সাহিত্য চর্চা কোনো আনন্দের বা বিলাসিতার বিষয় নয় ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর, কথাসাহিত্যিক। ছোটোগল্প, উপন্যাস লিখেন। এ ছাড়াও গবেষণা এবং অনুবাদের জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি, নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন, রবীন্দ্রনাথের দেখা বাংলাদেশকে তুলে ধরে মননশীল প্রবন্ধ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫ নভেম্বর ১৯৬৫ সালে। লেখা শুরু করেছিলেন কৈশোরে, প্রথম গল্প সুখী ১৯৮১ সালেই স্থানীয় দৈনিকের সপ্তাহের সাময়িকীতে প্রকাশ হলে সুধী মহলে প্রশংসিত হয়। লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ ভোরের জন্য প্রতীক্ষা প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা– ১০। গল্পগ্রন্থ–৭, প্রবন্ধগ্রন্থ ১টি, গবেষণাগ্রন্থ –২।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের গল্প-উপন্যাসে নতুন বিষয় ও বিচিত্র আখ্যান, একদিকে ইতিহাস চেতনা অন্যদিকে সমকালীন সমাজ নিরীক্ষণ এবং তাঁর নিজের ভাষা শৈলী ও বয়ান অন্য লেখকদের থেকে আলাদা করে চিনিয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থেই সমাজ সমাজ জীবন, মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা গভীর অন্তরদৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থের চেতনাগত ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দীর্ঘ চল্লিশ বছর লিখে চলেছেন।
পুরস্কার: কথাসাহিত্যের বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন। সোনার বাংলা সাহিত্য পরিষদ (এসবিএসপি) পুরস্কার ও সাহিত্যের সামগ্রিক অবদানের জন্য। বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
গল্পগ্রন্থ : ভোরের জন্য প্রতীক্ষা, উত্তরসূরিগণ, রবীন্দ্রনাথ উপমা এবং আমি, মরণচাঁদের রবীন্দ্রনাথ, মাননীয় মন্ত্রীর জন্য মানপত্র, পুষ্পিত ফাগুন সায়াহ্নের আগুন, ভেগাসের রঙ্গশালায় বিদেশিনীর সঙ্গে। প্রকাশের পথে গল্পগ্রন্থ নিম্নবর্গের গল্প এবং বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ ও আত্মজীবনী।
উপন্যাস : উদ্বাস্তু, সোলেমন, কেঁচো, জাল থেকে জালে, মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল, বিলডাকিনি, দায়ভাগ, আদমসুরত, থাকে শুধু অন্ধকার। ইংরেজি উপন্যাস এ টেল অব রোহিঙ্গা।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের প্রথম উপন্যাস উদ্বাস্তু ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়। এটি বাংলা সাহিত্যে বিষয়গত দিক থেকে এক নতুন সংযোজন। জানা মতে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু জীবন এবং নৃতাত্ত্বিক ভাবনা থেকে এর আগে কোনো সাহিত্যই রচিত হয়নি। বিষয়টির সংকট তখনও বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার ছিল না, এর ভবিষ্যৎ কতটা মারাত্মক আকার নিতে পারে সেটা উদ্বাস্তুু উপন্যাসে লেখক তখনই তুলে ধরে ছিলেন। রোহিঙ্গা সমস্যা ২০১৭ সালে নতুন রূপে দেখা দিলে লিখেন উপন্যাস সোলেমন।
‘কেঁচো’, নিম্নবর্গের মানুষের আখ্যান নিয়ে রচিত উপন্যাস, যাতে ভূমিহীন চাষীদের জীবন ও তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নের কথা, স্বপ্ন ভাঙার মর্মন্তুদ গল্প তুলে আনেন নিপুণ সৃজনশীল কৌশলে। একই চেতনাজাত উপন্যাস ‘জাল থেকে জালে’, কিন্তু সমাজ প্রেক্ষাপট ভিন্ন, যাতে তুলে আনা হয়েছে চলনবিলের ভূমিহীন মৎস্যজীবীদের জীবনের ছবি। লেখকের সময় চেতনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে ‘মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল’ উপন্যাসে। এতে তিনি রবীন্দ্রনাথের দেখা বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদ পতিসরের প্রেক্ষাপটে গ্রামসমাজের বর্তমান বাস্তবতা চিত্রিত করেছেন। তাঁর বিশেষ উল্লেখযোগ্য তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস– ‘বিলডাকিনি’, ‘দায়ভা’’ এবং ‘আদমসুরত’। বন্ধ্যা সমাজের বিপরীতে নারীর মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আর জাগরনের সমকালীন শিল্পীত বয়ান এ ত্রয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন বলে গন্য হবে। ‘বিলডাকিনি’ সরকারি অনুদানে ইতোমধ্যেই চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর দ্বিভাষী লেখক। তিনি ইংরেজিতে উপন্যাস লিখেছেন, ‘এ টেল অব রোহিঙ্গা’, যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর প্রথম ইংরেজি উপন্যাস। অনুবাদ করেছেন মোশে ইয়েগার-এর দি মুসলিম অব বার্মা।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ’Traditional Medicine in Bangladesh’ I ‘Impact of special assistance programme on ethnic communities living in Plainland Bangladesh’।
কথাসাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও প্রাবন্ধিক বঙ্গ রাখাল।
১. আপনার কোথায় বেড়ে ওঠা? সেখানকার পরিবেশ কতটা আজকের আপনাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে?
আমার জন্ম ১৯৬৫ সালের ৫ নভেম্বর, এক অজপাড়াগাঁয়ে, এক নিম্নবিত্ত পরিবারে। পশ্চাদপদ গ্রামটাকে এখনকার গ্রামের সাথে মেলানো যাবে না। গ্রামের পাশ দিয়ে জেলাবোর্ডের মাটির একটা রাস্তা ছিল ছ মাইল দূরে জেলা শহরে যাওয়া যেত হেঁটে অথবা সামর্থ্য ছিল তারা রিক্সায় মহকুমা শহরে যাতায়াত করত। গ্রামের বাড়িগুলো ছিল নানারকম গাছপালায় আচ্ছাদিত, পাড়ায় আর গুচ্ছ বসতির। গাঁয়ের চারপাশে ছিল ফসলের ক্ষেত। এ পাড়া ওপাড়ায় ছিল পারিবারিক ও আত্মিক সম্পর্ক। আমাদের শৈশব কেটেছে মধুর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। শৈশবেই চেনাজানার সুযোগ হতো। একসাথে স্কুলে যাওয়া, মাঠে খেলা করা, হাঁটে যাওয়া, ডোবায় আর ভারি বর্ষণের পর মাঠের পানি নেমে যাবার খালে জাল পেতে মাছ ধরা, বর্ষার জলে সাঁতার কাটা, শাপলা-শালুক তোলা, আমনের ক্ষেতের পাশে কৈ মাছের জাল পেতে মাছ ধরা, শীতের সকালে পাড়ার পূর্বপাশে নাড়া আগুনে পুড়িয়ে উষ্ণতা নেয়া এসবের মধ্য দিয়ে আমার শৈশব কেটেছিল।
একাত্তরের আমার মনে আছে ভালোই। এর আগেই নৌকার পোস্টার ঘরে ঘরে সাঁটানো হয়েছিল। শেখ মুজিবের ফটো তখনই দেখি। শ্লোগানে মুজিবের নাম শুনি। তখনও স্কুলে আমি যাই নি। জেলাবোর্ডের পথে মিছিল যেতে দেখেছি, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার নেতা আমার শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ শুনতে শুনতেই একদিন ভোর বেলায়, বৈশাখের প্রথম দিনে আমাদের ঘর বাড়ি ছেড়ে আরও দূরের গ্রাম সাদেকপুর পালাতে হয়েছিল। সেদিনই মেঘনার লালপুর ঘাট থেকে পাকিস্তানি বাহিনি ব্র্রাাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে মার্চ করেছিল গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে, পথের পাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে দিতে। আমরা পালাতে পালাতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের পাড়া আর গ্রামের সকল যুবকই মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিল। পাকবাহিনি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলে পর আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম শহরে আমার নানা বাড়িতে।
শহরে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত টহল দিত, মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য জানতে চাইত রাজাকারেরা। আমার নানা আর পিতা সাধারণ চাষি, তাদের বয়সও কম ছিল না। সারাক্ষণ ক্ষেতেই কাজ করত। ফলে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তারা নির্যাতনের শিকার তেমন হয় নি। তবে আমার খালাদের লুকিয়ে থাকতে হতো। আমরা যারা শিশু ছিলাম আমাদের বলা হয়েছিল কাউকে কিছু না বলতে। আমরা যে কোনো প্রশ্নের জবাবে বলতাম, জান্তা নাহি, জানি না। মুক্তিযুদ্ধের শৈশব স্মৃতি আর পরের নির্ভেজাল গ্রামের প্রকৃতি, সমাজ, মানুষের অভাব, নিজের বিত্তহীন পরিবারের বেঁচে থাকার সংগ্রাম আমাকে গড়ে তুলেছে। আমার লেখায় সেসব কোনো না কোনো ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
২. আপনার প্রথম প্রকাশিত লেখার নাম কি? কত সালে এবং কোথায় প্রকাশিত হয়?
শৈশবেই আমি কল্পনাপ্রবণ ছিলাম। গ্রামের পথে একাকী হাঁটার সময় নানা বিষয় নিয়ে ভাবতাম। আর সন্ধ্যার পর একা হাঁটতে গেলে মনে হতো অশরীরী কেউ যেন হাঁটছে। দ্রুত হেঁটে গেলে মনে হতো সেও দ্রুত পিছু হাঁটছে। গা ছম ছম করত। স্কুলে একা যাওয়ার পথেও কত কী ভেবেছি। এখন সবই মনে হয় মনের ভেতরে এসব গল্প ছিল। পরে লিখেছি। কৈশোরে পথ চলতে চলতে মানুষ দেখতাম। নানারকম মানুষের মুখ আমাকে আকৃষ্ট করত। হ্যাঁ, ধার করে হলেও বই পড়তে ভালো চাইতাম। যার কাছে যে বই পেতাম তাই পড়তাম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েছিলাম কয়েকটি রূপকথার গল্প। এগুলো মুখস্ত হয়েগিয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্লাসের বাংলা বইতে যা গল্প, কবিতা, গদ্য যা ছিল সব আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস সিক্সে আমি জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে এবং আরও কিছু ভালো উপন্যাস পড়ে ফেলি। এসএসসি’র পর পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে শুরু করি। পড়ে ফেলি সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, শরৎচন্দ্র, জরাসন্ধ, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ ছাড়াও বেশ কিছু বই। পড়ে ফেলি তলস্তয়ের ওয়ার এন্ড পিস, হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পাতাকার্স-এর মতো উপন্যাসের অনুবাদ। পড়ে ফেলি আরজ আলী মাতুব্বরের বই। এসব আমাকে চিন্তার নতুন জগতে নিয়ে যায়। আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর সমাজ আমাকে গোপনে লিখতে বলে। এস এস সি’র পর ১৯৮১ সালের জুনে এক রাতে একটা গল্প ‘সুখী’ লিখে ফেলি, যা কদিন পর স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে ছাপা হয়ে গেল। আমার পিতা গল্পটা পড়ে খুশি হলে আমি উৎসাহিত হই। এভাবেই আমার গল্প লেখার শুরু। এর পর লিখে যেতে থাকি। কম লিখেছি, কিন্তু কখনো লেখা বন্ধ করি নি।
৩. সাহিত্যে নারীর ভূমিকা কতটুকু?
সাহিত্যে জীবন, সময়, সমাজই আসল বিষয়। নারী পুরুষ আলাদা করে ভাববার দরকার নেই। আসলে গল্পে চরিত্রই মূল কথা সেটা হোক নারী, পুরুষ, শিশু বা আর কেউ। গল্পের প্রয়োজনে নারীকে যথাযথভাবে চিত্রায়ন করতে হয়। নারীর চরিত্র পুরুষ যদি তার জানাশোনার গণ্ডির মধ্যে থেকে লিখেন তাহলে সীমাবদ্ধতাদুষ্ট হবে। নারী চরিত্র গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হয়, নারীর সামাজিক অবস্থান, আর্থিক অবস্থান, পারিবারিক অবস্থান, জৈবিক অবস্থান, তার মাতৃত্ব ইত্যাদি সব মিলিয়ে সে নারী হয়ে ওঠে। কোনোদিক বাদ দিয়ে নারী চরিত্র চিত্রায়ণ করা খণ্ডিত হবে। একজন লেখক নারী চরিত্র অংকনের সময় নিজেকে পুরুষের অবস্থান থেকে মুক্ত করতে হবে, তাকে লেখক হতে হবে, যে পুরুষ নয়, নারী নয়, নারীর সহধর্মী নয়, সে কেবল লেখক। নারী একজন মানুষ, তার সীমাবদ্ধতা, তার প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায় সাহিত্যে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হলেই প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্য হবে।
আর যদি প্রশ্নের উত্তর এমন দিতে হয় যে, সাহিত্যে নারীর অবদান কতটা সেটা ভিন্নমাত্রা যোগ করে। এটা আদতে প্রশ্ন হওয়া উচিত নয়। সাহিত্যে তো নারীর অবদান পরিমাপযোগ্য নয়। একজন লেখক সে পুরুষ হোন আর নারী হোন তার অবদান মৌলিক কিনা সেটাই বিবেচনাযোগ্য।
৪. আপনার উপন্যাস ‘উদ্বাস্তু’ কত সালে প্রকাশিত হয় এবং এর বিষয় বস্তু কি?
আমি উদ্বাস্তু উপন্যাস লিখি ২০০১-০২ সালে। এটা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর পড়ালেখার ভিত্তিতে লিখেছি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে গিয়ে এই নৃগোষ্ঠীকে জানা বোঝার সুযোগ হয়েছিল, সে জানাশোনা থেকে লেখা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে পৃথিবীর জাতিসমূহের, এমন কি বাঙালির, বাংলাদেশের মানুষের সঠিক ধারণা নেই। এদের নৃত্ত্বাত্তিক ইতিহাস না জেনেই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকার পর্যন্ত ভুল পরিচয়ে এদের অভিহিত করে থাকে। যদি কেউ ড. মোশে ইয়েগার-এর দি মুসলিম অব বার্মা গবেষণাগ্রন্থটি পড়েন তাহলেই তাদের ভুল ভাঙবে। এই গবেষণা ১৯৬১-৬৪ সালে রেঙ্গুনে সরজমিন প্রাইমারি তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। বাংলা অনুবাদ আমি নাসিফ খালিদ স্বাধীনের সহযোগিতা নিয়ে করেছি। এই গবেষণা এবং রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য যাচাই করে আরাকানের বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমণ করে উদ্বাস্তু উপন্যাস লিখেছি। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় ২০০৬ সালে। পরের বছর আগামী প্রকাশনী বই প্রকাশ করে। এর তৃতীয় সংস্করণ ২০২১ সালে প্রকাশ করেছে ভূর্জপত্র নামে একটা নতুন প্তকাশনী। উদ্বাস্তু উপন্যাসের ইংরেজি ভার্সন এ টেল অব রোহিঙ্গা লিখেছি ২০১৪ সালে যা ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৫. গল্পের জীবন এবং বাস্তবতার জীবন কিভাবে ব্যাখ্যায়িত করবেন?
গল্পের জীবন বাস্তবজীবনের প্রতিচ্ছবি বলে আমি মনে করি। আমরা যা দেখি তাই গল্পে ধরা দেয়। তবে আমরা যা প্রত্যাশা করি লেখক গল্পে সেটাও দেখাতে চান। হয়তো এমন হয় কোনো চরিত্র সরাসরি নামে আসে না, এর ছায়া থাকে, আদল থাকে, রূপক থাকে, কাক্সিক্ষত চরিত্রও গল্পে থাকে। গল্পে সময়কে ধারণ করা হয়, দুঃসময়ের পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হয়। অন্ধকারের বিরুদ্ধে লেখকের অবস্থান থাকে, মানুষের বেদনা তিনি অনুভব করেন, নষ্ট সমাজের বদল চান লেখক, পাঠকের কাছে সত্যটা তুলে ধরতে বাস্তবতা অবলম্বন করেন গল্পে, পাঠককে ভাবতে বলতে চান গল্পের মধ্য দিয়ে। লেখক তো রাজপথে নেমে কথা বলেন না, বলেন কলম দিয়ে। পাঠক সবসময় লেখা চিনতে পারেন না, লেখক চিনতে পারেন না। কোনো কোনো লেখক পাঠককে বিভ্রান্তও করেন লেখার মাধ্যমে, ভুল তথ্য দিয়ে, কাল্পনিক গল্প ফেঁদে, যাতে অপরিপক্ক পাঠক সিদ্ধান্ত নিতে, চিন্তায় ভুল করেন।
৬. আপনার সাহিত্যে বারংবার নিন্মবর্গের মানুষের জীবন-যাত্রা উঠে আসে এর কারণ কি?
আমি নিজে নিম্নবর্গের সমাজ থেকে উঠে এসেছি। আজ আমার অবস্থান নিম্নবর্গের সমাজে নয়। কিন্তু আমি আমার অতীত ভুলে যাই নি, আমার শেকড় ভুলে যাই নি, আমার শৈশবের সমাজ সেই জায়গায় রয়ে গেছে। আমি এ দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছি, নানান শ্রেণির মানুষকে সেবা দিয়েছি কর্মজীবনে। তাদের কাছে গিয়ে আমি আমার শৈশব, নিম্নবর্গের জীবন দেখেছি। জীবনের অসহায়ত্ব আমি অভিজ্ঞতা ও আমার নিজের জীবন ও পরিবার থেকে উপলব্ধি করেছি। জীবনের জাগরণের বিষয়টা উপলব্ধি করেছি পঠন পাঠনের মাধ্যমে। আর এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থান নিম্নবর্গের সমাজে। তারা শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত এখনো। এখনো গণতন্ত্রের নামে সামন্ততান্ত্রিক শাসন শোষণই বিদ্যমান। আমি মনে করি, সাহিত্য চর্চা কোনো আনন্দের বা বিলাসিতার বিষয় নয়, নাম কুড়ানোর জন্য সাহিত্যচর্চার দরকার নেই। আমি আমার সাহিত্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুখ, দুঃখ আর জাগরণের কথা বলতে চেয়েছি, বলতে চাই।
৭. ‘কেঁচো’ আখ্যানের চিন্তা আপনার মাথায় কিভাবে আসল? বিস্তারিত জানতে চাই?
আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসতে হয়। ‘কেঁচো’ নিম্নবর্গের উপন্যাস। কেঁচোকে প্রাকৃতিক লাঙল বলা হয়। ছোট বেলায় পাঠ্য বইতে পড়েছিলাম। কর্মজীবনে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি ভূমিহীন বর্গাদাররা অপরের জমি চাষ করে ফসল ফলায়, বেশিরভাগ ফসল ভূস্বামী নিয়ে নেয়, এরা কোনো রকমে জীবন ধারণ করে। যদিও নতুন চরের খাস জমি সরকারি আইন অনুযায়ী এদের পাওয়ার কথা, হয়ত দেখা যায় কাগজে তারাই পায়, কিন্তু বাস্তবে এই জমির দখল পায় না, পেলেও হাতছাড়া হয়ে যায়। ভূস্বামী কেড়ে নেয়। এ জমি বর্গাচাষিরাই চাষ করে, ফসল ভোগ করে ক্ষমতায় যারা থাকে সেসব ভূস্বামী বা জোতদার। এই উপন্যাসে এদিকটাই তুলে ধরা হয়েছে।
৮. জীবন সম্পর্কে আপনার মতবাদ কী?
আমি একটা মানবিক জীবন যাপন করতে চেয়েছি। মানুষের প্রতি অবিচার করি নি, অন্যায় প্রশ্রয় দিই নি, সব সময় প্রতিহত করতে পারিনি, কিন্তু নিজে অন্যায় করিনি। সৎ জীবন যাপন করেছি। পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছি। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি নিবেদিত থেকেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেছি, সব সময় লালন করেছি, কারো বিচ্যুতি দেখে কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু নিজে বিচ্যুত হই নি। এ দেশ যা দিয়েছে, যতটুকু সম্মান দিয়েছে তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ।
৯. কি নিয়ে ব্যস্ত এখন?
ভাবছি, পড়ছি, লিখতে চেষ্টা করছি। কিছু চিন্তা আগেই করা ছিল সুস্থ থাকলে সেগুলো লিখব। যে জীবন যাপন করেছি সেটা লিখব ভাবছি। যা সম্প্রতি দেখছি সে ভাবনা স্থিতু হলে আর সময় পেলে লিখতে চেষ্টা করব।
১০. বর্তমানে সমাজ কাঠামোর নড়বড়ে অবস্থার জন্য কে দায়ী বলে মনে করেন?
পুরো জাতি দায়ী। আগের প্রজন্ম, আমাদের প্রজন্ম, নতুন প্রজন্ম সকলেই দায়ী। কেউ দায় এড়াতে পারে না। সবাই মিলেই দেশ আর সমাজটাকে নষ্ট করেছি। আমাদের ভোগবাদী জীবনের আকাঙ্ক্ষা আর অতিলোভ, দেশপ্রেমের অভাব, ব্যক্তিগত ক্ষমতার চর্চা আমাদের অধ্বঃপতনের কারণ।
১১. সাহিত্য কি আমাদের জীবন গঠনে কোন ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন?
সাহিত্য পাঠ করলে আর সাহিত্য থেকে পাঠক কিছু গ্রহণ করলে সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে। একসময় সেটা ছিল। সব যুগেই সাহিত্যদ্বারা প্রাণিত হতে পারে তরুণ প্রজন্ম। এখনকার তরুণ প্রজন্ম যা পড়ে সেগুলো বাজারি সাহিত্য, বা ফেইসবুক। এখন সাহিত্য চিনিয়ে দেবার জন্য কোনো ভালো সমালোচক নেই। যারা আছেন তারা চাটুকার, তেলবাজ। তরুণ তরুণীরা এদের কথায় বিশ্বাস করে না। সাহিত্য না প্রবন্ধের নামে যা রচিত হয় তার অধিকাংশই বিজ্ঞাপন। ভালো সাহিত্য তরুণণ প্রজন্ম চেনে না, এর চাইতে বেশি চেনে ফেইসবুক। ফলে এখন সাহিত্য সমাজে কোনো প্রভাব রাখছে না।
১২. বর্তমানের সাহিত্যিকেরা নিজেদের উত্তর-আধুনিক হিসেবে দাবি করছে; এদের দাবি কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
আধুনিক হয়ে তার পর উত্তরাধুনিক হতে হয়। উত্তরাধুনিক শব্দটা বিভ্রান্তিকর। আধুনিকের পর আর কোনো কাল নেই। সমসাময়িক কালে সময়কে যথাযথভাবে ধারণ করে যে সাহিত্য রচিত হয় তার বাইরে আবার কী সাহিত্য রচিত হবে? কেমন করে? বরং সমকালীন সাহিত্যকে বুঝতে না পারলেই নানা রকম মতবাদ আমদানি করার প্রবণতা দেখা দেয়। উত্তরাধুনিক সাহিত্য কাকে বলে আমার জানা নেই।
১৩. আপনার উপন্যাস ‘বিলডাকিনি’ নিয়ে সরকারী অনুদানে চলচ্চিত্র হচ্ছে এটা আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদÑতবে কাগজের গল্প এবং চিত্রায়িত গল্পের মধ্যে কি কি পার্থক্য রয়েছে বলে মনে করেন?
বিলডাকিনি উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যারা উপন্যাসটি পড়েছেন এবং চলচ্চিত্রটি দেখবেন তারা বলতে পারবেন দু’টোর মধ্য কোনটা সফল আর সার্থক।
১৪. পাঠকের জন্য আপনার ভাবনা কি?
পাঠকের প্রতি আমার অফুরান ভালোবাসা। শ্রদ্ধা। আমি পাঠকের কাছে লেখার সমালোচনা আশা করি নিজেকে ঋদ্ধ করার জন্য। কামনা করি, বই থেকে দূরে থাকবেন না, ভালো বই নিয়ে কথা বলুন, ভালো লেখা নিয়ে ভাবুন, অপাঠ্য বই আপনার ঘরে তুলবেন না। বাংলা সাহিত্য পাঠকের পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হোক।