিচার তার এই ছোট্ট বুদ্ধিতে অভিব্যক্ত হতো, প্রতিলোকিত হতো ।
তোমার লেখনী ও রচনার মধ্যে দিয়ে, শিশু সাহিত্যে তুমি জায়গা করে নিয়েছো।তুমি যেখানেই থাকো ,শান্তিতে ঘুমাও। তুমি অমর, বেঁচে থাকবে আমাদের সবার মনে – চিরদিন তুমি রাইদাহ ।

কুইন : এক অনিন্দ্য ফুলের ফুল্লরা।। মনি হায়দার

জগতে মা ও মেয়ের মধ্যে সম্পর্কটা গভীর, নিবিড়, আন্তরিক, স্বার্থহীন। কারণ, এই সর্ম্পকটা গড়ে ওঠে রক্তের বন্ধনে স্নেহের পরম গভীর আবেগে। এখানে ভালোবাসা ছাড়া কোনো লেনদেন থাকে না। কেবলই ভালোবাসা আর ভালোবাসা। কুইন, মেয়েটি সেই ধরনের এক মমতাময়ী মায়ের কোল জুড়ানো ধ্রুব। আসমানের পর্দা ভেঙ্গে বিশাল চাঁেদর একটা টুকরো হয়ে নেমে এসেছে মায়ের স্নিগ্ধ কোমল হৃদমন্দিরে। দুঃখ, কুইন জীবনের পরিধি পার হয়ে পূর্ণ মানুষ হওয়ার আগেই অজানা জগতের অন্ধ অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, পিশাচ- আত্মলোভী চিকিৎসকের নির্মম খামখেয়ালীর লোভে। মা, কুইনের মা- প্রিয় সন্তান কুইনকে হারিয়ে এক অসীম শূন্যতার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন। হাওয়ায় হাওয়ায় খুঁজছেন প্রিয় কুসুম- কুইনকে। কুইন কতোটা সত্যিকারের ফুল হয়ে ফুটেছিল, জানতে হলে- কুইনের চারটি বইয়ের সন্ধান নেয়া দরকার। চার চারটে বই? হ্যাঁ ছয়টা গল্প লিখেছে কুইন, আর এ পর্যন্ত বইপ্রকাশ হয়েছে চারটি । ওর সম্পূর্ণ নাম- রাইদাহ গালিবা। ও ফুটেছিল কুইন- ফুলের রানীর মতো। ওর প্রথম বই-‘ পিটুর জাদু জুতা’। পিটু গরীব ছেলে। ওর একটা পাখি ছিল। সেই পাখি বিক্রি করে পিটু একটা জাদুর জুতা নিয়ে আসে। জাদুর জুতা পায়ে দিয়ে যা চায়, সেটাই পাওয়া যায়। পিটু জাদুর জুতা পরে অনেক ধনদৌলত চাইলো। খুব শ্রীঘ্রই পিটুরা ধনী হয়ে গেলো । ধনদৌলতের কারণে পিটুর মধ্যে অহংকারের জন্ম হলো। কিন্ত জাদুর জুতা সহ্য করতে পারে না পিটুর এই অহংকার। ফলে, জুতা আর কিছু দিতে রাজি হয় না। পিটু ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায় জুতার কাছে। জাদুর জুতা পিটুকে ক্ষমা করলেও পিটুর কাছে থাকে না। কারণ, অন্য মানুষের দুঃখ দূর করাও দায়িত্ব। আমরা রাইদাহ গালিবা কুইনের এই গল্প থেকে বুঝতে পারি- কুইনের মধ্যে সকল মানুষের প্রতি পরম ভালোবাসা ছিল। নইলে কুইন কেনো জাদুর জুতাকে অন্য দরিদ্র মানুষের কাছে পাঠাবে? কুইন, তোমার শুভ বোধ আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়–ক।

আমরা স্নাত হই তোমার মহত্মের উদার্য্যে। কুইন বা রাইদাহ গালিবার দ্বিতীয় বই ‘এক যে ছিল মুচি’। মুচি পেশায় সমাজে সংসারে খুব ছোট হতে পারে কিন্ত আমাদের প্রয়োজনের সময়ে কত গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে, টের পাই যখন রাস্তায় পায়ের জুতা ছিঁড়ে যায়। হন্যে হয়ে খুঁজি একজন মুচিকে। সেই মুচিকে নিয়ে অনন্য গল্প লিখেছে কুইন। কুইনের দৃষ্টি- অনেক প্রসারিত, উদার আর মানবিক। কারণ, সমাজের সবচেয়ে অবহেলিতজন মুচির জীবন এবং সততাকে আকড়ে ধরে গল্প লিখেছে ছোট্ট কুইন। ধারাবাহিকভাবে ইমা ও দৈত্য অনন্য কুইনের তৃতীয় গল্পের বই। ইমা বাবার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যেতে যেতে গভীর একটা জঙ্গলে ঢোকে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নামে। ইমা ভয়ে ঘুমিয়ে পড়ে গাছের তলায়। সেই জঙ্গলের দৈত্য এসে ঘুমন্ত ইমাকে নিয়ে যায় প্রাসাদে। সেই প্রাসাদ থেকে বুদ্ধি করে বের হয়ে আসে ইমা– দৈত্যকে বেঁধে রেখে। বুঝতে পারি- আমাদের কুইন যথেষ্ট সাহসী আর বুদ্ধিমান। প্রমাণ- এই গল্প। গল্পের মধ্যেই কুইন প্রমাণ করেছে- বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে, ভয়কে জয় করে। কুইন বা রাইদাহ গালিবার জন্য আমাদের বুকের মধ্যিখানে জেগে ওঠে গভীর মমতা। আর যারা, যে ডাক্তারের অবহেলায় হারালাম ফুটন্ত ফুল ও উড়ন্ত প্রজাপতিটাকে– তাদের জন্য নিরন্তর অভিশাপ! ’ভয়ংকর গাছ’ কুইনের সর্বশেষ লেখা গল্পটার প্রকাশিত বই। মেয়েটির করোটির মধ্যে অদ্ভুত সব গল্পের আইডিয়া পাখনা মেলে ওড়ে, নইলে এতো চমক লাগানো গল্পগুলো পেলো কোথায়? ’ভয়ংকর গাছ’- গল্পবইয়ের শেষ প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে– রাইদাহ হারিয়ে গেছে, তবে রেখে গেছে তার ক্ষুদ্র জীবনের অনন্য সব সৃষ্টি। রাইদাহর লেখা শেষ গল্প ‘ভয়ংকর গাছ’। ভয়ংকর গাছ এমনই এক গাছ যার কাছে গেলে প্রাণ সংহার হয়। রাইদাহ কী জানতো নিষ্ঠুর পৃথিবীতে অচিরেই তারও প্রাণ সংহার হবে? দুঃখ জাগানিয়া এক নি:শব্দ গানের মধ্যে কুইন জেগে আছে সৃষ্টির সুন্দরে। ছয়টা প্রকাশিত গল্প আর এ পর্যন্ত প্রকাশ হওয়া চারটে বই– মাত্র বারো বছরের এক কুইনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। নৃশংস নিকৃষ্ট দাঁতাল ডাক্তারের নিষ্ঠুর পরিকল্পনায় যদি প্রাণ সংহার না হতো- কুইন পূর্ণ সত্তায় বিকশিত হলে বাংলা শিল্প সাহিত্যে ও সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ হতে পারতো। নিত্য নতুন মানবিক ভাবনা ও নির্মাণ কলার স্রোতে আমরাও পূর্ণ হতে পারতাম। একটা প্রশ্ন– যদিও কুইনের প্রাণ সংহারী একজন ডাক্তার, কিন্ত মানুষতো! কিভাবে পারলো নিরাপরাধ একটি কুসুুম কোমল প্রস্ফুটিত মেয়েকে, হত্যার মতো নির্মম রজ্জুতে ঝুলিয়ে দিতে? এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে কী বিচার পাওয়া যাবে? কারণ, পদ্ধতিগতভাবে, খুনি
ডাক্তারের বিচারক একদল ডাক্তারই। মানবিকতার সকল গ্রন্থি শূণ্য করে আমরা নি:শব্দের রোদনে ভেসে যাচ্ছি কুইন, তোমার জন্য, তোমার সৃজন সত্তার জন্য, তোমার মায়ের জন্য, তোমার ছোট ভাইটির জন্যও। কুইন! তুমি যেখানেই থাকো, আলো কিংবা অন্ধকারে– তোমার সৃজন সৌন্দর্যে তুমি জেগে থাকবে শেষ রাতের তারার দৃষ্টিতে…

কুঁড়িতেই হারিয়ে যাওয়া মেয়ে রাইদাহ গালিবা ও তার বই।। স.ম. শামসুল আলম

২০২০ সাল। বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে বইমেলা চলছে তখন। কবি ও কথাসাহিত্যিক কানিজ পারিজাত একদিন আমাকে ফোন করলেন। তাঁর সঙ্গে আগেই আমার পরিচয় ছিল। তিনি চমৎকার গল্প লেখেন, কবিতা লেখেন। তিনি জানালেন তার মেয়ের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে, এই অনুষ্ঠানে যেন আমি থাকি। অনেকটা অবাক হলাম। কানিজ পারিজাতের নিজের বই হলে কথা ছিল না। কিন্তু তাঁর মেয়ের বই প্রকাশিত হয়েছে, এটাই আশ্চর্যের বিষয়। সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। তখনো জানতাম না তার মেয়ের নাম কী, বয়স কত ইত্যাদি। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আরও যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ফারুক নওয়াজ, মনিরুজ্জামান পলাশ, নজরুল ইসলাম নঈম, কানিজ পারিজাতের কয়েকজন বন্ধু উল্লেখযোগ্য। কানিজ পারিজাত আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন তাঁর মেয়ে রাইদাহ গালিবার সদ্য প্রকাশিত বই ‘পিটুর জাদু জুতা’। পরিচয় করিয়ে দিলেন রাইদাহ গালিবার সাথে। সালাম দিয়ে দাঁড়াল মেয়েটি। ও তখন পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে, ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলে। এবার আমি আরও অবাক হলাম। এতটুকু মেয়ে একটি বই লিখেছে এবং তা প্রকাশিত হয়েছে, এবং সে বইটার মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে। মোড়ক উন্মোচনের সময় ‘পিটুর জাদুর জুতা’য় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। বক্তব্যে বললাম, এতটুকু মেয়ে রাইদাহ গালিবা এত সুন্দর করে লিখেছে, এটা আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের বিষয়। অন্যান্য সবাই অনেক প্রশংসা করলেন। সেদিন রাতে বাসায় ফিরে বইটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। ভাবলাম একটি শিশু এত সুন্দর করে তার মনের কথা গুছিয়ে লিখেছে এটা বড়ই কৃতিত্বের কথা, আনন্দের কথা। ফোন করলাম কানিজ পারিজাতকে। আমার প্রশংসার সবটুকু তাকে জানালাম এবং বললাম, চর্চা অব্যাহত রাখলে রাইদাহ গালিবা একদিন অনেক বড় লেখক হবে। তিনি আমার কথা শুনে আপ্লুত হলেন এবং গালিবার জন্য দোয়া করতে বললেন। গালিবার এই গল্পটি ছিল বেশ মজাদার। পিটু জুতা কেনার জন্য বায়না ধরলে তার মা বলল, আমরা গরিব মানুষ জুতা কেনার টাকা কোথায় পাব। পিটু তার পোষা তোতা পাখিটা বিক্রি করে জুতা কেনার কথা বলল। তোতা পাখিটা হাটে নিয়ে গেলে এক বৃদ্ধা সেটি কিনল এবং বিনিময়ে দিল জাদু জুতা। সেই জাদু জুতার কাছে চোখ বন্ধ করে যা চাওয়া যাবে তাই পাবে। পিটু অনেক ধন-রত্ন চাইল এবং তারা ধনী হয়ে গেল। ধনী হবার পর পিটু গরিব মানুষদের হিংসা করতে লাগল। তখন জাদু জুতা পিটুর কথা আর শুনল না। পিটু রাগ করে ওটাকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে গেল। তখন জুতা কথা বলে উঠল, গরিবদের হিংসা করলে এবং ভ্যাঙালে সে আর কিছু দিবে না। পিটু ক্ষমা চাইল এবং বলল সে আর কখনো এমনটি করবে না। এরপর সেই জাদু জুতা পিটুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল অন্য কারো কাছে।

এরকম একটি অসাধারণ গল্প লেখা এতটুকু শিশুর পক্ষে কী করে সম্ভব তা মাথায় আসে না। সত্যিকার অর্থেই গালিবা ছিল অসম্ভব মেধাবী এবং প্রতিভাবান একটি মেয়ে। ‘ছিল’ শব্দটি এখানে লিখতে গিয়ে বুক ফেটে কান্না এলো। কেননা রাইদাহ গালিবা এখন আর পৃথিবীতে নেই। ২০২২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ডেঙ্গুর কাছে পরাজিত হয়ে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। গালিবার ডেঙ্গুজ্বর হবার শুরুতেই তার মা তাকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ডাক্তারগণ আরেকটু বেশি ভূমিকা নিলে বা আরেকটু সচেতন হলে মেয়েটিকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো। গালিবার দ্বিতীয় বইটি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বইটির নাম ‘এক যে ছিল মুচি’। এই গল্পটিও রূপকথার। মুচি তার দোকান বিক্রি করে শহরে গেল। যাবার পথে সে একটি পিঁপড়েকে সাহায্য করল এবং একটি হাঁসকে সাহায্য করল। পরবর্তীতে দেখা গেল মুচি তার প্রয়োজনে সেই পিঁপড়ে ও হাঁসের সাহায্য নিল। কিন্তু এই খুদে লেখক রহস্য উদঘাটন করে দিয়েছে। সেই পিঁপড়ে এবং হাঁসটি ছিল পরী। এরকম একটি মজাদার গল্প রাইদাহ গালিবা এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে, পড়ে মুগ্ধ হতে হয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার আরেকটি বই প্রকাশিত হয় ‘ইমা ও দৈত্য’ শিরোনামে। এই গল্পে দেখা যায় ইমার বাবা গরিব একজন জেলে। কিন্তু ইমা ছিল অনেক লোভী ও হিংসুটে। সে তার বাবাকে একটি দামি কলম কেনার কথা বলে। কিন্তু বাবার অত টাকা না থাকায় কিনে দিতে পারেনি। রাগ করে ইমা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। গভীর জঙ্গলে গিয়ে এক বিরাট দৈত্যের কবলে পরে সে। কৌশলে দৈত্যের কাছ থেকে নিজেই নিজেকে উদ্ধার করে এবং দৈত্যকে দিয়েই বাড়ির পথ দেখিয়ে নেয়।
বাড়ি ফিরে এসে সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে এবং নিজের ভুল বুঝতে পারে — লোভ ও হিংসা করা উচিত নয়।

একটি শিশু পৃথিবীর সকল শিশুকে জানিয়ে দিচ্ছে, লোভ ও হিংসা করা উচিত নয়। এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে? এটা অনেক বড় ব্যাপার এবং মানবিক ব্যাপার। দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে। রাইদাহ গালিবার মৃত্যুর পর ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ভয়ংকর গাছ’ নামের একটি বই। ভয়ংকর গাছ গল্পটি খুবই মজার। এটা আনন্দের গল্প এবং স্বপ্ন পূরণের গল্প। গল্পটি রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যাবে সন্দেহ নেই। গল্পটি এরকম– মনু খুব গরিব কাঠুরিয়া। তার মেয়ে রোজা। রোজার মা হারিয়ে গেছে। তাই দুজনের মনে কষ্ট। এক পথিকের সাথে মনুর দেখা। জানতে পারল, জঙ্গলে একটি ভয়ংকর গাছ আছে। অভিশপ্ত গাছ। তার সামনে দিয়ে কেউ গেলে, তাকে পশু বানিয়ে দেয়। কিন্ত এই গাছকে যদি কেউ অভিশাপ থেকে মুক্ত করে, সে যা চাবে তাই পাবে। সুযোগ নিল মনু। পথিকের কাছ থেকে সব জেনে নিল। নীল পাহাড়ে গেল অনেক কষ্ট করে। বানর ও তার বন্ধু ঘোড়ার সাহায্য নিল। নীল পাহাড়ে গিয়ে ডাইনি বুড়িকে ফাঁকি দিয়ে বিশেষ পানি নিল। উড়ন্ত ঘোড়ায় চড়ে ভয়ংকর গাছের কাছে গেল। পানি ছিটালে গাছটি হয়ে গেল যুবরাজ। আর যে ঘোড়ায় চড়ে মনু এলো, সে হয়ে গেল মন্ত্রী। মনু যুবরাজের কাছে চাইল রোজার মাকে ফিরে পেতে। তার কথামতো মনু বাড়ি ফিরে দ্যাখে রোজার মা এসেছে। –এমনই মজার মজার কথামালা গেঁথে সাজানো হয়েছে ভয়ংকর গাছ।
এত সুন্দর যার গল্প লেখার হাত সেই হাতে সে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখেছিল। গালিবা বড় হয়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলে খেলতে চেয়েছিল। তার লেখার স্বপ্ন কিংবা খেলার স্বপ্ন কোনটাই পূরণ হলো না শেষ পর্যন্ত। এতটুকু বয়সে এত ভালোবাসা তার ভিতরে ছিল সেটা তার চারটি বই পড়ে অনুভব করতে পেরেছি। প্রথম বই ‘পিটুর জাদুর জুতা’ উৎসর্গ করেছিল বাবা, মা আর ছোট ভাই আবরারকে। দ্বিতীয় বই ‘এক যে ছিল মুচি’ উৎসর্গ করেছে আবরার ও আহনাফকে এবং তৃতীয় বই ‘ইমা ও দৈত্য’ উৎসর্গ করেছে আবরারকে। দেখা যাচ্ছে জীবদ্দশায় প্রকাশিত তার তিনটি বই উৎসর্গ পাতায় আবরার-এর নাম লেখা হয়েছে। এর অর্থ ছোট ভাইটিকে সে ভীষণ ভালোবাসত। আজ এই ভাইটিকে ছেড়ে, প্রিয় মা-বাবাকে ছেড়ে, আমাদেরকে ছেড়ে সে অনেক দূরের দেশে বাস করছে। এখনো আমি তার হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মুখটি দেখতে পাই চোখের সম্মুখে।

ভালোবাসার মুকুটে কুইন।। রওনক জাহান

রাইদাহ গালিবা, মায়ের আদরের কুইন। খুব অল্প সময়ের জন্য সে এসেছিল পৃথিবীতে। মাত্র এক যুগ। বারো বছরের এই ক্ষুদ্র জীবনে সে রেখে গেছে মেধা, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা আর আত্মবিশ্বাসের বিস্ময়কর ছাপ। শিশু সাহিত্যিক হিসেবে কুঁড়ি থেকে ফুটছিল সবে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। ছোটবড় লেখা আরও বেশ কিছু। খাতার পাতায় এখনও রয়ে গেছে অসর্ম্পূণ কিছু সৃষ্টি। আরও কত কী যে ছিল তার মাথায়, মগজে, মননে–কে জানে! স্কুলের শিক্ষক/বন্ধুদের কাছেও শোনা যায় তার সৃষ্টিশীলতার নানা গল্প। শিক্ষকদের কাছে ছোট ছোট চিঠি লিখে জানাতো শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধা মিশ্রিত অনুভুতির কথা। বন্ধুদের জন্য কেনা উপহারে লিখতো বন্ধুর জন্য ভালবাসার পংক্তি। একই অঙ্ক করতো বিভিন্ন নিয়মে, গৃহশিক্ষকের সহায়তা ছাড়াই। কুইনের সৃজনশীল ভাবনা ও যৌক্তিক চিন্তা কাজ করতো সমান তালে। সত্যিই এক অনন্য প্রতিভা ছিল সে। শুধু প্রতিভাবানই নয়, আচার-আচরণে সে ছিল অনেক সুশীল ও মানবিক। বাসার সহায়তাকারি, বাসার গাড়ীচালক সবার সাথেই সে ছিল মিষ্টভাষি, আন্তরিক ও নম্র।

সাধারণত: ”টিন” পেরোলেই ছেলেমেয়েরা মা বাবার বন্ধু হয়ে যায়। আর কুইন শিশু বয়সেই হয়ে উঠেছিল মায়ের প্রকৃত বন্ধু। সময়ের চেয়ে আগানো ছিল সে। কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়ার পথ চিরতরে স্তব্ধ করে দিল মানুষের মোড়কে সাজানো একদল অমানুষ। অর্থলোলুপ অঙ্গীকারবিহীন চিকিৎসক এবং মুনাফালিপ্সু বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিবেকহীনতা তাকে ঠেলে দিল নিশ্চিত মৃত্যুুর দিকে। তবে শেষ মুর্হুত পর্যন্ত অপরিসীম মানসিক শক্তি ও মনোবল নিয়ে সে চেষ্টা করে গেছে পৃথিবীর আলো হাওয়া দেখবার। লড়াই করে গেছে অবহেলা, অনিয়ম
দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তারপরও তাকে চলে যেতেই হল। চলে যেতে হলো, কিন্তু হেরে গেল বলতে চাইনা। কারণ “কুইনেরা” কখনও হারে না, পরাজিত হয়না।
শিশু সাহিত্যিক রাইদা গালিবা কুইন বেঁচে থাকবে তার প্রতিভাময় সৃষ্টিতে; চিকিৎসকের দায়িত্বহীনতা, কর্ম অবহেলা আর হাসপাতালের র্দুনীতিপরায়ন লোভী মানসিকতার নীরব ঘৃণ্য প্রতিবাদের সাক্ষী হয়ে; আমাদের ভালবাসার মুকুটের রত্ন হয়ে; তার অকাল মৃত্যুর প্রতিবাদে ন্যায় বিচারের জন্য মায়ের যুদ্ধের শক্তি হয়ে। এ যুদ্ধে জয় আসবেই। শুধু প্রার্থনা, আর কোন কুইনকে যাতে এভাবে অকালে চলে যেতে না হয়।

অভিশপ্ত বৃক্ষগুলোকে মানবরূপে ফিরিয়ে আনবে কে।। ইকবাল খোরশেদ

রাইদাহ গালিবা কুইন। একটি নাম। না, শুধু একটি নাম নয়, উজ্জ্বল এক প্রতিভা। কুইনের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি, হয়নি কোনো ভাববিনিময়। কিন্তু তাঁকে আমি চিনতাম। যে জননীর নাভিমূল ছিন্ন করে কুইন এই পৃথিবীর আলোতে প্রথম চোখ মেলেছিলেন, সেই জননীকে আমি চিনি ; চিনি কাজের সূত্রে, তাঁকে জানি তাঁর গল্প ও কবিতা পাঠের মাধ্যমে। জননীকে জানি তাই কুইনকে কিছুটা জানি, বাকিটা জানি তাঁর লেখালেখির সূত্রে। শ্যাম বর্ণের ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো’, উঁচা, সুঠাম দেহের রাইদাহ গালিবা কুইনের ছিল আশ্চর্য এক প্রতিভা। মাত্র বারো বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। এরও তিন বছর আগে, নয় বছর বয়সে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গল্পের বই প্রকাশ হয়েছিল। তারপর একে একে তাঁর আরও তিনটি গল্পের বই প্রকাশ হয়েছিল যথাক্রমে দশ, এগারো এবং বারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই। কুইনের গল্পগুলো অনেকটা রূপকথার গল্পের আদলে লেখা। তবে, গল্পগুলোতে উঠে এসেছে মানুষের যাপিত জীবন ও সমাজদেহের চালচিত্র। ভেবে আশ্চর্য হতে হয়, ওইটুকুন একটি বালিকা তাঁর গল্পে তিনি প্রতিবাদ মুখর হয়েছেন ; মানবতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর প্রতিবাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তাঁর প্রতিবাদ মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রতিবাদ অসাম্য ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কুইনের লেখা প্রথম গল্প ‘পিটুর জাদু জুতা’র কথাই ধরা যাক : পিটু নিতান্ত গরীব। তার মা যা আয় করেন তা দিয়ে তাঁদের একবেলার অন্নের সংস্থান হয়। একদিন পিটুর জুতা ছিঁড়ে গেলে সে জুতা কেনার জন্য মায়ের কাছে টাকা চায়, কিন্তু মায়ের কাছে তো টাকা নেই। পিটুর একটি পোষা তোতাপাখি ছিল। মায়ে-ছেলে যুক্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়, পাখিটি বিক্রি করে দেবে। বিক্রিলব্ধ টাকা দিয়ে পিটু জুতা কিনবে। সিদ্ধান্তমতো পিটু তার পোষা পাখিটি এক বৃদ্ধার কাছে বিক্রি করে দেয় একজোড়া জাদুর জুতার বদলে। সেই জুতা পায়ে দিয়ে পিটু যা চায়, তা-ই পায়। পিটু দেখলো এতো ভারি মজা ! যা চাওয়া যায়, তা-ই পাওয়া যায়। পেতে পেতে একসময় দরিদ্র পিটু ধনী হয়ে ওঠে। ব্যস্ধসঢ়;, এখন অহংকারে পিটুর মাটিতে পা পড়ে না। তবে, জাদুর জুতার সহ্য হয় না পিটুর এমন অহংকার। সে পিটুকে আর কিছু দিতে অসম্মতি জানায়। পিটুও বুঝতে পারে তার ভুল। পিটুর ভুল ভাঙলেও জাদুর জুতা কিন্তু আর পিটুর ইচ্ছেদাস হয়ে থাকে না। কেননা, তাকে তো অন্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। গল্প বলার মেধাবী কৌশলে কুইন জাদু জুতার ভেতরে মানবিক গুণাবলি আরোপ করে জুতাকেও একটি চরিত্র করে তুলেছেন। কুইন তাঁর সৃষ্ট ‘পিটু’ আর ‘জাদু জুতা’ চরিত্র দুটির মধ্যদিয়ে মানুষের মনের ভেতরের আলো-আঁধারির রূপ-কে চিত্রায়িত করেছেন। পিটু একজন লোভী মানুষের প্রতিভূ আর জাদু জুতা একদিকে যেমন প্রতিবাদী, অন্যদিকে তেমন মানবতাবাদী। সে পিটুর লোভী ও অহংকারী চরিত্রের প্রতিবাদ করেছে। আবার সে পিটুর দারিদ্র্য দূর করে অন্য জনের দারিদ্র্য দূর করতে প্রয়াসী হয়েছে। এমনিভাবে রাইদা গালিবাহ কুইন তাঁর সব গল্পেই সমাজের নানারকম অসংগতি ও মানব মনের শুভ-অশুভের দ্বান্দ্বিকরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন।

কুইনের প্রকাশিত শেষ বইতে তিনি এক অভিশপ্ত ভয়ংকর গাছের আর এক নির্লোভ সাহসী কাঠুরের চরিত্র অংকন করেছেন। ভয়ংকর গাছ মূলত একজন যুবরাজ। তার শত্রু এক দৈত্য তাকে অভিশাপ দিয়ে ভয়ংকর গাছে পরিণত করেছে। গরীব নির্লোভ এক কাঠুরে বহু বাধার পথ অতিক্রম করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৈত্যের ঘেরাটোপ থেকে জল এনে গাছের গায়ে ছিটিয়ে তাকে মানবরূপ ফিরিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে সে অর্থমূল্য বা তেমন কোনো কিছুই দাবি করেনি। মানবরূপ পাওয়ার আগে অভিশপ্ত গাছ তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেকোনো মানুষকে পশুতে রূপান্তর করে দিত। গত বছর কুইনের ডেঙ্গু জ¦র হয়েছিল। জ¦র সারানোর জন্য শুরুতেই তিনি হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। লোভী এক চিকিৎসকের সীমাহীন লোভের শিকার হয়েছেন কুইন। ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা, অবহেলা আর সীমাহীন লোভের কারণে বড়ো অকালে প্রতিভাধর এক শিশুগল্পকার পাড়ি জমালেন সেখানে, যেখানে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষের ভিড়। অভিশপ্ত গাছের মতোই ওই চিকিৎসকও যেন এক অভিশপ্ত মানুষ। তার লোভের শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে বারো বছরের নিষ্পাপ শিশু রাইদাহ গালিবা কুইনকে। দেশ হারিয়েছে এক ভবিষ্যৎ গল্পকারকে।
যে রত্নগর্ভা জননী এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি জানেন সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কতটা গভীর, কতটা সহ্যক্ষমতা থাকলে একজন মা এমন
বেদনাকে সঙ্গী করে দিন যাপন করতে পারেন। সত্যিই কি পারেন ? না কি পারার একটা প্রাণান্ত অভিনয় করে চলেন…
এইসব অভিশপ্ত বৃক্ষগুলোকে মানবরূপে ফিরিয়ে আনবে কে ? কবে আসবেন একজন তেমন কাঠুরে ? এদেশ, দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি
কুইনের পরিবারের, জাতির এই অপূরণীয় ক্ষতির মূল্য দিতে পারবে ? কোনো কিছুর বিনিময়ে কি মোছানো যাবে কুইনের মায়ের চোখের জল ?

রাইদাহ গালিবা : ক্ষুদে জীয়নকাঠি।। সালেহা সুলতানা


রাইদাহ গালিবার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। তবে দেখা না হলেও দেখার চেয়ে বেশি জেনেছি তাকে। রাইদাহ গালিবার মা ‘কানিজ পারিজাত’ একজন গুণী মানুষ। বিসিএস তথ‍্য ক‍্যাডারের একজন পারদর্শী অফিসার। তিনি কবি, গল্পকার, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার — বহুরৈখিক গুণে গুণান্বিত একজন সৃজন-প্রতিভাধর ব‍্যক্তিত্ব। তাঁর কাছে শুনেছি মেয়ে রাইদাহ গালিবার কথা। আর এভাবেই মায়ের মুখে গল্প শুনে শুনে রাইদাহ গালিবা আমার নিকট খুব পরিচিত একজন হয়ে ওঠে। রাইদাহ গালিবার আরেক নাম কুইন। কুইনকে আমি ছবিতে দেখেছি। খুব মিষ্টি মেয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ভোরের শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ-শুভ্রতা তাকে ছুঁয়ে আছে। শিশু বয়সেই প্রখর ব‍্যক্তিত্বের ছাপ তার দেহাবয়বে। তাকে দেখেই মনে হয়েছে বিরাট মহীরুহ সমতায় অচিরেই সে পৌঁছে যাবে। আমার এই ধারণা আরো দৃঢ়তা পেলো যখন জানতে পারলাম –সে গল্প লেখে। একজন শিশু সাহিত‍্যিক।
রাইদাহ গালিবার গল্প আমি পড়েছি। পড়ে অভিভূত হয়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া একজন ক্ষুদে শিক্ষার্থী কীভাবে এতো সুন্দর গল্প লিখতে পারলো, সত্যিই বিস্মিত হলাম। গল্পের মজবুত ভিত তৈরির কৌশল, বর্ণনার নিপুণতা, ভাষার সারল‍্যে গল্পগুলো অসাধারণ দ‍্যুতি ছড়িয়েছে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমতায়। রাইদাহ সময়ের অগ্রণী প্রতিভূ। স্বল্প সময়ের জীবন তার। এই স্বল্প-সময় দৈর্ঘ্যের জীবনে তার বিবেক- শাসিত শিশু মনস্তত্ত্বে ঠাঁই পেয়েছে ন‍্যায়-অন‍্যায় বোধ। তাই তার গল্পে কদর্য-পঙ্কিলতাকে পরিহার করে পরিমলবাহী শুদ্ধ জীবনের কথাই প্রকাশ পেয়েছে। ঈশপের গল্পের মতোই ন‍্যায়বোধের মানদণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বচ্ছ-স্ফটিকসম গল্পগুলো। রাইদাহ লেখা “ইমা ও দৈত্য” গল্পটি সুন্দর শিক্ষণীয় একটি গল্প। গরীব মেয়ে ইমা লোভী ও হিংসুটে। লোভ ও হিংসার কারণে তাকে বিপদে পড়তে হয়। বনের দৈত্য তাকে বন্দী করলে কীভাবে সে বুদ্ধি খাটিয়ে দৈত্যকে বশ করে বাড়ি ফিরে আসে এবং পরবর্তীতে লোভ,হিংসা পরিত‍্যাগ করে ভালো মানুষে রূপান্তরিত হয় — সে ঘটনাই বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। শিশুদেরকে নির্লোভ পথের পান্থ করতে প্রয়াসী রাইদাহ। তার এই প্রজ্ঞাময় ভাবনাই তাকে মেধায় ও মননে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
“পিটুর জাদু জুতা” রাইদাহ গালিবার অন‍্যতম একটি গল্পের বই। এ গল্পটিও অনন‍্য সাধারণ একটি গল্প। পিটু একবার এক জোড়া জাদু জুতা পায়। জাদু জুতা জাদু করে অনেক ধনরত্ন দেয়। তখন পিটু ধনী হয়ে যায়। কিন্তু একদিন জাদু জুতা আর পিটুর কথা শোনে না। পিটুকে ছেড়ে চলে যায়। কেন চলে যায় জাদু জুতা, — সে কারণও নির্ণয় করে দিয়েছে গল্পকার রাইদাহ। কেমন করে সুন্দর মানুষ হওয়া যায়, কেমন করে শুদ্ধ মানুষ হওয়া যায় তারই মূলমন্ত্র গল্পগুলোতে উন্মোচন করা হয়েছে। রাইদা গালিবার আরেকটি শ্রেষ্ঠ গল্প “আন্ডোরে রাজ‍্যের কাহিনী”। এই গল্পে রাইদাহ অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। কাহিনীর জটিল ঘূর্ণাবর্তের দুর্যোগকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি প্রয়োগ করে সমাধানে এনে পৌঁছে দিয়েছে লেখক। গল্পটির কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। আন্ডোরে রাজ‍্যের রাজা ডেভিড প্রজাদের নিয়ে সুখে ছিলেন। প্রজাদের কল‍্যাণ কামনায় রাজা সর্বদা ব‍্যস্ত থাকেন। কিন্তু পাশ্ববর্তী রাজ‍্য ইস্তানিয়ার হিংসুটে রাজা ট্রেন্ট, ডেভিড রাজার সুখ দেখতে পারে না। তাই সে রাতের আঁধারে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আন্ডোরে রাজ‍্যে আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং রাজা ডেভিডকে বন্দী করে। তারপর ডেভিডের সকল শুভাকাঙ্ক্ষীকে হত্যা
করে। কিন্তু ডেভিড রাজার সেনাপতি জোসেফ বেঁচে ছিলো। জোসেফ গোপনে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে ডেভিডকে উদ্ধার করে কীভাবে গ্রামগুলোতে আন্দোলন গড়ে তুলে এবং হিংসুটে রাজা ট্রেন্টকে পরাজিত করে ফিরিয়ে আনে হারানো আন্ডোরে রাজ‍্য ও রাজাকে— সেই অপরাজেয় শক্তিমত্তার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ গল্পে। একজন শিশু, যার মানসিক ও শারীরিক বিকাশ পূর্ণতা প্রাপ্ত হবার পথে, সে কী করে এমন মুন্সিয়ানাপূর্ণ গল্প লিখতে পারলো, সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। রাইদাহর সৃজন-শক্তি ও প্রয়োগ-কৌশল তার মেধা, মনন ও
কল্পনাশক্তির কৃতিত্বের স্বাক্ষরবাহী।

রাইদাহ গালিবার আরো একটি সজীব গল্প “এক যে ছিল মুচি”। এই গল্পে রাইদাহ একজন গরীব কিন্তু পরোপকারি ভালো মানুষ মুচির কথা বলেছে। এ গল্পে দেখা পাওয়া যায় আমাদের কাছের পরিচিত প্রাণী পিঁপড়া ও হাঁস। ক্ষুদ্র হলেও মুচি ওদেরকে তুচ্ছ বলে উপেক্ষা করে না। ওদের বিপদে সাহায্য করলো এবং এর বিনিময়ে ওরাও মুচিকে সাহায্য করলো। পিঁপড়া ও হাঁস আসলে ছিলো পরি। আর পরিরাই পিঁপড়া ও হাঁস হয়ে মুচিকে বিপদ থেকে রক্ষা করে। তখন মুচিকে রাজা অনেক সোনার মুদ্রা উপহার দিলে মুচির কষ্ট দূর হয় এবং সুখে বসবাস
করতে থাকে। চমৎকার একটি গল্প এটি। রাইদাহ গালিবার অনন‍্য আরেকটি সৃষ্টি হলো “ভয়ংকর গাছ”। এটিই তার স্বল্প আয়ুর জীবনের শেষ গল্প। অতুলনীয় কল্পরঙের মিশ্রণে অসাধারণ শিল্প এটি। রাইদাহ গালিবার মস্তিষ্কপ্রসূত সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক ভাবনা যা গল্পের পাঠককে কৌতূহলী করে বৈচিত্র্যময় সোপানে নিয়ে যেতে যেতে রহস্যময়তায় মগ্ন করে রাখে। এবং অবশেষে সুন্দর ও নির্মল এক পরিসমাপ্তিতে পাঠককে মানসিক তৃপ্তিতে পৌঁছে দেয়। যা একজন লেখকের প্রকৃত সার্থকতা। রাইদাহ গালিবাও “ভয়ংকর গাছ” গল্পে সেই সূত্রেই সার্থক হয়েছেন। এই গল্পে দেখা যায়, ইস্তানিয়া রাজ‍্যের যুবরাজ সিংহাসনে বসলে এক দৈত্য তাকে অভিশাপ দিয়ে ভয়ংকর গাছে রূপান্তরিত করে। তারপর সেই গাছের সামনে দিয়ে যে পথিকই যাবে, তাকে পশু বানিয়ে দেয়। মন্ত্রীকেও ঘোড়া বানিয়ে দেয়। সেই বনের পাশেই মনু নামের একজন কাঠুরে বাস করতো তার মেয়ে রোজাকে নিয়ে। রোজার মা হারিয়ে গেছে তাই ওদের খুব কষ্ট। একদিন এক পথিকের সাথে মনুর দেখা হলে পথিক জানিয়ে দেয় ভয়ংকর গাছের কথা এবং আরো জানায় যে, নীল পাহাড়ে বাস করা এক ডাইনির কাছ থেকে বিশেষ পানি এনে ছিটিয়ে দিলে সে গাছের অভিশপ্ততা থেকে সবাই মুক্ত হবে। এরপর সেই পথিকের কথা অনুযায়ী মনু নীল পাহাড়ে যায় এবং ডাইনির কাছ থেকে পানি এনে ভয়ংকর গাছে ছিটিয়ে দিলে গাছটি যুবরাজে পরিণত হয় আর সে সাথে মনু তার স্ত্রী ও রোজা তার মাকে ফিরে পেয়ে সুখী হয়। এই গল্পে ভয়ংকর গাছকে ভয়ংকর বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বিষয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে গল্পকার হিসেবে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন রাইদাহ গালিবা।
এই গল্পগুলোতে প্রকৃতির এমনি সব ক্ষুদ্র উপকরণ যারা আমাদের নিত্য সঙ্গী, তাদের সাথে এক নিবিড় সখ্য গড়ে তুলে গল্পে তা প্রতিফলিত করেছে এই প্রকৃতি-বান্ধব লেখক। রাইদাহ গালিবার হৃদয়ে একটি প্রদীপ্ত সূর্য বিরাজমান ছিলো। সে সূর্যের কিরণমালায় এই জঞ্জালময় পৃথিবীকে সুন্দর করে তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলো। সে যেনো একাই হ‍্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকায় সব অন‍্যায় ও প্রতারণার অবসান ঘটাতে প্রয়াসী ছিলো। তার মনস্তত্ত্বের বোধবোধির শিরা-উপশিরায় সুস্থ ও স্বচ্ছতার সলিলধারা প্রবাহিত হতো। এক উদার উন্মুক্ত সবুজ উপত‍্যকার মনোজগতে তার বিচরণ,—যেখানে নেই বৈরিতার ঢিল-পাটকেল, হিংস্রতার ক্ষত-আঘাত, নির্মমতার নির্দয়-নিষ্ঠুরতা ; আছে কেবল দু’হাত তুলে বিলিয়ে দেবার শত-সহস্র নির্মল আলোকমালা আর নন্দনতত্ত্বের শুদ্ধভূমি। এমন মুক্তপ্রাণই তো নির্মাণ করে গেছেন যুগে যুগে ইতিহাসের বিজয়সৌধ। রাইদাহ গালিবা যে সেই পথেরই পান্থ। কিংবা গতানুগতিক বৃত্তে বাইরে একজন নতুন পথের পথিকৃৎ হবার শিশুভিত তৈরি করছিলো। বড় হতে হতে সে নির্মাণ করে নিতো এক হিরণ্ময় জ‍্যোতির জগতকে। যেখানে মানুষ মানুষ হিসেবে থাকবে, অমানুষের মতো থাকবে না কোন নখর-থাবা। আমরা হারিয়েছি একালের একজন রবীন্দ্রনাথকে, নজরুলকে, সুকান্তকে। হারিয়েছি একজন দার্শনিক প্লেটোকে, একজন মাদার তেরেসাকে। কে বলতে পারতো না যে, রাইদাহ গালিবা সূচিত হচ্ছিল একটি মহীরুহ হওয়ার জন‍্য, একটি হিমালয় হওয়ার জন্য কিংবা একটি কিংবদন্তি হওয়ার জন‍্য? তার উন্মেষলগ্ন তো সে কথাই বলে। যার বীজমন্ত্রে এতো শক্তি মজুদ ছিলো সে তো পৃথিবীকে কিছু দেয়ার জন্যই জন্মেছিলো। কিন্তু পরিপূণভাবে বিকশিত হয়ে কর্মময় জীবনকে পল্লবিত ও কুসুমিত করার সুযোগকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ দুঃখভার আমরা কোথায় রাখবো? আমাদের বেদনার নদী উপচে উপচে পড়ছে। আমরা বাকহারা হয়ে গেছি। রাইদাহ গালিবা কেবল গল্পই লিখতো না, তার আরো অনেক গুণ ও প্রতিভা ছিলো। সে খুব সুন্দর ছবি আঁকতো। যে ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ, দেশের পতাকা এবং প্রকৃতি স্থান পেতো। সে ছিলো একজন ভালো সংগঠক। যে কোন পরিস্থিতিকেই আয়ত্তে নিয়ে আসার অসাধারণ প্রজ্ঞা ছিলো তার। সে ছিলো “বিস্ময় বালিকা”। সে ছিলো “সূর্য বালিকা”। সে ছিলো “ক্ষুদে জীয়নকাঠি”। ভালো কাজের জীয়নকাঠি। রাইদার স্পর্শে সবই জীবন্ত হয়ে ওঠতো। সেটা তার গল্প, পরিবার, বন্ধুমহল বা যে কোন বিষয়। এমনই সমর্থ সুপ্ত থাকতো তার লৌহসম শিশু- ব‍্যক্তিত্বে।
রাইদাহ গালিবার অকাল মৃত্যু আমাদেরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আমরা মর্মাহত, সে সাথে ক্ষুব্ধ। এমন হত‍্যাকাণ্ডের বিচার চাই আমরা। কুচক্রী মহলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করি। শিশুহত‍্যার কঠিনতম দণ্ড দেয়া হোক। রাইদাহ গালিবা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদ-মাঝে। প্রতিদিন সন্ধ‍্যাকাশে উদিত সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির দিকে অশ্রুভরা চোখে তাকিয়ে বলি – “ভালো থেকো কুইন। আমাদের ক্ষমা করে দিও। এই কলুষিত পৃথিবীতে আমরা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমাদের ব‍্যর্থতাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা
করো।“

রাইদাহ গালিবা সবুজ গাছ হতে চেয়েছিল।। ইমরুল ইউসুফ

শিশুটি ছবি আঁকছে। সামনে ছড়ানো ছিটানো রং-বেরঙের পেনসিল। ইজেল, বুরুশ বা তুলি। সাদা কাগজ ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে উঠছে। রংধনুর মতো। প্রজাপতির মতো। বেলুনের মতো। এমন সময় একটি কাঁঠাল পাতা উড়ে উড়ে আঁকতে থাকা ছবির ওপর পড়ল। শিশুটি পাতাটি সরাতে গিয়েও সরালো না। ভাবলো– থাক। পাতাটাকে ছবির অংশ করে নিল শিশুটি। পাতার চারপাশে রং লাগাল। মনে মনে বলল, বাহ বেশ তো লাগছে! এমন সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল একটি রাজহাঁস। হাঁসটি ডানা ঝাপটাল। কয়েকটি পালক উড়তে লাগল তুলোর মতো। একটি পালক বাতাসে ভাসতে ভাসতে এসে পড়ল ওই ছবির ওপর। ঠিক কাঁঠাল পাতার পাশে। ভেজা জলরঙে আটকে গেল পালকটি। অদ্ভুত তো! শিশুটির মনে বিস্ময়। সেইসঙ্গে আনন্দ। এমন ছবি সে আঁকতে চায়নি। কিন্তু কেমন করে যেন নতুন একটি ছবি হয়ে যাচ্ছে। শিশুটি পালকটিও সরালো না। ছবির মধ্যে একটি হাঁস আঁকলো। গাছ আঁকলো। আঁকলো ফুল, পাখি, প্রজাপতি। শিশুটি তার মাকে ডাকল। বলল, ‘মা আমার ছবিটি দেখো। সুন্দর না?’ এমন অদ্ভুত ছবি দেখে মা তো অবাক! বললেন, ‘একি করেছো মা? এ ছবি তুমি জমা দিতে পারবে? এটা একটা প্রতিযোগিতা। এখানে তো যা-তা করে ছবি আঁকা যায় না।’ মেয়েটি বলল, ‘ঠিক করেছি মা। আমি এখন ছবিটি পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দিবো। দেখবে আমার ছবিটি ওই রাজহাঁসের মতো পানিতে ভাসতে থাকবে।’ মা কিছু বললেন না। মেয়ের এ চাওয়ায় বাধা দিলেন না। মনে মনে বললেন, এ কাজ করে মেয়ে যদি আনন্দ পায় তাহলে তাই করুক। মা আর মেয়ে মিলে ছবিটি পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দিলো। রাজহাঁসের মতো ছবিটি ভাসছে। নৌকার মতো ছবিটি ভাসছে। আর শিশুটি ভাসছে আনন্দে। হাতে তালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে। এই আনন্দ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে ঢের বেশি। শিশুদের ছোটো ছোটো এমন চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারাও তাদের অধিকারের সঙ্গে শামিল হওয়া। তাদের ভাবনার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আনন্দের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। শিশুমনের সকল দরজা জানালা খুলে দেওয়া। আমরা খুব সহজেই এগুলো করতে পারি। কিন্তু ফুলের মতো সুন্দরতম শিশু রাইদাহ গালিবার ক্ষেত্রে কি আমরা সেটা পেরেছি? পারিনি, মোটেও পারিনি। বরং পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা হয়েছে। দেশের বেসরকারি নামকরা একটি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের অবহেলায় আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি পবিত্রতম শিশু রাইদাহ গালিবা কুইনকে। যদিও রাইদাহ সোনামানিক হয়ে আমাদের হৃদয়ে ‘চিরজীবিত’ শিশু হয়ে বেঁচে আছে। থাকবে অনন্তকাল। রাইদাহ ছোটোবেলা থেকেই খুব সৃষ্টিশীল। কথায় কথায় সে ছড়া কাটতো। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো। একসময় গল্পগুলো মা লিখে রাখতেন। একটু বড়ো হয়ে রাইদাহ নিজেই লিখতো মজার মজার গল্প। সেসব গল্প ছাপা হতো দেশসেরা শিশু পত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশ’, ‘শিশু’ প্রভৃতি পত্রিকায়। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও ছাপা হতো রাইদাহর গল্প। কিন্তু রাইদাহ এখন আর গল্প লেখে না। তাকে নিয়েই আমরা লিখি কত্তো কত্তো গল্প। অনেকেই সে গল্প পড়ে। অনেকেই তার গল্প শোনে। কেবল রাইদাহর পড়া হয় না। রাইদাহর শোনা হয় না।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সেরা শিক্ষার্থী ছিল রাইদাহ। পড়তো পঞ্চম শ্রেণিতে। ভাবাই যায় না– রাইদাহ নেই! মাত্র বারো বছরের জীবন পাখির ডানায় ভর করে উড়ে গেলো আকাশে। মা কবি ও গল্পকার কানিজ পারিজাত প্রাণপ্রিয় কন্যাকে সবসময় খুঁজে বেড়ান সীমাহীন নীলিমায়। বাবা মিজানুর রহমান কন্যাকে সারাক্ষণ খুঁজে বেড়ান– হেথা নয়, হোথা নয়, অন্যকোনো খানে। প্রিয় কন্যার তুলতুলে গালে আদর দেওয়া যায় না। ছোঁয়া যায় না কুঁচবরণ চুল। প্রিয় ছোটো ভাই আবরার তার বোনকে খোঁজে ঘর-বাড়িতে, মাঠে-ঘাটে, খাটে। খাটের তোষক, বালিশ, বিছানার চাদরে। কোলবালিশকে বোন ভেবে সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। চোখের স্বচ্ছ জ¦লে রাইদাহর মায়াময় মুখ। পটলচেরা চোখ। রাইদাহ আছে, আছে– সবখানে। ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে। সবার একান্ত আপনজন হয়ে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। রাইদাহ গালিবার হঠাৎ জ¦র এলো। মা শুরুতেই নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ধরা পড়লো ডেঙ্গু। দেরি না করে সাথে সাথেই তাকে ভর্তি করানো হলো হাসপাতালে। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা হলো না। মায়ের অভিযোগ– তাঁর কন্যাকে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ফ্লুইড অব্যবস্থাপনার কারণে রাইদাহ গতবছরের ৩০ নভেম্বর চিরতরে হেমন্তের মেঘ হয়ে হারিয়ে যায় আকাশে। রাইদাহ গালিবা গল্প লিখতে ভালোবাসতো। মজার মজার সব গল্প। সেই গল্পগুলো পরে বই আকারে প্রকাশও হয়েছে। বইগুলো হলো– ‘এক যে ছিল মুচি’, পিটুর জাদু জুতা’, ‘ইমা ও দৈত্য’ এবং ‘ভয়ংকর গাছ’। রাইদাহ ‘ভয়ংকর গাছ’ গল্পের ভয়ংকর সেই গাছ হতে চায়নি। সে সবুজ গাছ হতে চেয়েছিল। গাছের শীতল ছায়া হতে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল সবুজ মাঠ। নীল আকাশ। ঝরনার স্বচ্ছ জল। ‘ভয়ংকর গাছ’ গল্পের চরিত্র– কাঠুরে ‘মনু’র সঙ্গে হয়তো যেতে চেয়েছিল নীল পাহাড়ে।
পাহাড়ের সেই ডাইনির কাছে। যে ডাইনির কাছে পানি আছে। ওই পানি ছিটিয়ে দিলে অভিশপ্ত গাছ আবার মানুষ হয়ে যাবে। মানুষগুলো সুখে শান্তিতে সমাজে বসবাস করবে। কিন্তু চিকিৎকরূপী ডাইনি রাইদার সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় রাইদাহর সব স্বপ্ন। হৃদয়ে জমে থাকা সব গল্প সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ে বিলিন হয়ে যায়। শিশুরা ইচ্ছে মতো নেচে, গেয়ে, খেয়েদেয়ে, আনন্দ, হৈহুল্লোড় করে খেলাধুলা করবে। শিক্ষা গ্রহণ করবে। পুষ্টিকর খাবার খাবে। হাসপাতালে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাবে। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। ঘরে নিরাপদে ঘুমাবে। মা বাবার আদর ভালোবাসায় মন ও মননে বেড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ সবসময় শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করে। রাইদাহর মতো নিষ্পাপ, নিরাপরাধ শিশুদের হত্যা করে। আমরা রাইদার মতো মেধাবী আর সৃষ্টিশীল কোনো শিশুকে অকালে হারাতে চাই না। আমরা চাই সকল শিশুর নিরাপদ এবং সুরক্ষিত জীবন। শিশুদের প্রতিটি দিন হোক আনন্দময়। শিশুরা প্রতিদিন আনন্দে হাসুক। আনন্দে ভাসুক। সূর্য হয়ে আলো দিক। গাছ হয়ে ছায়া দিক। মাটি হয়ে লালন করুক। আকাশ হয়ে আগলে রাখুক। পাহাড় হয়ে সুরক্ষা করুক। রাইদাহ গালিবার মতো কোনো শিশু যেনো ভুল চিকিৎসায় চিরতরে হারিয়ে না যায়। কারণ রাইদাহর মতো শিশুরাই হয় ছায়াময় বৃক্ষ। মাটির মতো খাঁটি। আলোর মতো উজ্জ্বল। পাহাড়ের মতো অটল। আকাশের মতো উদার। বৃষ্টির মতো সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী।

ইমরুল ইউসুফ
উপপরিচালক
বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১০০০

কুইনের জন্য এলিজি
কামাল বারি

এ শহর একদিন নিরাপদ হবে নিশ্চিত;
জীবন ধুকবে না জীবনের অনামি দামে;
এ পৃথিবী শত সংকট শত ব্যাধি দেখেছে শতবার…
প্লেগ দেখেছে— শত মারি ও মড়ক—
জলে বাতাসে মৃত্যুর শেতল ছোবল—
অতিমারি করোনা দুঃশাসনে ধুঁকেছে বিশ্ব!
অপরাজেয় মানুষ তবু প্রতিবার দাঁড়িয়েছে টানটান;
এ শহর কবিতার মহৎ আলোয় জ্বলে উঠবে—
কবিদের উজ্জ্বল মুখের শপথ…।
একদিন মশক নিধন হবে—
এ শহর প্রকৃত সবুজ প্রচ্ছদে শতরং ফুল ফোটাবে;
আর কোন‌ও কুইন রাইদাহ গালিবা ডেঙ্গুজ্বরে হেরে যাবে না…
অকালে অদিনে হবে না দূর আকাশের তারা…!
এ শহরে চিকিৎসাবিদ্যা মার খাবে না আর—
চিকিৎসক সেবক… ওষুধব্যাপারি …— ?
— সবাই সত্যিই মানবিক হবে…
হাসপাতাল ব্যবসাদারের মুদ্রাকল হবে না নিছক—
সেবাঘর হবে…
এখানে আশ্চর্য মেধাবী শিশুরা গল্প লিখে লিখে তাক লাগিয়ে দেবে…
পরিণত জীবনে ছড়াবে বিস্ময়…
এ শহর হবে হবে হবে নিশ্চয় নীচুতার ব্যাধি থেকে হবে নিরাময়…
তখন না হয়— কুইন ফের গল্পের ডালি নিয়ে আসবে ফিরে…
আমাদের সুন্দর এই শহরে—; আহা, এখন ঘুমাক…!

তার অপেক্ষায়।। নুসরাত আইরিন

সে আর ফিরবেনা কোনদিন
সে আর হাঁটবেনা ঘাসের গালিচাতে
সে আর দাঁড়াবেনা দরোজায়
দ্বার খুললেই তাকাবেনা হাসিমুখে
তবু সে রয়ে যায় মনে – হৃদয়ের স্পন্দনে — প্রতি ক্ষনে ।।
তার ছড়ানো হাসির পথ ধরে শুন্য চেয়ে থাকি —
স্বপ্নে আসে – আশাও জাগে – যদি আবারো ঘরে ফেরে !
খাবার টেবিলে তার চেয়ারটা আজও রাখি খালি —
পাশে এসে বসে যদি!
এ অপেক্ষা যত্নে লালন করি
এ অপেক্ষাতেই বেঁচে থাকি ।।
বার বার ছুটে যেতে চাই
তার মাটির ঘরে
যেখানে সে শুয়ে থাকে চুপচাপ,একা,
নিজস্ব ভুবন জুড়ে –
ডাক দেই –” কু-ই-ন – -“
শুনতে কি পায়?
নোনা জলে ভিজে গেলে মাটির শয্যা –
সে কি দেখতে পায়?
আমরা কাঁদছি প্রতিদিন
কন্যার কাছে যাবো বলে,
আমরা কাঁদছি প্রতিদিন
কন্যাকে আলিঙ্গন করবো বলে ।।

কুইন তুমি কেমন আছো।। অতনু তিয়াস

কুইন তুমি কেমন আছো
দূর আকাশের তীরে?
মিটি মিটি হাসছো বুঝি
লক্ষ তারার ভিড়ে?
হাসিখুশি সৃষ্টিসুখে
উঠছিলে বেশ বেড়ে,
হঠাৎ করে ডেঙ্গু জ্বরে
তোমায় নিলো কেড়ে!
ফিরবে তুমি প্রতীক্ষাতে
আজও আছেন মা যে,
রাগ করেছো কুইন তুমি?
ঘরে ফিরলে না যে!
একটিবারও শুকায় না তো
মায়ের চোখের নদী,
কষ্ট ভুলে মায়ের কোলে
ফিরে আসতে যদি!
গল্প ছড়া রূপকথাতে
মুখর মানবতা
দেয়ালে আজ তোমার ছবির
কেমন নীরবতা!
তুমিও যেন তোমার লেখা
রূপকথার নীল পরি
কল্পলোকের গল্পে তুমি
করছো উড়াউড়ি।
ফিরে এসো ঘরে এসো
দূর আকাশের তারা,
বুকটা মায়ের খা-খা করে
কুইন তোমায় ছাড়া!

কুইন।। অলোক বসু

রাইদাহ গালিবার ডাকনাম কুইন
ইশ্ কীবা বয়স এইট কিংবা নাইন!
দারুণ মিষ্টি আর মেধাবী এক মুখ
হয়তো এই ছিলো তার মায়ের সুখ।
গাইতে পারতো কি সে কোনো গান?
লিখে কিন্তু কুড়িয়েছিলো বেশ সুনাম।
বাড়ন্ত শিশুটি হতে পারতো বড় কেউ
রহস্যময় মৃত্যু থামালো জীবনের ঢেউ।
ডানা মেলে ওড়বার সাধ হলো না পূরণ
কত কীই যে করবার ছিলো আজীবন।
না, কিছুই করা হলো না জীবনে তার
মরুভূমির পাথরে ফুল হয়ে ফুটবার,
কুলকুল রবে নূপুর-নিক্কনে বহিবার,
ইচ্ছে নদীতে রঙিন মাছ হয়ে ভাসবার,
নতুন সৃষ্টির তুলিতে স্বপ্নগুলো আঁকবার।

কেউ কেউ থেকে যায়।। কানিজ পারিজাত

সব পথ এখানে এসে শেষ হয়ে যায়—
সব রেখা— সরল কিংবা বক্র নানাবিধ জ্যামিতিক নকশা এঁকে—
এখানেই এসে থমকে যায় এক স্থির বিন্দু হয়ে—
এখানেই নিস্তব্ধতার চাদর পরে কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকে— অনন্ত সম্ভাষণের!
এখানেই কয়েকটি পাতা দুলে দুলে—
কিছু পাখি নড়ে চড়ে বলে ওঠে—
তোমরা ছিলে বুঝি?
এখানেই পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল চাপ চাপ গুঞ্জন তুলে বলে ওঠে—
আহা, ছিল— ছিল— একদা ছিল—
আজ নেই— কিচ্ছু নেই— কোথাও নেই—
নেই টুকরো কথা— নেই মায়ার হাসি— নেই ছায়ার মানুষ—
নেই— নেই— নেই—
তবুও এখানেই,
সমস্ত রুদালী ক্রন্দন তুচ্ছ করে—
হৃদয় বলে ওঠে—
আছে— এখনও আছে—
চলে গিয়েও কেউ কেউ থেকে যায়—
থেকে যায় অনন্ত কাল!

প্রিয় বান্ধবী রাইদাহ
মারজান বিনতে হোসাইন তানফা
(ভিকারুননিসা নুন স্কুল,
শ্রেণী- ষষ্ঠ- ক,শাখা- দিবা)

শত বছর পার হলেও
সেই তোমারই কথা মনে পরে।
আমার প্রিয় বান্ধবী রাইদাহ,
তোমার মুখ যে আমার মনে
পরে চোখে জল এনে দেয়,
স্কুলের শত মেয়েদের মধ্যে
ছিলে তুমি অন্যতম সেরা!
তুমি ছিলে না কোনো দিক দিয়ে
কম যে– যেমন লেখাপড়া,
তেমনি আচার আচরণ,
তেমনি সংস্কৃতি, তেমনি সৎ ।
সেই একই জায়গায় দুঃখ জানো তো —

কেন চলে গেলে তুমি ?
কেন ফিরবে না তুমি ?
তোমার মতো মানুষ হয় নাকো —
তুমিই যে আমার প্রিয় বান্ধবী

রাইদাহ!

মান্ত্রিশা চৌধূরী তাষ্মী
(ভিকারুননিসা নুন স্কুল
শাখা-ক Ñদিবা
শ্রেলী-ষষ্ঠ)

কী করে ঘুচাব এ দুঃখ
যখন কেউ পাশেই না থাকে!
কী করে ঘুচাব এ দুঃখ
যদি কেউ কথাই না বলে !
তবে ছিল অতি প্রিয় একজন বন্ধু,
সৎ,সরল,পড়ালেখায় ভালো,
স্বভাবের কথা তো আর বললামই না —
তবে আজ সে আর কথা বলে না,
কষ্টে আমার বুক কাঁপে,
কেন সে চলে গেল ? কেন ?
রাইদাহ গালিবার মতো বন্ধু পাওয়া
এমনই এক সাফল্য –
যে সে চলে গেলেও তাকে কোনদিনও
ভোলা যায় না !

৩০ তারিখ রাত!
আদিবা নওয়াজ
(ভিকারুননিসা নুন স্কুল,
শ্রেণী-ষষ্ঠ- ক, শাখা- দিবা)
৩০ তারিখ রাত,

যে রাতে একজন মা হারায় তার সন্তানকে।
৩০ তারিখ রাত,
যে রাতে একজন বাবা হারায় তার নয়নের মনিকে।
এ কেমন বীভৎসময় রাত!
যে রাতে এক ভাই হারায় তার খেলার সাথীকে।
৩০ তারিখ রাতে,
প্রকৃতি কেড়ে নেয় এক নিস্পাপ শিশুর প্রাণকে।
এ কেমন দুর্ঘটনাময় সেই রাত!
যে রাতে এক নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয় এক নিস্পাপ শিশু।
চিকিৎসকদের অবহেলায় প্রাণ হারায় এক ফুটফুটে জীবন।
সেই ৩০ তারিখ রাতে,
এক বন্ধু হারায় আর এক বন্ধুকে।
সেই ৩০ তারিখ রাতে,
এক শিক্ষক হারায় তার প্রিয় ছাত্রীকে।
এ কেমন কুৎসিৎ রাত!
এক মায়ের চোখের ঘুম কেড়ে নেয় যে রাত!
সেই ৩০ তারিখ রাত!
সেই ৩০ তারিখ রাত!
সেই ৩০ তারিখ রাত!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *