সাক্ষাৎকার

সাহিত্যের দলাদলিতেও আমি চিরকালই লাস্টবেঞ্চার।। পাপড়ি রহমান




পাপড়ি রহমান। বাংলাদেশের সাহিত্যে অঙ্গনে এই মুহূর্তে যে কয়জন কথাসাহিত্যিক দাপুটে সৃজনশীলতার মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যজগতে বিচরণ করছেন কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, গবেষক ও অনুবাদক।
বড়চাচীমার দেয়া নাম ‘পাপড়ি’ রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালে ২০শে নভেম্বর, টাঙ্গাইলে। শূন্যলতার সঙ্গে বৃক্ষের যে নিবিড় বোঝাপড়া তেমনই সম্পর্ক ছিল বাবার সাথে। ( একলা পথের সাথী বই থেকে প্রাপ্ত), দুই কন্যা সন্তানের গর্বিত জননী এই লেখক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়ার অভ্যাগ তার ছোটবেলা থেকে, নিজের পাঠ সম্পর্কে লেখক এবার তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন নানা ধরনের বই আমি একই সঙ্গে পড়ি। সবকটি না পড়া হলেও বিছানায় বা লেখার টেবিলে রাখি। যেন ইচ্ছে হলেই টান দিয়ে পড়তে পারি। আদতে যখন যেটা ভালো লাগে সেটা পড়ি। পছন্দের তালিকায় আমার পাঠরুচির সঙ্গে খাপ খায় তেমন বই থাকে। যেসব বিষয় আমার অপছন্দ, তেমন বই পড়ি না। এখন পড়ছি সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’। এটা আমার রি-রিড। এই বইটি আমার পছন্দের বইয়ের তালিকাভুক্ত তেমন নয়। আমার বয়স যখন ১৪-১৫ তখন বইটি পড়েছিলাম। তখন বইটি অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছিল। এখন পড়ছি বইটি নিয়ে কাজ করতে হবে বলে। আমাকে লিখতে হবে- আমার পড়া প্রথম নিষিদ্ধ বই। ফলে ফের পড়তে হচ্ছে। আচানক কিছু ফরমায়েশের জন্য আমার ছকের বাইরের কিছু বই পড়তে হয়।

ইশকুল, কলেজে ও ইউনিভার্সিটির বার্ষিকীগুলোতে লেখালেখি দিয়ে কলমের সাথে কাগজের ঝোঝাপড়াটা তার অনেক আগেই। ধীরে ধীরে সেই বোঝাপড়াটা শক্ত গাঁথুন আকার পায় তার প্রতিটি গল্পে। সেকারণেই পাপড়ি রহমানের গল্পগুলো স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র বলছি, কারণ গল্পেগুলোতে গ্রামীণ ও নাগরিক উভয় পরিমন্ডলের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি উঠে আসে, থাকে শেকড়সন্ধানী ও সমাজবাস্তবতানির্ভর রচনা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে লেখা গল্প ও উপন্যাসগুলোতে দেখা যায় সেই জনপদের নিগুঢ় সত্যটা উঠে আসে। সে কারণেই সাহিত্যজগতে তার লেখায় স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি তার গল্পে তুলে এনেছেন বৈচিত্র্যময় মানুষের গল্প। বাংলাদেশের মানুষের নিত্যদিনের বয়ান তার গল্প অন্যরকম অস্তিত্ব খুঁজে পায়। হয়তো আপন অস্তিত্ব-অন্বেষার অভিপ্রায়, পরিবেশ পরিস্থিতি আড়ালে ঢাকা ক্লেদগুলোর আবরন বিচ্ছিন্ন হয়ে তার ছোট গল্পগুলোতে। বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈঃসঙ্গ্য, প্রেমজাত অস্থিরতা, টিকে থাকার সংগ্রাম, সমান্তরাল মনোভঙ্গি সক্রিয়ভাবে উঠে আসে গল্পের পরতে পরতে। শ্রেণীচেনতা আর মৌলিকত্ব-ভাবনা তাঁর অন্য একটি চিন্তাঅঞ্চল। যাপিত প্রজন্মপ্রহরে তিনি আত্মস্থ করতে থাকেন মানবিকবোধে গুলো। বাসস্থান স্থানান্তরজনিত, ঐতিহ্যবিচ্যুতির মতো অসহ্য যন্ত্রণা, সে কারণে বুকের ভেতরের কষ্ট যাপনের চিত্রগুলো লেখক তার সে চরিত্র উপস্থাপন করেন। আরো আছে ধর্মীয় পরিচয় লালিত বিভেদ আর প্রতিবেশী নিধনের প্রচলসত্য। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অনুভব করেছেন প্রতারণা-লোভ-অত্যাচার-হত্যাকাণ্ডই জীবনের শেষকথা নয়; সমূহ বিপর্যয় আর ধ্বংসস্তপের আড়ালে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রত্যাশা আর সৃজনধর্মের প্রবহমানতা।

প্রশ্ন: লেখালেখির শুরুটা  জানতে চাই। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে শুরু করলেন, না হঠাৎ কোনো আয়োজন ছাড়া কলম ধরলেন?

উত্তর: বড় অদ্ভুতভাবে শুরুটা হয়েছিল। ৯ বছরের এক বালিকার চারলাইনের ছড়া ছাপা হলো সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরীর পাতায়। আমার চারপাশের যাদের দেখছিলাম, তারা সকলেই প্রায় লেখালেখির চেষ্টা করছিলেন। কী একটা সময় তখন! বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাস্ট্র জন্মলাভের ঠিক পরের বছরগুলিতে সবাই শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগঠন এসব নিয়ে এমনভাবেই মেতে উঠে ছিল। তবে এটাকে ঠিক প্রস্তুতি বলা যায় কিনা জানিনা, আমি পড়ছিলাম সর্বভুকের মতো। যেখানে যা পেয়েছি, পড়েছি। কাগজের ঠোঙা থেকে শুরু করে নবীপীরআওলিয়াদের জীবনীগ্রন্থ। এমনকী ১৮+ এর লেখাগুলিও ১২/১৩ বছরে পড়া শেষ। তবে ১৮+ বিষয়টিই তো অবোধ্য ছিল আমার কাছে। দেখতাম লেখা আছে ১৮+, কিন্তু সেটা কী বা কেন আমি তো আর তা জানতাম না। তার মানে সেই শৈশব থেকে আমি লেখাপড়ার ভিতরেই থেকেছি বা থাকতে চেয়েছি। তাই বলতে পারো অনেকটা অবচেতনেই কলম ধরা। কেন লিখছি, কী লিখছি, কোথায় গন্তব্য কিছুরই ঠিকঠিকানা নাই, কিন্তু লিখছি। ছড়া,কবিতা, বহু পরে গল্প, উপন্যাস।    

প্রশ্ন: আপনার কি স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার?

উত্তর: হুম এটা সত্য। একে স্বপ্ন বলব কীনা জানিনা। তবে আমি শুধু লেখক হতেই চেয়েছি। আরেকটি বিষয় লেখালেখি ছাড়া আর কোনো কাজও আমি তেমন জানিনা বা পারিনা। বা অন্যকিছু তেমন আগ্রহ নিয়ে করিনি। তবে একটা সময় গার্ডেনিং করেছি। রেয়ার গাছের প্রচুর কালেকশন ছিল আমার। এখন আর গাছের যত্নে সময় দিতে পারিনা। যেসব কাজ দায়িত্বের মাঝে পড়েছে, সেসব কিন্তু এড়িয়ে যাইনি। হয়তো সেসব কাজ করেছি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে। করতে ভালো লাগেনি, তবুও জোর করে করেছি। আমার মনে হয়, লেখাটা একদম আমার দেহমনের সংঙ্গে যেন সম্পৃক্ত। এতে করে হয় কী, যখন লিখছি না বা রাইটার্স ব্লকে ধুকছি তখনও আমার তেমন মন  খারাপ  লাগে না। বিষয়টি এভাবে দেখা যায়, দেহ বিগড়েছে বলে মন আর সাড়া দিচ্ছেনা। আবার যখন লিখছি, দিনরাত ল্যাপটপে মাথা দিয়ে পড়ে আছি, তখনও তেমন উৎফুল্ল বোধ করি না।  কারণ আমি জানি, আমি লিখবই। কিন্তু কখন লিখব সেটা জানিনা।

প্রশ্ন: আপনার শৈশব- কৈশোর কোথায় কেটেছে? লেখক হতে সেই জীবনের ভূমিকা কতটা?

উত্তর: এসব নিয়ে আমি বিস্তর কথাবার্তা বলেছি। আমার জন্ম ঢাকায়, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। তিন-চার বছর বয়সে আমার দাদাবাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। সেটা মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের ঘটনা। ঐ যে দাদাবাড়ির খুবই আনন্দঘন পরিবেশ, যৌথ পরিবারে নানান খুটিনাটি বিষয় দেখে বড় হওয়া, আমার মনে হয় এটাই ছিল আজকের লেখক পাপড়িকে তৈরি করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। আমার শৈশব ছিল খুবই বর্ণাঢ্য। সেসব নিয়ে আমার একটা বইও আছে, নাম ‘মায়াপারাবার’। আমার ফ্ল্যাটের নামও আমি রেখেছি ‘মায়াপারাবার’। তাহলে বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই, কত মধুরতম স্মৃতি হলে বইয়ের নামে ফ্ল্যাটের নাম দিয়েছি। আমি ছিলাম আমার দাদীর খুব ন্যাওটা। আমার দাদী সংসারে থেকেও ছিলেন উদাসীন, সন্ন্যাসী টাইপ নারী। দাদীর খেয়াল ছিল আদাড়েবাদাড়ে, জলাজংলায়। আমাদের বিশাল বড় বাড়ির গাছলতাপাতা ঘুরেদেখেশুনে দিন চলে যেতো তাঁর। সে আমার প্রথম শিক্ষক,দার্শনিক ও ভরসার জায়গাও ছিল বটে। পরবর্তীতে আমার বড়চাচিমা ছিলেন আমাদের হাউজ টিউটরের মতো। আমাদের শাসন ও আদর দুটাই উনি করতেন। আমার কৈশোর কেটেছে সিলেট শহরে। তখন আব্বাই ছিলেন আমার গাইড,ফিলোসফার ও শেয়ারিং এর জায়গাও বটে। পিতাপুত্রীর এরকম সম্পর্ক খুব কম দেখা যায়। আব্বাকে নিয়ে লিখতে গেলে বড়সড় একটা বই হয়ে যাবে।   

প্রশ্ন: সংসার জীবন ও লেখক জীবন, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দুই জীবন সমান তালে টেনে নিচ্ছেন। কখনো সংঘাতের মুখে পড়েছে  দুই জীবন?

উত্তর: সংঘাত হওয়ার মতো কোনো স্কোপই নেই, কারণ আমি তো মনেপ্রাণে টপ টু বটম লেখক। লেখকই। গৃহীকেই কি সংসারী বলা হয়? তাহলে আমি গৃহী, সংসারী কি? সংসারী হয়তো নই তেমন। শুধুই সংসার স্বর্বস্ব জীবনযাপন আমার কোনোদিনই নয়। যেমন বাজারঘাট, কিচেন,ডাইনিং,ফ্রিজ,টিভি, খানাখাদ্য, শাড়িজামা কেনার নেশা, ব্যাংকিং, টাকা-আনা-পাইয়ের হিসাব এসবে আমি মগ্ন নই কোনোকালেই। এসব আমার আকর্ষণের জায়গাও নয়। তুমি জানো, আমি সুদীর্ঘ সময় ধরে নানান সংগঠনের সংগে যুক্ত আছি। সংগঠনের কাজও করে যাচ্ছি। বন্ধুদের সংগে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। তবে এও সত্য সংসারের দায়িত্বগুলিও আমি ঠিকঠাক পালন করি। একদম ২৪ঘন্টার লেখক জীবন পাইনি বলে আক্ষেপ হয় মাঝে সাঝে। আমি যাই করি, যত কাজই করি, আমার মন তো সারাক্ষণ লিখে চলে। কত কত চরিত্র নিয়ে ভাবছে সে দিবা−রাত্র। আমার মন তো সংসারী নয় কোনো ভাবেই। যার সাথে আমার মনের যোগ নেই, তার সাথে সংঘাতের প্রশ্নই ওঠেনা।
আমি শুধু ভাবি,
মানুষ আমি, আমার কেন পাখির মতো মন?

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সাহিত্যে নারী লেখকদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই? আপনি এখানে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছেন , না নারী হিসেবে নিরন্তর অবহেলার শিকার হচ্ছেন?

উত্তর: নারীর যুদ্ধ তো চিরকাল। নারীকে দুটো বিষয়ে একই সাথে যুদ্ধ করতে হয়,
এক. নারী হয়ে জন্মানোর জন্য।
দুই. নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে জানান দেয়ার জন্য।
আমি অবশ্য যাবতীয় কিছুই এভাবে ভাবিনা বা দেখিনা। নারীর লেখাকে আলাদা করার কারণও দেখিনা।  আমি বিশ্বাস করি কেউ ভালো লিখলে তাঁকে গ্রহনযোগ্যতা দিতেই হবে। দিতে হয়। সেটা দুদিন আগে হোক আর পরে হোক। এটা যেমন সত্য বহু পাঁচতারকার লেখক সম্মিলনে  আমার ডাক পড়ে না, (অবশ্য ডাকলেই আমি যাব, বা যাই সেটাও তো নয়) তেমন এটাও তো সত্য,  কেউ না কেউ ভালোবেসে, মর্যাদা দিয়ে আমার এত কঠিন লেখাপত্রও অনুবাদ করে ফেলে। আর দলাদলিতেও আমি চিরকালই লাস্টবেঞ্চার। কেউই নিজেদের পাতে আমাকে তেমন নিতে চায়না। নাকি বলব জাতে তুলতে চায় না (অথচ নিজের জাতপাত নিয়ে আমি কিন্তু মহানন্দে আছি)। এসব বরং আমাকে স্বস্তি দেয়। আমি কোনো গোষ্ঠীর নই, কেউ আমাকে দলভুক্ত করছে না, অথচ আমি  লিখে যাচ্ছি, বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব বই কেউ না কেউ পড়ছে। দ্বিতীয় মুদ্রণ হচ্ছে। অথচ দেখবে, যারা মহান লেখক বলে নিজেদের দাবী করে, ভুলেও আমার নামটি নিবে না। (টাকা ও ক্ষমতার খেলায় আমি চিরকাল পরাজিত। এবং তাই থাকতে চাই)। না নিক,কী যাবে আসবে তাতে? আমি মনে করি সিরিয়াস পাঠক অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ওরা ভালো বইটি ঠিকই খুজে নিবে। খুজে নেয়। কোনো কূটনীতিই তেমন কাজে আসে না।  

প্রশ্ন : ‘আমার একলা পথের সাথি’ অটোবায়োগ্রাফিকাল জার্নাল। যেখানে একজন নারী লেখক ঢাকা শহরে লিখতে এসে যেসব স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যায়, তা তুলে ধরেছেন। বলা যায় আপনার লেখক জীবন বা লেখক হয়ে ওঠার ঘটনাবলী। হঠাৎ সেই লেখক জীবন পাঠকের কাছে তুলে ধরার কারণ কী? যদি বলতেন আমাদের।

উত্তর: আমি আমার এই অমূল্য জীবনখানিকে সত্যিই উপভোগ করি। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। আমার সমস্ত জীবন এত ঘটনাবহুল আর মিরাকল আর বর্ণাঢ্য। একই সাথে এত ক্লিশে আর এত একাকীত্ব আর প্রগাঢ় বেদনার!এত মার খাওয়া, কত শত অপ্রাপ্তি আবার একই সংঙ্গে অনির্বচনীয় প্রাপ্তিতে টইটম্বুর। এই লেখাটি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল কবি সোহেল হাসান গালিব। ও আমাকে বলে যে, ঢাকা শহরের নানা সাহিত্যিক রাজনীতির মাঝ দিয়ে একজন নারী লেখক কী করে এরকম লেখক হয়ে উঠলো, সেসব নিয়ে আমি যেন একটা জার্নাল লিখি। ও  ওর ওয়েবজিন ‘পরস্পরে’ ধারাবাহিকভাবে ছেপেও দিয়েছিল লেখাটা। আমি বলতে চাই, এই বইটা কিন্তু একটা সময়কে ধারণ করে আছে। আমি মনে করি নারীরা, বিশেষ করে যারা নতুন লিখতে চায় বা লিখতে শুরু করেছে তাদের বইটা পড়া দরকার। কারণ এত কুটকৌশল ও কোণঠাসা করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার পরও আমি কিন্তু দমে যাইনি। লিখে গিয়েছি। প্রচন্ড পরিশ্রম করেছি ভালো লিখবার জন্য। বা এখনো সেটা করে যাচ্ছি। আর মানুষের আয়ূ কিন্তু দুইদিনের। একদিন আসার আর অন্যদিন যাওয়ার। মাঝে কোনো দিন কিন্তু নেই। কোনো দিন আর থাকে না। আমার লেখক হয়ে উঠবার ঘটনাপঞ্জি এই বইটাতে রইলো। তবে সবকিছু তো লিখে উঠতে পারিনি। এই বইতে আমার ‘বয়ন’ উপন্যাস প্রকাশকাল পর্যন্ত ঘটনাবলী লিখেছি। এই ধর, ১৭ বছর আগে যা যা ঘটেছিল সেসব। স্মৃতি তরতাজা থাকা অবস্থাতেই আমি লিখলাম কত পাহাড়,নদী, সমুদ্র, অরণ্য পেরিয়ে আজ আমি এই অবস্থানে পৌঁছেছি । এটা কিন্তু আমার জন্য আনন্দের। এই বইতে আমি লেখালেখি করতে এসে যাঁদের কাছে ঋণী সেসবই বেশি বলার চেষ্টা করেছি। আর যা দিনকাল পড়েছে ‘কৃতজ্ঞতা’ শব্দটি না কবে ভ্যানিশ হয়ে যায়?  এখন আর কেউ কারো কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। কৃতজ্ঞ থাকে না। সকলেই মহাজ্ঞানী মহাজন রূপে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করে।  

প্রশ্ন: আপনার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’─এই উপন্যাসে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর পারের জনজীবন এতটা বাস্তব করে কীভাবে তুলে ধরলেন? সেসব আমাদের যদি জানাতেন।

উত্তর : দেখো, আমার নিজেরই প্রচুর সমস্যা আছে, আমি যা কোনোদিন দেখিনি বা জানিনি সেসব নিয়ে কিছুই প্রায় লিখতে পারি না। হয়তো এটা আমার দূর্বলতা। মানে অনেক বেশি ইমাজিনেশন নির্ভর লেখা আমার দ্বারা সম্ভব হয় না। এই উপন্যাসটি লিখবার আগে আমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ওপারে গেলেই  অন্যজীবন। অন্যরকম এক জনপদ। এবং ওই জনপদের মানুষের জীবনাচার ঢাকাশহরে বসবাসকারীদের চাইতে একদম আলাদা। আমি খুব ভালো করে কেরানিগঞ্জের আগানগর ঘুরে দেখলাম। আম্মার ফুপাতো ভাইয়ের আটতলা বাড়ি আছে একেবারে বুড়িগঙ্গার তীরেই। আমি সেখানে থেকেছি টানা কয়েকদিন। অত উঁচু থেকে নদীটাকে দেখেছি। এবং দেখার জন্যই বার বার ওই মামার বাসায় গিয়েছি। নোট নিয়েছি। লোকজনের সঙ্গে আলাপ করেছি। ওই পারের প্রতিটা ঘাটে আমি সামান্যক্ষণের জন্য হলেও বসে থেকেছি। মাঝি ও ঘাটপারের লোকদের সাথে কথাবার্তা বলেছি।  আর একটা বিষয়, নদী ও জল আমার খুবই প্রিয় অনুসংগ। আমার মনে হয় নদীদের কথাবার্তা আমি যেন বুঝতে পারি। তবে এটা সত্য, এই উপন্যাসে আমি অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছি। আগের উপন্যাসগুলির দোষত্রুটি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। চরিত্রগুলিতে যথাযথ স্পেস দিয়েছি। এমনকী ডাইভারসিটিও রাখতে চেয়েছি।
জানিনা, কী বা কতোটা পেরেছি, আমার পাঠকেরাই তা ভালো বলতে পারবেন।

প্রশ্ন:  আপনার বিভিন্ন গল্পে দেখা যায় বিভিন্ন প্রাচীন লোকগাঁথা নিয়ে চরিত্রগুলো উঠে আসে, কিন্তু সেই চরিত্রগুলোকে আপনি বর্তমান সময়ের আদলে নিজেস্ব আঙিকে লেখেন। তখন সেই লোকগাথার পঙ্গক্তি ও বর্তমান চরিত্র মনে হয় একই, আগের ঘটনার আর বর্তমান সময়কে চমৎকার ভাবে আপনার লেখনিতে উঠে আসে। যেমন কমলাদীঘি গল্পটা। বা ছহি বড় সোনাভান। কিংবা ঘুম ও স্বপ্নের মাছরাঙা পাখি ইত্যাদি গল্পের কথা বলা যায়। এটা কেন করেন? মানে এই নির্মাণের পেছনের কারণ জানতে চাই।

উত্তর: গল্প লিখবার শুরু থেকেই আমি এ কাজটা করে যাচ্ছি। আদতে ওই যে আমার শৈশব। আমার শৈশব মানেই তো টেপাপুতুল, মাটির ঘোড়া, পাটের শিকা, আর পালাগান। বৈশাখে কাঁচা আম আর কাসুন্দি। বড় বড় ফুলতোলা তোরংগ নিয়ে নাইওরীদের বাপের বাড়ি যাওয়া। বাড়ির সামনের খাল দিয়ে পানসী নৌকার চলাচল। ছোটকাল থেকেই  যে কোনো লোকজ বিষয়াদি আমাকে অত্যন্ত আকর্ষণ করেছে। যেমন আমি কানে মাকড়ী পরতাম। বেলদুল। নাকে নথ। পায়ে আলতা। দেশীয় তাঁতের শাড়ি। এবং পুঁথি সাহিত্য, ময়মনসিংহ গীতিকা, বলতে গেলে মধ্যযুগের সমস্ত লেখাপত্রই আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যখন গল্প লিখতে শুরু করলাম, তখন সেসব ফের কৌশল করে পাঠকের সামনে হাজির করতে চাইলাম। এবং দেখবে যে,  উপন্যাস লিখবার সময়ও আমি লোকজ বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছি। এজন্য জামদানী তাঁতিদের জীবনাচার নিয়ে লিখেছি ‘বয়ন’ উপন্যাস। পালাকারদের নিয়ে ‘পালাটিয়া’। লোকজ মানেই কিন্তু আমার দেশ আমার জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এসবকে প্রাধান্য দিয়েই আমি লিখতে চাই। চেয়েছি। তাই এই প্রাচীন ও আধুনিকের সম্মিলন।

প্রশ্ন: সামনে একুশে বইমেলা। কী বই আসছে আপনার সেটা সম্পর্কে জানতে চাই।  

উত্তর: তুমি জানো যে আমি অনেক বেশি লিখিনি বা লিখতে চাইনি। তাই প্রতিবছর বই করা হয়ে ওঠে না। আগামী বইমেলায় আমার একটা উপন্যাস প্রকাশিত হতে পারে। যেটি আমি লিখতে শুরু করেছিলাম ২০১৯ থেকে। এই উপন্যাসের ১৪ পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল কালি ও কলমের ২০২২ এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়। এই প্রথম আমি নাগরিক জীবন ভিত্তিক কোনো উপন্যাস লিখে উঠতে পেরেছি। যদিও কাজটি খুবই দূরহ ছিল। আর প্রকাশিত হতে পারে আরেকটি গল্পের বই। কিংবা আমার লেখা প্রথম কোনো নভেলা। তবে গল্পের বইয়ের কাজ গুছাতে পারিনি। নভেলাটিও লিখে শেষ করতে পারিনি। দেখা যাক। কী হয়? ইদানীং শরীর একেবারে সুস্থ থাকছে না। এ ছাড়াও আমি তো ভয়ানক মুডি, লিখতে ইচ্ছে না করলে জোরজবরদস্তি করে লিখি না। লিখব না।  

প্রশ্ন: সাহিত্যিক জীবনে এমন কোনো ঘটনা আছে যা আপনাকে নির্জনে আনন্দে দেয়?

উত্তর: আমার দিনরাত্রি তো সাহিত্য নিয়েই কাটে। এবং আমার যা কিছু আনন্দ , তা আমার লেখাপত্র নিয়েই। মন ভালো করে দেয়া প্রচুর ঘটনা আছে। মন খারাপ করে দেয়ার মতো ঘটনাও কম কিছু নেই। সেসব একজীবনে লিখে যেতে পারব কীনা জানিনা। কেই-বা পায় অঢেল সময়?

প্রশ্ন: লেখালেখিতে কে বেশি উৎসাহ দেয়? পরিবার থেকে কোনো বাধা আসে?

উত্তর: আদতে পাঠকের মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়াই আমাকে লিখতে উদবুদ্ধ করে। তাছাড়া আমার নিজের ভেতরের তাগিদ তো আছেই। আমার যখন মনে হয়,এটা নিয়ে লেখা দরকার, তখুনি আমি লিখি। তবে একদম অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে তেমন কাউকে পাশে পাইনি। এই বয়সে পরিবার আর বাধা দিবে কী? বাধা দিলেই আমি শুনব নাকি? পরিবার বাধা দেয় না, কিন্তু খুব যে উৎসাহ দেয় তেমনও নয়।

প্রশ্ন: সমকালীন বা আপনার পরের প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে কিছু বলেন?

উত্তর: আমার সমকালীন লেখকদের নিয়ে আমি বহুবার অজস্র কথাবার্তা বলেছি। যারা ভালো লিখছে তারা তো আছেই। লিখেও যাচ্ছে ভালো লেখকেরাই। আমি নতুনদের লেখা পড়ি। আগ্রহ নিয়েই পড়ি। সবাই লিখছে, লেখার মতো প্রচণ্ড পরিশ্রমের কাজটি করে যাচ্ছে, আমি কী করে বলব কে ক্লিক করবে আর কে করবে না? এটার সমাধান জানে সময়। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরই শুধু জানা যায় কে রইলো আর কে রইলো না?

প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্যে গতিপথ নিয়ে কিছু বলেন।

উত্তর: বাংলা বা ইংরেজি বা স্প্যানিশ যে কোনো ভাষায় সাহিত্য রচিত হতে পারে। সাহিত্যের গতি কিন্তু নদীর মতো। বেগবান, স্রোতস্বিনী। কোথায় চর জাগবে বা পলি জমবে আগেভাগেই বলা মুশকিল। সেই চর্যাচর্য বিনিশ্চয় থেকে শুরু হয়ে ইতোমধ্যে বহুকাল তো কেটে গেলো। নদী যেমন আপন বেগে ধায়, বাংলাসাহিত্যও সেরকম ভাবেই তার নিজের পথ করে নেবে।    

প্রশ্ন: আপনার লেখা কোন গল্প বা উপন্যাস লেখার পরে সব থেকে বেশি আনন্দ পেয়েছেন?

উত্তর: এক বা দুই বাক্যে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে না। কিছু লিখে ওঠার পর আনন্দ হয় নাকি? আমি তো তা জানিনা। আনন্দ দূরে থাকুক আমার তো বিষণ্ণ লাগে খুব। লেখাটা উত্তম নাকি অধম হচ্ছে এটা কিন্তু একজন লেখকই টের পায় সর্বাগ্রে। একটা ভালো লেখা সম্পন্ন করবার পর আমি তো Melancholic হয়ে উঠি। কোনো উপন্যাস লিখবার পর এটা আরও বেশি করে আক্রান্ত করে আমাকে। কারণ একটা উপন্যাসের চরিত্রদের সঙ্গে আমার যে বছরের পর বছর যাপন, সেসব ফুরিয়ে যায় বলে। আমার দশা হয়, দূরন্ত বালকের হাতের লাস্ট ঢিলটা যখন ব্যাঙাচির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে পুকুরের ওইপারে পৌছায়। যখন তার হাতে আর একটা ঢিলও অবশিষ্ট নাই। কেমন বেকুব, বিষণ্ণ চেহারা করে সে তখন জলের ওপরের ছোট ছোট ঢেউগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ ঢেউগুলি তো ওই বালকেরই সৃষ্টি করা। কিন্তু এখন, আর কোনো ঢিল তার হাতে অবশিষ্ট নাই। যা দিয়ে সে জলের সঙ্গে আনন্দদায়ক খেলাটি খেলতে পারে। এ পর্যন্ত আমার লিখিত ৫টা উপন্যাস, যেসব শেষ হওয়া মাত্রই নিজেকে রিক্ত-নিঃস্ব মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, কবে আর হবে থাকিতে জীবন? আবার কবে আমি লিখতে পারবো তেমন কোনো উপন্যাস?

প্রশ্ন:  একজন লেখকের জীবনের সফলতা কীভাবে পরিমাপ করেন?

উত্তর: অন্যেরা কীভাবে নিজেদের সফলতা পরিমাপ করে, আমি তা জানিনা। আদতে লেখালেখি প্রফেসনটাই কিন্তু অপূর্ণতার। একজন নিবিষ্ট লেখক কী করে তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে নিজেকে সফল ভাবতে পারেন? বা অন্যেরা? আমি ঠিক জানিনা সফলতা বা ব্যর্থতা মাপা হয় কোন নিক্তিতে? যেখানে জীবন খুবই ক্ষণিকের। জালালউদ্দীন রুমীর এই কথাগুলি খেয়াল কর,

I’m drenched/in the flood/ which has yet to come/ I’m tied up/in the prison/ which has yet to exist/ Not having played/ the game of chess/ I’m already the checkmate/ Not having tasted/ a single cup of your wine/ I’m already drunk/ Not having entered/ the battlefield/ I’m already wounded and/ slain/ I no longer/ know the difference/ between image and reality /Like the shadow/ I am /And/ I am not…

এইসব মাপামাপির কোনো মানে হয় না। কীইবা চিরস্থায়ী?
তারপরও যদি বলতে বলো, তাহলে বলি, একজন লেখকের পরিচয় অতি অবশ্যই তার টেক্সট। তার গ্রন্থাবলী। মঞ্চ, আলো, শানশওকত, সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ একজন লেখকের থাকা উচিত নয়। একজন নিবিষ্ট লেখক এসবের জন্য কাঙাল থাকে বলেও আমার মনে হয় না।
অবশ্য আমি যা ভাবছি, তা অন্যকে গ্রহণ করতেই হবে, এমনও নয়। সফলতার প্রশ্নে আমি যা ভাবি, তা প্রকাশ করলাম। অন্য কেউ আমার মত আর পথের হবে এরকম চিন্তাও আমি করি না।
অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই তোমাকে এত কষ্ট করে প্রশ্নগুলি সাজানোর জন্য। সেই সঙ্গে ভালোবাসা ও আন্তরিক শুভকামনা। আমার পক্ষ থেকে কাব্যশীলনের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভাশিস ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *