শিশুসাহিত্য

শিশুসাহিত্যিক- রাইদাহ গালিবা স্মরণ সংখ্যা

বোধ থেকে উঠে আসা বিদ্রোহ
শূন্যে ঝুলে থাকে বিক্ষত বিরহে।
আত্মজার কান্নায় থাকে গোপন প্রতিবাদ
যার গহিনে রোদের তেজ ফনা তোলে।

নিস্তব্ধ-নিঝুম বোবা কান্নায় মায়ের ওম
নিশ্চুপ কেঁদে যায় জনন কষ্টের আড়ে।
সময় হেঁটে যায় ধীরে ধীরে বিস্তর ফারাকে
শিশুটি যেন ততটাই মায়ের সুরক্ষা ব্যারাকে।

বুকের গভীরে শ্মশান সায়াহ্নে থাকে এপিটাফ
সেখানে অঙ্কিত রাইদাহ নামে কষ্টের সুনামি গোলাপ।

যে কথা যায় নি বলে –
জানা হবে না কখনোই
জীবন কি তবে সুপেয় ছিলো না
অপূর্ণ পানে চলে যেতে হলো

বিষাক্ত নখর ছিনিয়ে নিলো জ্যোতির্ময় জীবন
কখনো হবে না বলা ‘ভালোবাসি’
শোনাও হবে না ঝাঁকড়া চুলের মেয়েটির কথা,
এসেছিলে শোনাতে কিছু সত্যবাণী, অব্যক্ত মনের কথাও,

হয় নি বলা
রেখে গেছো অসম্পাদিত গ্রন্থখানি?
জানা হয় নি,
কাকে দিয়ে গেলো কলমের ভার

কাকে রেখে গেলো মায়ের কোলে,
কেনইবা গেলো সমষ্টির স্বপ্ন রেখে
মায়ের চোখে বেদনা এঁকে
আধো ঘুম আধো জাগরণে

শোকের পায়রা উড়িয়ে যাওয়া মেয়েটিকে
খুঁজছে মা
জড়িয়ে নিতে বুকের গভীরে,
এখনো আছে ভাইয়ের বেদনার্ত চোখে

পড়ার টেবিলে
খাতার পাতায়
বেলকনির আধফোটা কুঁড়িতে
অলেখা গল্পের চরিত্ররা অঝরে কাঁদছে

কে দেবে তাদের আলোর দিশা,
কেন যেতে হলো খেলাঘর ফেলে
জননী বসুন্ধরার?
একরাশ প্রশ্ন রেখে চলে যেতে হলো

অদম্য সমুদ্র পেরুনো মেয়েটির
কখনো হবে কি জানা…

শান্ত স্বভাব একটু লাজুক মায়ায় ভরা দৃষ্টি তার
ছোট্ট মেয়ে কিন্তু ছিল দুহাত ভরা সৃষ্টি তার।
রঙ তুলিতে আঁকত ছবি ফুল পাখি মাছ সবুজ গাঁ
ছোট্ট হলেও দৃপ্ত পায়ে সাহস নিয়ে ফেলতো পা ।

দেখলে কারো কষ্ট কোনো পারতো না সে সইতে আর
ছোট্ট হাতে আদর দিয়ে কষ্ট লাঘব করতো তার ।
কতই বয়স দশ বছরের চেয়েও তখন স্বল্প যে
সেই বয়সেই এই মেয়েটি লিখতো দারুণ গল্প যে ।

গল্প তো নয় সে সব যেন নীতিকথার অরূপ রূপ
গল্পগুলো সুবাস ছড়ায় পুড়লে ছড়ায় যেমন ধূপ
কুইন নামের এই মেয়েটির মেধার ছিলো তীক্ষ্মধার
পার হতো সব বাধার পাহাড় মানতো না সে একটু হার।

এমন প্রতিভার মেয়েটি ফোটার আগেই ঝরলো হায়
অর্থলোভী ডাক্তার তার মারলো ছুরি কলিজায়
ছোট্ট কুইন মেধায় ছিলো বিস্ময়কর একটি তারা
শাস্তি তাদের খুব প্রয়োজন এই মেধা খুন করলো যারা।

এই যে এখন সন্ধ্যা নামার
একটু আগে থেকে
ঘাসের পাতায় যাচ্ছে শিশির
নিজের শরীর মেখে।

এই যে এখন আকাশ ভাসে
সাদা মেঘের ভেলায়
ঘাসফড়িং আর শালিক মাতে
ওড়াউড়ি খেলায়।

এই যে এখন বইছে বাতাস
হিম-হিম-হিম ঠাণ্ডা
আঁধার যেন আসছে হয়ে
লাল পাহাড়ের ঝাণ্ডা।

আসছে সবই যাচ্ছে ফিরে
হচ্ছে বদল সবই
কুইন মা তুই কোথায় গেলি
শুধুই কেন ছবি!

বাইরে গেলি সেই যে কবে
ভাল্লাগে বল মা রে?
খুঁজছি তোকে সবখানে রোজ
না খুঁজে কেউ পারে!

তুই তো ছিলি চোখের মনি
এই হৃদয়ের তারা
জ্বলতিস জ্ঞানের প্রদীপ হাতে
করতে পাগলপারা।

আয় ফিরে আয়, আয়রে কুইন
আয়রে সোনামনি
তোকে বুকে রাখব ধরে
দূর করে সব শনি।

আয় ফিরে মা
আয় ফিরে
আয়রে ফিরে
আয়

চাঁদের দেশে
হাওয়ায় ভেসে
কতই থাকা
যায়!

ধবধবে সাদা বিছানায় চাপা পড়ে আছে কষ্ট।
দুয়ার দাঁড়িয়ে গাড়ি, এত বন্দনা, নিজের
বিষ্ময়বিমূঢ় জিজ্ঞাসা- সব দেখে শুনে
সত্যিকারের রানীর মতো, চললে

যথাসর্বস্ব ফেলে, ভাগ্যহত মাকে একা বসিয়ে।
সন্দেহ নেই, তবু কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।
একি পক্ষপাত? একি নষ্টশক্তির বন্দনা?
কুঈন, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।

লোভাতুর কুৎসিত হাত, ডোমের মতোই।
তারা মুহূর্তেই ভাঙতে জানে, তছনছ করতে জানে
জীবনজিজ্ঞাসা থেকে সাজানো বাগান।

অল্প বয়সে তার গল্পের হাত
মেধা দিয়ে করেছিলো সে তো বাজিমাৎ।
রাত-দিন এই নিয়ে ভাবনাটা ছিলো
কলমের আঁচড়েই জানানটা দিলো।
জয় করে নিয়ে এই পাঠকের মন
অ-টুকুন বয়সেই তোলে আলোড়ন।
আলোকিত অধ্যায় যেই মেলে ধরে
নিভে গেলো সেই বাতি অমানিশা ঝড়ে!
আমরাও শোকাহত তাকে ভেবে তাই
প্রিয় এই ক্ষুদে মণি যেই শুনি নাই।
তবু তাকে খুঁজে ফিরি লেখনির কাজে
আর যেনো পেয়ে যাই প্রতিভার মাঝে।
‘রাইদাহ গালিবা’ সেই প্রিয় মুখ
শোকগাঁথা স্মৃতিতেই ভাসালো এ বুক।

বুকের আশ্রয় থেকে যন্ত্রণারা
এই নভেম্বরে অশ্রু হয়ে নামে
নভেম্বর এলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়
কি এক নিঃস্বতা প্রতিটি ক্ষণে টুপটাপ ঝরে।
নভেম্বর এলেই ঘুমন্ত স্মৃতিগুলো আততায়ী হয়

বোকার মতো কুইন তোকে ভাবি
তোর মুখের উপর নেমে আসা
অবিন্যস্ত চুলের ঝুরি
আমাকে কাঁদায়,
তোর চাঁদপানা মুখটা মরীচিকা হয়ে
ফুঁপিয়ে নড়ে ওঠে

মনের বাঁধানো ফ্রেমে।
নভেম্বর এলেই
কুইন তোকে হারানো যন্ত্রণারা
নেমে আসে নদীর স্রোতের মতো
নভেম্বর এলেই বুকের ভেতর দহন বাড়ে
কুইন তোর অনুপস্থিতির।

তোমার আমার এবং আমাদের
জল-মাটি-পাথরের পৃথিবীতে
বাস করে দৃশ্য আর অদৃশ্যের মধ‍্যবর্তী
এক অমিমাংসিত জগৎ,

তুমি আমার সেই পৃথিবীর বাসিন্দা
তোমার চোখের নীলিমায় লেখা যে পান্ডুলিপি;
তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে আঁকা
যে গল্পের ইতিবৃত্ত;

তোমার অস্তিত্বের অলৌকিক পৃষ্ঠায়
যে কালোত্তীর্ণ ভাবনাগুলো
যত্নে ধারণ করেছিলে
তা আমার বহুল পঠিত,

তুমি বেঁচে থাকলে
একবুক ভালোবাসায় বিস্তারিত
তুলির আঁচড়ে ক‍্যানভাস ভরে যেত
নিখাদ মানবিক মূল্যবোধে,

তুমি বেঁচে থাকলে
একটি তারকার উল্লসিত তারুণ‍্যে
জ্বলে উঠত মৃতজীবী জনপদ,
তুমি বেঁচে থাকলে

আঁধারের গা ছুঁয়ে জেগে উঠত
এক অত‍্যুজ্বল সকাল,
তুমি বেঁচে থাকলে
শোষনের শৃঙ্খল ভেঙে তৈরি হত

এক পবিত্র মানচিত্র,
তুমি বেঁচে থাকলে
কালোর বিনিময় মূল্যে
জন্ম নিতো এক উজ্জ্বল পৃথিবী।

সবুজ সম্ভাবনার এক আলোকিত বৃন্ত থেকে
তাই বুঝি ওরা ছিঁড়ে নিয়েছিল
কদর্য নির্মমতায় কেবল তোমাকেই,
আমাকে ক্ষমা কর তুমি কুইন।

ধীর হোক অক্ষের গতি
পৃথিবী থেমে যাক
তুমি এসো না
তুমি এসো না নভেম্বর

তুমি এসো না
তুমি এলেই উত্তরের হাওয়ায়
কেঁপে ওঠে পাতাবোনা ঘর
তুমি এলেই বাতাসে উবে যায়

ছাতিমের আবেশী ঘ্রাণ
তুমি এলেই পশ্চিমে কেঁদে ওঠে
পুবের ছাইরঙা বেড়াল
তুমি এসো না

তুমি এসো না নভেম্বর
তুমি এসো না…
ও নভেম্বর, তুমি এসো না
তুমি এসো না তো

তুমি এসো না
তুমি এলেই কাঁটাগাছের খোঁচায়
ক্ষত হয় কারো বুক
তুমি এলেই দুঃখহ্রদে

ভেসে যায় কারো চোখ
তুমি এলেই বেদনায়
নীল হয় পৃথিবীর শাদা বরফ…
এসো না তুমি নভেম্বর

তুমি এসো না
তুমি এসো না…
পৃথিবী সত্যিই থেমে যাক
থেমে যাক আহ্নিক গতি

সুমেরু সরে যাক দূরে
আরও দূরে
তুমি এসো না
তুমি এসো না নভেম্বর

তুমি এসো না
তুমি এলেই দরজায় ঠকঠক
ধীরপায়ে হেঁটে আসে মৃত্যু-কারিগর
তুমি এলেই

থেমে যায় হর্ষগীত— তরঙ্গরেখা
তুমি এসো না
তুমি এসো না নভেম্বর
তুমি এসো না!

তুমি এলেই কারা যেন
ফিসফিসিয়ে বলে—
‘থেমে গেছে সব…
সরলরেখা— ফ্লাটলাইন…!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *