শিশুসাহিত্যশিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প-রাজপুত্র ও অজগর সাপ- অমিত কুমার কুণ্ডু

দুইবোন কঙ্কাবতী আর চন্দ্রমুখী। তাদের দুজনের চেহারা কথাবার্তা আচার-আচরণ সবই আলাদা। কঙ্কাবতী বড় বৌয়ের সন্তান। কঙ্কাবতী যখন খুব ছোট তখন ওর মা মারা যান। কঙ্কাবতীর বাবা অনেক ভেবেচিন্তে কঙ্কাবতীকে দেখাশোনা করার জন্য আবার বিয়ে করেন। কিন্তু না, মা-মরা কঙ্কাবতীর জীবনে সুখ আসে না। সৎ মা কঙ্কাবতীকে নিজের দাসীর মতো মানুষ করতে থাকেন। সারাদিন ছোটমার ফাইফরমাশ খাটা, ছোট মার মুখ ঝামটি পাওয়া আর বাড়ির সমুদয় কাজ করে তার দিন পার হতে থাকে। কিছুদিন পর ছোটমার কোল আলো করে আসে চন্দ্রমুখী। চন্দ্রমুখী আর কঙ্কাবতী এক সাথে বড় হতে থাকে। কঙ্কাবতী পরে ছেঁড়া জামা, চন্দ্রমুখী পরে নতুন জামা। কঙ্কাবতী ঘুমায় মাটিতে মাদুর পেতে, চন্দ্রমুখী ঘুমায় খাটের ওপর তুলোর বিছানায়। দিনে দিনে যদিও দুটি বোন বড় হতে থাকে তবুও পোশাক পরিচ্ছদে তারা যে বোন, দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই!

কঙ্কাবতীর রূপে চারিধার ঝলমল করে। এতো কালি মাখে, এতো রোদে পোড়ে, এতো আগুনের তাপে কাটায়, তবুও কঙ্কাবতীর রূপে সাতগ্রাম মুগ্ধ! বড় বড় সওদাগর আর বণিকের ছেলেরা কঙ্কাবতীকে বিয়ে করতে চেয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়! কিন্তু তাদের ছোটমা সবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ছোটমা কঙ্কাবতীর রূপে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যান। তিনি চান না কঙ্কাবতীর ভালো বিয়ে হোক। এদিকে কঙ্কাবতীর বিয়ে না হওয়ায় চন্দ্রমুখীরও বিয়ে দিতে পারছেন না। কঙ্কবতীকে কীভাবে মেরে ফেলা যায় এই ভেবে ভেবে শেষমেশ ছোটমা কঙ্কাবতীর জন্য বন থেকে এক অজগর ধরে আনলেন; আর বললেন, ‘জ্যোতিষ বলেছেন, তুই যদি এই অজগরকে আগে বিয়ে না করিস, তো তোর স্বামী বাসর রাতেই মারা যাবে! তাই আগে তোকে অজগরকেই বিয়ে করতে হবে! অজগরের সাথে বিয়ে করলে বাসর রাতে অজগর মারা যাবে। পরে তোকে কোনোএক ছেলের সাথে বিয়ে দেবো।’
কঙ্কাবতী সরল বিশ্বাসে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। ছোটমা কঙ্কাবতীকে এতো নির্যাতন করেন তবুও ছোটমা’র প্রতি কঙ্কাবতীর শ্রদ্ধাভক্তির কোনো কমতি নেই। যথারীতি এক লগ্নে কঙ্কাবতী আর অজগরের বিয়ে হয়ে গেল। ছোটমা ভেবেছেন কঙ্কাবতী অজগরের সাথে বাসর ঘরে থাকলে অজগর কঙ্কাবতীকে খেয়ে ফেলবে। এরপর তিনি চন্দ্রমুখীকে কোনো সুপুত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে একা সুখেই সংসার করবেন। যথারীতি বিয়ে শেষ হলে ছোটমা কঙ্কাবতীর বাবার শত নিষেধ অমান্য করে কঙ্কাবতী আর অজগরকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল টেনে দিলেন। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে বাবা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে উঠোনের এককোণে পড়ে রইলেন।
এদিকে কঙ্কাবতী আর অজগর বাসর ঘরে যাবার পর কঙ্কাবতী ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে খাটের এক পাশে পড়ে রইলো। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখে, কোথায় অজগর সাপ! তার খাটে বসে আছে পরম সুন্দর এক রাজপুত্র! কঙ্কাবতী ভেবে পাচ্ছে না, সে স্বপ্ন দেখছে- না বাস্তব! যখন কঙ্কাবতীর ঘোর কাটলো তখন সে বুঝতে পারলো, স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই সে এক রাজপুত্রের পাশে বসে রয়েছে। কঙ্কাবতী এ ঘটনার কারণ জানতে চাইলে রাজপুত্র বললেন, ‘আমি কয়েক বছর আগে শিকারে গিয়ে খেলার ছলে এক অজগরের গায়ে তীর মারি। অসলে সেখানে অজগরের ছদ্মবেশে ছিলেন তপস্যাসিদ্ধ এক ঋষি। তিনি আমার অপরাধের জন্য আহত অবস্থায় আমাকে শাপ দেন, আমি যেন রাজপুত্র থেকে অজগর হয়ে যাই। এরপর তাঁর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে ক্ষমা চেয়ে যখন নিজের মানব রূপ ভিক্ষা চাইলাম, তখন তিনি বললেন- ‘যদি কোনো সুন্দরী মেয়ের সাথে তোমার এই অজগর রূপেই বিয়ে হয়, তবে বাসর রাতে তুমি তোমার পূর্বের রাজপুত্রের রূপ ও ঐশ্বর্য ফিরে পাবে।’
কঙ্কাবতী রাজপুত্রের কথা শুনে অবাক! তারপর তাঁকে বিয়ে করার জন্য রাজপুত্র কঙ্কাবতীকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসর রাতে কিছু গয়না উপহার দিতে চাইলেন। রাজপুত্র তাঁর আগের রূপ ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে আগে থেকেই তাঁর কাছে থাকা স্বর্ণালংকার, সোনার তলোয়ারসহ রাজবেশও ফিরে পেয়েছেন। তিনি যখন তাঁর বৌ রাজরানি কঙ্কাবতীকে সেসব উপহার দিতে চাইলেন, কঙ্কাবতি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।
এরপর রাজপুত্র একে একে রাজরানি কঙ্কাবতীর কান ছিদ্র করে যখন কানে গয়না পরাচ্ছেন, তখন রাজরানি কঙ্কাবতি কেঁদে বলে ওঠলেন, ‘ও বাবা গো, বাঁচাও গো।’ যখন নাক ছিদ্র করে নাকে নথ পরাচ্ছেন, তখনও রাজরানি কেঁদে বলে ওঠলেন, ‘ও মাগো, বাঁচাও গো। এদিকে সদ্য রানি হওয়া কঙ্কাবতীর ছোটমা বাইরে থেকে কঙ্কাবতীর চিৎকার শুনে আনন্দে লাফাতে লাগলেন। তিনি ভাবছেন- ‘এই বুঝি কঙ্কাবতীর হাত খেয়ে ফেললো অজগরটি! এই বুঝি কঙ্কাবতীর পা খেয়ে ফেললো অজগরটি!’ এভাবে সারারাত রাজপুত্র তাঁর রানি কঙ্কাবতীকে গয়না পরালেন, আর সারারাত রানি কঙ্কাবতী কাঁদতে থাকলেন। বাইরে ছোটমা কঙ্কাবতীর সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা চিন্তা করে আনন্দে লাফাতে থাকলেন। ভোরে যখন গয়না পরানো শেষ হয়ে যায়, তখন দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এদিকে কঙ্কাবতী অজগরের পেটে চলে গিয়েছে ভেবে ছোটমা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালে বেশ বেলা হলে ছোট মার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে তিনি আনন্দে আনন্দে কঙ্কাবতীকে গিলে পেট মোটা হয়ে যাওয়া অজগরকে দেখতে বাসর ঘরের দরজা খোলেন। কিন্তু কোথায় অজগর? কোথায় তার মোটা পেট? পেটমোটা অজগরের পরিবর্তে অলঙ্কারে শোভিত রাজরানি কঙ্কাবতী শুয়ে রয়েছেন, আর তাঁর পাশে শুয়ে রয়েছেন সুবর্ণভূমি রাজ্যের অজগর হয়ে যাওয়া রাজপুত্র অরুণকুমার!
ছোটমা কঙ্কাবতীর বাসর ঘরে প্রবেশ করাতে ওদের দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়। ওরা বাইরে এসে রাজপ্রাসাদে খবর পাঠায়। রাজারানি মহাধুমধাম করে তাদের নতুন পুত্রবধু কঙ্কাবতী আর রাজপুত্র অরুণকুমারকে রাজপ্রাসাদে বরণ করে নিয়ে গেলেন। এ দৃশ্য দেখে চেঁচামেচির শব্দে জ্ঞান ফিরে পাওয়া কঙ্কাবতীর বাবার দুচোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়াতে থাকলো। তিনি পরমানন্দে আর পরম তৃপ্তিতে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে থাকলেন।
এদিকে কঙ্কাবতীর এমন বিপরীতে হিত হওয়ায় ছোট মা হিংসায় উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেলেন। তিনি তাঁর মেয়েকে কঙ্কাবতীর মতোই আরেক রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দিতে আবার বন থেকে অজগর ধরে আনলেন। এবার আর যেনতেন ভাবে নয়, মহাধুমধাম করে চন্দ্রমুখী আর অজগরের বিয়ে দিলেন। নবদম্পতিকে বাসর ঘরে পাঠিয়ে বাইরে গয়না পরার কান্না শুনতে বসে রইলেন চন্দ্রমুখীর মা।

ছোটমার চেষ্টা ব্যর্থ হলো, এবার আর অজগর রাজপুত্র হলো না।

অজগর তো যেনতেন সাপ না! বিষ না থাকলে কী হবে? ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঝোপঝাড়ে বিচরণ করা এ সাপের আছে মসৃণ আঁশযুক্ত বৃহদাকার শক্তিশালী শরীর। এরা সহজেই ছাগল, হরিণ প্রভৃতি জীবজন্তু পেঁচিয়ে ধরে পিষ্ট করে গিলে খেয়ে ফেলতে পারে!

অজগর ঘরের মধ্যে মানুষ পেয়ে চন্দ্রমুখীকে পেঁচিয়ে ধরে প্রথমেই পায়ের দিক থেকে কামড়ে গেলা শুরু করলো। চন্দ্রমুখীর পায়ে যন্ত্রণা শুরু হলে সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘ও মা গো, ও বাবা গো, আমায় খেয়ে ফেললো গো, এসো গো, দরজা খোলো গো, আমায় বাঁচাও গো।’ চন্দ্রমুখীর বাবা দরজা খুলতে গেলে ছোট বৌ তাঁকে এক ধাক্কা দিয়ে ওঠোনে ফেলে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘বুঝতে পেরেছি, চন্দ্রমুখীকে রাজপুত্র গয়না পরাচ্ছে সেটা তোমার সহ্য হচ্ছে না! দুর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে!’ অন্যদিকে অজগর চন্দ্রমুখীর পা হতে শুরু করে এক এক করে পুরো শরীর গিলে ফেলছে আর চন্দ্রমুখীর মা আনন্দে লাফাচ্ছেন। মেয়ের গয়নায় মোড়া রূপ দেখে মুগ্ধ হবার জন্য তার প্রাণ আকুলিবিকুলি করছে। এমনভাবে চন্দ্রমুখীর কান্না ভোর পর্যন্ত চলার পর যখন অজগরটা চন্দ্রমুখীকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছে, তখন চন্দ্রমুখীর কান্না থামলো। চন্দ্রমুখীর কান্না থামার পর তার মা ভাবলো মেয়ে গয়না পরে সুখনিদ্রা গেছে। তাই তিনিও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে গেলেন!
আজও একটু বেলা করে তার ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে এসে দরজা খুলতেই দেখে, কোথায় গয়না পরা রানির বেশে থাকা চন্দ্রমুখী? সেখানে পড়ে রয়েছে চন্দ্রমুখীর ছেঁড়া জুতো! আর চন্দ্রমুখীকে খেয়ে পেট মোটা করে ঘুমিয়ে আছে বন থেকে ধরে আনা সেই বিশাল আকৃতির অজগর যে! কঙ্কাবতীর ছোটমা’র ঘরে ঢোকা টের পেয়ে অজগরটি হেলেদুলে ঘর থেকে বের হয়ে বনের দিকে চলে গেল। চন্দ্রমুখীর ছেঁড়া জুতো জড়িয়ে ধরে চন্দ্রমুখীর মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বুক চাপড়ে বলতে থাকলেন, ‘লোভে পড়ে এ আমি কী করলাম, চন্দ্রমুখি! মা আমার, এ আমি কী করলাম!’

২ thoughts on “শিশুতোষ গল্প-রাজপুত্র ও অজগর সাপ- অমিত কুমার কুণ্ডু

  • Amit Kumar Kundu

    অশেষ ধন্যবাদ।

    Reply
  • Amit kumar kundu

    ধন্যবাদ

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *