শিশুসাহিত্যশিশুতোষ গল্প

শিশুতোষগল্প- সিলমীর প্রথম স্কুল -চেমন আরা


আমার পাঁচ বছরের নাতনি সিলমী। সম্প্রতি সউদি আরব থেকে ছুটিতে মা-বাবার সঙ্গে দেশে বেড়াতে এসেছে।
তাকে যেমন দেখব ভাবছিলাম তার চাইতে অনেক সেয়ানা হয়ে এসেছে। বয়সের কথা না বললে কেউ বুঝতেই পারবে না তার বয়স মাত্র পাঁচ। ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, বাংলা ও আরবিতে কথা বলার সমান দক্ষতা তার। খাবার টেবিলে বসে সে সব ভাষায় কথাবার্তা বলে। যে যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষায় উত্তর দেয়। সে এখন বাড়ির সবার আনন্দের উৎস।
দেশে আসার পর কয়েকদিন যেতে না যেতে সে আবদার ধরেছে দাদু, আমি স্কুলে ভর্তি হব, ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাব। সুন্দর একটা ব্যাগও সে তার আম্মাকে ফরমাশ দিয়ে কিনে নিয়েছে। ভাবনায় পড়ে গেলাম। অল্পদিনের জন্য তাকে কীভাবে স্কুলে ভর্তি করানো যায়! স্কুলে ভত্তি করানো আজকাল চাট্টিখানি কথা নয়। ছেলে-মেয়ে ভর্তি করতে কত যে কাঠখড় পুড়াতে হয়, সে শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন।
বাড়ির পাশে তামরীন নামে বাচ্চাদের একটা স্কুল আছে। প্রধান শিক্ষিকা আমার বিশেষ পরিচিত। অনেক বলে কয়ে ভদ্র মহিলাকে রাজি করানো গেল। সিলমীকে ভর্তি করিয়ে দিলাম নার্সারি ক্লাসে।
প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন সিলমীর কি খুশি, কি উৎসাহ। সকাল বেলা জায়নামাজে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছি। হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরালাম। দেখি, ঘুম জড়ানো চোখে সিলমী এসে দাঁড়িয়েছে। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, দাদু। আজকে আমি স্কুলে যাব না? তুমি আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে না?
হ্যাঁ, দাদু! তোমাকে নিশ্চয় স্কুলে নিয়ে যাব। এখন তো অনেক সকাল। তুমি তোমার আম্মার কাছে গিয়ে শুয়ে থাকো। সময় হলে তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাব। কেমন? তার মা-বাবাসহ বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে তখনও।
সে একা ঘুম থেকে উঠে চলে এসেছে আমার কাছে। আমার কথা শুনে সে আস্তে তাদের কামড়ায় ফিরে যায়।
ঠিক সাতটার সময় আবার সে আমার কামড়ার দোরগোড়ায় হাজির। এবার সে একা নয়-তার মাসহ। পরণে জিনসের প্যান্ট ও গেঞ্জি। পনি টেইলের ফ্যাশানে চুল বাঁধা। পিঠে ব্যাগ। বেশ স্মার্ট লাগছে সিলমীকে। কী দাদু! তুমি এখনও তৈরি হওনি। তুমি না বলেছিলে, মুখ-হাত ধুলে, সুন্দর পোশাক পড়লে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। এই দেখ না, আমি কেমন সুন্দর পোশাক পড়েছি। দারুণ সুন্দর কাপড় পরেছ তুমি। আমাকে দেবে? আমি বললাম।
ওর মাকে বললাম ওকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও। স্কুল ছুটি হবে দশটায়। অতক্ষণ উপোষ থাকবে কেমন করে?
সিলমী আপত্তি জানায়, না, না, দাদু। আমি খাব না। তুমি তাড়াতাড়ি চলো, স্কুলে যাব। আমার হাত ধরে সে টানতে শুরু করে। অনেক কষ্টে তাকে কিছু খাওয়ানো হলো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সিলমীকে নিয়ে স্কুলে রওনা দিলাম রিকশায় করে।
জীবনে প্রথম স্কুল যাওয়া সিলমীর। আমার অনুভব, অনুভূতিতে এক অব্যক্ত শিহরণ। সিলমীর চোখেমুখেও এক অপার্থিব আনন্দের হিল্লোল। খুশিতে ডগমগ করছে সে। তার চোখে মুখে, কথাবার্তায় কোথাও ভয় ডরের লেশ মাত্র নাই। আমার বারবার অপুর পাঠশালা যাওয়ার ছবিটা মানস চোখে ভেসে উঠছে। অথচ আমি যাচ্ছি, ঢাকা শহরের কিন্ডার গার্টেন স্কুলে। অপুর জীবন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সিলমীর জীবন অভিজ্ঞতার যেখানে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলের গেটে পৌঁছতেই স্কুল বসার ঘণ্টা বেজে উঠে। সিলমী আমাকে তাগিদ দেয় দাদু, তাড়াতাড়ি করো। আমি লেখাপড়া করব যে। উৎসাহ, উদ্দীপনায় সে যেনো উচ্ছল ঝরনা ধারা। স্কুল বিল্ডিং এ ঢুকে আমি সরাসরি সিলমীকে নিয়ে নার্সারি ক্লাসের দরজায় হাজির হই। ক্লাস শিক্ষিকা সিলমীকে নিয়ে একটি খালি বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন। সে খুব সহজ ভঙ্গিতে অভ্যস্ত কায়দায় পিঠের ব্যাগটি খুলে পাশের সিটে রাখে। তারপর ব্যাগের মুখ খুলে রাবার, পেন্সিল বার করে।
আমি দরজায় দাঁড়িয়ে তার কাজ কারবার দেখছি। শ্রেণি শিক্ষিকা স্কুলের নাম লেখা দুটো খাতা তাকে দিয়ে বলে, এই খাতা তোমার জন্য।
একটায় ইংরেজি আর একটায় অংক লিখবে। সিলমী প্রথম অংক খাতা টেনে নেয়। শ্রেণি শিক্ষিকা লাইন টেনে দিয়ে বলে এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত লেখো। দেখি তুমি কেমন লিখতে পার। সিলমী শিক্ষিকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি পারি।
শিক্ষিকা আবার বলেন, বাহ! তুমি খুব ভালো মেয়ে। সিলমী বলে, আমি গুডগার্ল, না মেডাম?
এই দেখেন আমি কতো তাড়াতাড়ি লিখতে পারি। ক্লাসের অন্য সব ছেলেমেয়ে অবাক হয়ে সিলমীর দিকে চেয়ে থাকে। শিক্ষিকা এবার নজর দেন তাদের দিকে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে সিলমীর ব্যাপার স্যাপার দেখছি। পাঁচ বছরের এমন একটি ছোট মেয়ে স্কুলের প্রথম দিনকে কাজে লাগাচ্ছে দেখে যতোটা অবাক হচ্ছি তার থেকে বেশি গর্ববোধ করছি। সে এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত লেখার সময় মাঝে মাঝে আড় চোখে আমার দিকেও তাকায়। কিন্তু হাত তার এগিয়ে যাচ্ছে তার নির্দিষ্ট লেখার কাজে।
অত্যন্ত সুন্দর ভাবে, একদম কাটাকাটি, ঘষাঘষি না করে লেখা শেষ করে খাতা বন্ধ করে বসে থাকে গর্বিত ভঙ্গিতে। এবার তার দৃষ্টি ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়ের দিকে। সবাই ব্যস্ত অঙ্ক লেখা নিয়ে। শিক্ষিকা সবার সামনে গিয়ে বার বার ভুল শুধরে দিচ্ছেন। সিলমীর সামনে আসতেই সে বলে, আমি সব লিখেছি। সুন্দর করে লিখেছি, না? শিক্ষিকা হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন, খুব সুন্দর লিখেছ, তুমি। এবার তুমি ইংরেজি লিখবে কেমন? কলকলিয়ে হেসে ওঠে সিলমী বলে আমি ইংরেজি ও লিখতে জানি। পড়তেও জানি। শিক্ষিকা বলেন, এবার তুমি আমাকে এ থেকে জেড পর্যন্ত লিখে দেখাও। পরে আমি তোমার কবিতা শুনব। কেমন? এবারও সিলমী খুব তাড়াতাড়ি তার কাজ শেষ করে ফেলে। সিলমীর পাশের সিটে বসে একটা ছেলে তখনও অঙ্কের খাতা নিয়ে বসে আছে।
সিলমী একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ওমা! তুমি এখনও অংক শেষ করতে পারনি? টিচার বকবেন যে!
এমন সময় শ্রেণি শিক্ষিকাও ক্লাসের সবাইকে আবার তাগিদ দেন তাড়াতাড়ি অঙ্ক শেষ করো। ইংরেজি লিখতে হবে।
সিলমী সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমার ইংরেজি শেষ। আমি ভালো, না? শিক্ষিকা হাসেন।
সিলমীর ইংরেজি লেখা শেষ হলে শিক্ষিকা আমাকে ডেকে বলেন, আপা, প্রথম দিন ওকে আর প্রেসার দেওয়া ঠিক হবে না। মাশাল্লাহ, নাতনি আপনার খুবই বুদ্ধিমতী। ওকে নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।
সিলমী তার রাবার, পেন্সিল, খাতা ব্যাগে ভরে চলে আসে আমার কাছে। কানের কাছে মুখ এনে বলে দাদু, আমার বন্ধু কই? এখানে সব যে ছেলে। ওর কথা শুনে আমি ক্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখি। সত্যি তো সবই ছেলে। ওদের শিক্ষিকাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম মেয়ে যারা ভর্তি হয়েছে তারা কেউ আজ আসেনি। সিলমীকে বললাম তোমার বন্ধু কাল আসবে। এবার সিলমী বলে, দাদু! খিদে পেয়েছে। কী খাবে জিগ্যেস করতে সে বলে সিদ্ধ ডিম খাব। মহা ফ্যাসাদে পড়লাম। এখানে সিদ্ধ ডিম কোথায় পাই। স্কুলের আয়াকে বলতে সে দোকান থেকে একটা ডিম এনে ক্যান্টিনের চুলোয় সিদ্ধ করে দেয়।
ডিমের খোসা ছাড়তে ছাড়তে সিলমীকে বললাম, চা খাবে? না, ছোট মেয়েরা চা খায় না। শুধু চা খায় সি বিচে। যখন গলা ব্যথা থাকে। ওর কথায় আবার অবাক হলাম।
সেই দিনের ছোট মেয়ে সিলমী। এতো সুন্দর করে, এতো গুছিয়ে কেমন করে কথা বলে আমি বুঝতে পারি না। ওর বুদ্ধি, মেধা ও আচার-আচরণে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠে।
সিলমী ডিম খেতে খেতে লক্ষ্য করে একজন শিক্ষিকার হাতে লম্বা নখ-নখে রঙ ও আছে। ও আমাকে বলে দাদু, দেখ দেখ ঐ ম্যাডামের হাতে কত বড় নখ আবার রঙও আছে। তুমি না আমাকে বলো নখ রাখতে হয় না, রঙ দিতে হয় না নখে। তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ, দাদু? আমি লা জবাব। পাঁচ বছরের নাতনিকে আমি কি জবাব দেব, ভেবে পেলাম না। ওর প্রশ্ন আমার বুকে টিচারের ধারাল নখ হয়ে আঁচড় দিতে থাকে।


One thought on “শিশুতোষগল্প- সিলমীর প্রথম স্কুল -চেমন আরা

  • Tasnim siddiki

    ভালো লাগার মতো

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *