প্রবন্ধ ।। বাংলা কবিতা, ছন্দ ও এর চাল চলন ।। ইলিয়াস ফারুকী ।।
কবিতা কি? এ জিজ্ঞাসা অনেকের। কবির হৃদয়ের স্পর্শকাতর অনুভূতি শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার- উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করাই হলো কবিতা। কিংবা একটু ব্যাখ্যা সহকারে বলা যায়, কবিতা, কাব্য বা পদ্য হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস- যা একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অতি অবশ্যই উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে ছন্দের মাধ্যমে শব্দের গাঁথুনিতে মোহময় আন্দোলিত সৃষ্টির উদাহরণ। বেশির ভাগ লোকই পদ্য এবং কবিতাকে এক করে ফেলেন। এখন যা কবিতা নামে সমধিক পরিচিত এক সময় পাঠকের নিকট তা পদ্য হিসেবেই পরিচিত ছিল। কবিতা এবং পদ্যকে এক কথায় কবিতা বললেও এ দুই শব্দের মাঝে সূক্ষ্ম হলেও একটা পার্থক্য রয়েছে। পণ্ডিতদের মতে, পদ্য হলো তাই যে রচনায় মাত্রা মেনে ছন্দ রয়েছে, দু’একটা পদের পুনরাবৃত্তি রয়েছে, এবং পাঠ করার সময় তাল, লয়ের একটা চমৎকার প্রবাহ কণ্ঠে উঠে আসে। পদ্যের বিষয়বস্তু অগভীর হালকা এবং সহজবোধ্য। অপর দিকে কবিতা হলো গভীর, রহস্যময় এবং চিরন্তন। প্রকৃত কবিতা একবার পাঠান্তে এর গভীরে প্রবেশ করা যায়না। প্রকৃত কবিতা প্রেমীদের পাঠ পিপাসা অন্তহীন। পদ্য কিংবা কবিতা যাই বলা হউক এর মূল পোশাক অবশ্যই ছন্দ ও মাত্রা। কবিতা যারা বোঝেন। পড়েন কিংবা নিয়মিত চর্চা করেন এধরনের লোকের বাহিরেও এক বিশাল সংখ্যক লোক রয়েছে যারা কবিতার সাধারণ অথচ নিয়মিত পাঠক। তারা কবিতাকে ভালোবেসেই কবিতা পড়েন। কিন্তু খুব স্পষ্ট করে কবিতা ও পদ্যের মাঝে প্রভেদ বুঝেন না। এ শ্রেণীর কাছে সহজ পাঠ্য এবং অন্ত্যমিল সম্পন্ন কোন লেখাই কবিতা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার কথা-
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।।
একটি সকল মহলে জনপ্রিয় কবিতা। এই কবিতার জনপ্রিয়তার কারণ এর সহজ প্রকাশ এবং অন্ত্যানুপ্রাস। সাধারণ পাঠক এই অন্ত্যমিলকেই ছন্দ জ্ঞান করে। কিন্তু কবিতা বোঝেন এবং ছন্দ বোঝেন এমন পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন যে ‘কবর’ কবিতাটি মাত্রা মেনে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যানুপ্রাসে লেখা একটি পদ্য কবিতা। উপরের এতো বিশদ আলোচনার পেছনে একটিই কারণ। একটি সহজ সংজ্ঞা দিয়ে কবিতা ও পদ্যের প্রকৃতিকে বোঝানো। সাহিত্য একটি শিল্প মাধ্যম আর এই শিল্প মাধ্যমের সবচাইতে পুরনো শাখার নাম কবিতা। এককভাবে এর সংজ্ঞা দিতে হলে বলব কবিতা, কাব্য বা পদ্য হলো একজন কবির আবেগ, উচ্ছ্বাস, অনুভূতি ও তাঁর জীবনের উপলব্ধিকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করা এবং এই প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে কবিতাকে শিল্প মণ্ডিত করা যা হবে রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, মিথ এবং চিত্রকল্পের সহযোগে একটি চমৎকার শব্দ শিল্পের উপহার। কবিতা ও পদ্যকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হলে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য দৃষ্টির গোচরে নিতে হবে। ছড়া কিংবা কবিতা সকলই পদ্য কিন্তু তবুও এদের প্রত্যেকের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন;
পদ্য কবিতা কবির ভাবকে খুব সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করে। এর ছন্দ এবং অন্ত্যানুপ্রাস থাকে। যা পূর্বেই আলোচনায় এসেছে। অর্থাৎ একটি পদ্য যে ভাষায় লেখা হবে আর আক্ষরিক অর্থছাড়া অন্যকোন ভাবে অর্থ খুঁজতে হবে না। পদ্যে উৎপ্রেক্ষা, উপমা, রূপকের ব্যবহার কম হয়ে থাকে। কিন্তু কবিতায় ভাব গভীরে যেমন প্রকাশের শিল্পিত রূপ থাকবে তেমনি প্রকাশ ভঙ্গি ও থাকবে অর্থবহ। আধুনিক কবিতায় মিথ, রূপক ইত্যাদির ব্যবহার থাকে খুব সাবলীল।
আবার কাব্য হলেই তাতে ছন্দ থাকতে হবে এ কথা ঠিক নয়। কাব্যের মূলটা তার রস বোধে। এ প্রসঙ্গে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘ছন্দ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা সর্বস্তরে আছে : যা কিছু ছন্দে বাঁধা সেটাই কবিতা। ছন্দই যেন কবিতা! কিন্তু নয়। কবিতা ছন্দে নেই, ছন্দ তার এক বিশেষ পোশাক মাত্র- বাইরে বেরুবার- পাঠক শ্রোতার দরবারে হাজির হবার। অন্য পোশাকে এলে যে সমাদর হবে না তার, এমন নয়। যদি বলি, গদ্য কবিতায় তো ছন্দ নেই, তবে পোশাক ছাড়াই উলঙ্গ সে হাজির হলো? তাও নয়। গদ্যের ছন্দ আছে, সে ছন্দটা যেন দর্জির বাঁধা ডিজাইনের পোশাক নয়, নিজের ডিজাইনে উদ্ভাবিত সে পোশাক- যাকে বলব স্পন্দিত ছন্দিত- কিন্তু প্রচলিত অর্থে ছন্দ নয়।’ (গদ্য-ছন্দ : ভাব ছন্দ, মার্জিনে মন্তব্য, পৃষ্ঠা ২২১)
আধুনিক কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে এর শৈল্পিক দিকটি বিভিন্ন মনিষী বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়েছেন। কিন্তু শেষ অব্ধি তাঁদের সকলের সমাধানটা একই ধরনের যেমন, হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠবে না, বুকে, ওষ্ঠে, হৃৎপিণ্ডে, রক্তে, মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না, যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে। তার নাম কবিতা।’ আধুনিক কবিদের একজন, কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন ‘যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে, তাকেই বোধ হয় কবিতা বলা যেতে পারে’ লক্ষণীয় বিষয় হলও তার সংজ্ঞায় সংশয় বিদ্যমান। এই সংশয় থাকাটাই স্বাভাবিক বিধায় তাঁর সংজ্ঞাকে অর্থবহ বলা যায়।
বিশ্বখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়’ তিনি কবিতাকে সরাসরি সংজ্ঞায়িত না করে এর গভীরতাকে ইঙ্গিত করেছেন। তার নিকট কবিতা হলো মানুষের সুগভীর ভাবনার প্রকাশ ও এর বিশালতায়। উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি পার্সি বি শি শেলি বলেন ‘কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবি মনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে।’ আবার আধুনিক ইংরেজ কবি জন কীটস এর মতে। ‘কবিতা মুগ্ধ করবে এর সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়। তিনি আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন যে, শুধু ছন্দে ও অন্ত্যমিলে কোন কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হবে না। কবিতা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে এবং পাঠক নিজের ভাবনাগুলো কবিতায় খোঁজে পাবে।’ যদিও কীটসের এই ধারণা বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলনা।
প্রাচীনকালে আচার্য ভামহ বলেছিলেন ‘শব্দার্থৌ সাহিতৌ কাব্যম’, অর্থাৎ শব্দ ও অর্থের সমন্বয়ে কাব্য বা কবিতা গড়ে ওঠে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কাব্য চর্চা করেছেন তৎকালীন প্রচলিত কাব্য ধারায়। এতে কোন ভুল নেই যে কবি গুরুর হাতে কবিতার চিত্রকল্প, রূপ, উপমা শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে উত্তরোত্তর। কিন্তু তিনি গদ্য কবিতার প্রতি তেমন অনুরক্ত ছিলেন না। যদিও তিরিশের দশকের মধ্য ভাগে তিনিও গদ্য কবিতা রচনা করেছেন। ১৯৩২ সালে ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার কবিতার এক নতুন রূপ উন্মোচিত হলো। তার গদ্য ভাষায় রচিত কবিতা নিয়ে ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ‘কোপাই’ এ লিখেছেন –
ওর ভাষা গৃহস্ত পাড়ার ভাষা
ওকে সাধু ভাষা বলে না
জলস্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে
রেষারেষি নেই তরলে শ্যমলে।
গদ্য কবিতার ঢঙ্গে তিনি ‘পুনশ্চ’, ‘পত্রপুট’, ‘শেষ সপ্তক’, ও ‘শ্যামলী’ নামে চারখানা কাব্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তথাপি তিনি ছন্দবদ্ধ প্রচলিত পদ্ধতিতেই তিনি ছিলেন গুরু কবি। আবার অনেকের মতে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই গদ্য কবিতার জনক। তার ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১১) অনুবাদ কালেই গদ্য কবিতা লেখার ইচ্ছা জাগে। তিনি ‘পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজির মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস’ সৃষ্টির প্রয়াস করেন। প্রথম দিকে তিনি ‘লিপিকায়’ (১৯২১) কিছু গদ্য কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। গদ্য কবিতা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময়ই তিনি ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে এই প্রকরণ পরীক্ষার অনুরোধ করেছিলেন; এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন : ‘মনে পড়ে একবার শ্রীমান সত্যেন্দ্রকে বলেছিলুম, ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত করো দেখি।’ সত্যেনের মতো বিচিত্র ছন্দের স্রষ্টা বাংলায় খুব কমই আছে। হয়তো অভ্যাস তাঁর পথে বাধা দিয়েছিল, তাই তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। আমি স্বয়ং এই কাব্য রচনার চেষ্টা করেছিলুম লিপিকার অবশ্য পদ্যের মতো পদ ভেঙে দেখাই নি। লিপিকা লেখার পর বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখিনি। বোধকরি সাহস হয়নি বলেই।’ (ছন্দ/২৩৫ পৃ.)
গদ্য কবিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে দুর্বলতা ছিল তা তার এই মন্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি বলেন – গদ্যকাব্য নিয়ে সন্দিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাত রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে, এ কথা স্বীকার করতে হবে। তবে ছন্দটাই যে ঐকান্তিক ভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার অনুষঙ্গ হয়ে। সহায়তা করে দুই দিক থেকে। এক হচ্ছে স্বভাবতই তার দোলা দেবার শক্তি আছে, আর-এক হচ্ছে পাঠকের চিরাভ্যস্ত সংস্কার। এই সংস্কারের কথাটা ভাববার বিষয়।
একদা নিয়মিত অংশে বিভক্ত ছন্দই সাধু কাব্য ভাষায় একমাত্র পাংক্তেয় পদ্য ছিল। তখন ছন্দে মিল রাখাও ছিল অপরিহার্য। এমন সময় মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে আমাদের সংস্কারের প্রতিকূলে আনলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। তাতে রইল না মিল। তাতে লাইনের বেড়াগুলি সমানভাবে সাজানো বটে, কিন্তু ছন্দের পদক্ষেপ চলে ক্রমাগত বেড়া ডিঙিয়ে। অর্থাৎ এর ভঙ্গি পদ্যের মতো কিন্তু ব্যবহার চলে গদ্যের চালে। অমিত্রাক্ষর ছন্দের মিলবর্জিত অসমতাকে কেউ কাব্যরীতির বিরোধী বলে কাজ মনে করেন না। অথচ পূর্বতন বিধানকে এই ছন্দ বহুদূর লঙ্ঘন করে গেছে। কাজটা সহজ হয়েছিল, কেননা তখনকার ইংরেজি শেখা পাঠকেরা মিল্টন-শেক্স্পীয়রের ছন্দকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কি হতে পারে এবং হতে পারে না, তা হওয়ার উপরই নির্ভর করে, লোকের অভ্যাসের উপর করে না, এ কথাটা ছন্দই পূর্বেই প্রমাণ করেছে। আজ গদ্যকাব্যের উপর প্রমাণের ভার পড়েছে যে, গদ্যেও কাব্যের সঞ্চারণ অসাধ্য নয়।
তবে আমার নিকট বুদ্ধদেব বসুর কথাটাই বেশী মনঃপুত হয়েছে। তিনি বলেছেন কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না।”
কবিতা তার নিজের জন্য নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়। যা শুধু মানুষের ভাব ও আবেগকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ ঘটায়। কবিতা আবেগ কেন্দ্রিক অনুভূতিপ্রবণ মনের বহিঃপ্রকাশ। কবিতা সমকালের মুখপাত্র হতে পারে। কান্না বিধ্বস্ত হৃদয়ের প্রতিনিধি হতে পারে। বিদ্রোহের সূতিকাগার হতে পারে কিংবা বঞ্চিত মানুষের মুখপাত্র হতে পারে। অর্থাৎ কবিতা কোন শ্রেণীকে বঞ্চিত না করে একটি প্রধান ও নিরপেক্ষ প্রতিনিধি হতে পারে। যার চলার পথ তার নিজস্ব অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। আধুনিক কবিতা ও চিত্রকল্প, মিথ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদির ব্যবহার :
আধুনিক কবিতার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এতে ব্যবহৃত শব্দ, ছন্দ ও অলংকার। পৃথিবীর আদি থেকে এই আধুনিক কাল পর্যন্ত দেখা যায় যে সমাজের কোন কোন অবস্থাকে যখন সহজভাবে নেয়া যায় না তখন প্রতিবাদ আবশ্যক হয়ে পড়ে। কিন্তু কখনো কখনো এর সরাসরি প্রতিবাদ করা সহজ হয়ে না। তখন একদল ব্যক্তি তাদের শাব্দিক ভাষায় প্রতিবাদ করে রুখে দাড়ায়। প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ তখন পরোক্ষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে। এবং যা হয় সাহিত্যের শৈল্পিক ভাষায়। এই সাহিত্যেই আবার প্রধান্য পায় কবিতার ভাষা। কবিতায় মিথ প্রয়োগে একটি কবিতাকে মূর্ত করে তোলা হয়। মিথ কবিতার একটি শিল্পাশ্রয় জনিত রহস্যাবৃত একটি ভাষা। যা কবিতাকে আরও বাঙময় এবং শিল্পময় করে তোলে। একজন কবি কবিতার আলঙ্কারিক শ্রীবৃদ্ধির প্রয়োজনে তার কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদির সফল প্রয়োগ করে থাকেন।
পূর্বেই লিখেছি ত্রিশের দশকের মধ্যভাগে কবিগুরু গদ্য কবিতা লেখা শুরু করেন। এর হয়ত একটা কারণ হতে পারে পঞ্চকবির প্রভাব। সেই সময় আর্বিভূত কবিবৃন্দের কবিতায় মিথ প্রয়োগের যথেষ্ট উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়। সেই সময় পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত কবিরা (জীবনান্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু ও অমীয় চক্রবর্তী) কবিতায় মিথের স্বতন্ত্র প্রয়োগ বেগবান করেছেন। কবি হবেন শব্দ ভাস্কর। তবে তা অভিধান থেকে সংগ্রহ করে নয়। তাকে তা গ্রহণ করতে হবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাহিক ভাষা থেকে এবং নিজের হৃদয়ের লব্ধ আবেগ ও বাস্তবতা থেকে। আধুনিক কবিদেরকে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই ছন্দ জ্ঞান থাকতে হবে। তবে তা প্রয়োগের আবশ্যকতা নির্ভর করে কবির কবিতা নির্মাণ শৈলীর উপর। ছন্দ অস্বীকার করে বাংলা সাহিত্যের কবিতা-অঙ্গনে টিকে থাকা দুরূহ। ছন্দ জানা একজন কবির প্রধান দায়িত্ব। ছন্দ জানা আবশ্যক। কিন্তু প্রয়োগ আবশ্যক নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র অলঙ্কার ব্যবহার করেও একজন কবি সার্থক কবিতার জন্ম দিতে পারেন। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত কবিদের কবিতায় উপমার প্রয়োগের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। উপমা শব্দটি বিশেষ্য যা হচ্ছে সাদৃশ্যমূলক অর্থালঙ্কার। ব্যাকরণগত অর্থে তুলনা বা সাদৃশ্য অর্থাৎ একই বাক্যে সাধারণ ধর্মবিশিষ্ট দুই বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্যতার বর্ণনা করা। উপমার প্রয়োগে একটি কবিতাকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলে। উপমাকে সাজ সজ্জার সাথে তুলনা করা যায়। উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে একজন কবি তার কবিতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সক্ষম হন। অন্যদিকে উৎপ্রেক্ষা অর্থ হলো উৎকট জ্ঞন বা তুলনা; কখনো তা সংশয় বা কল্পনা। উৎপ্রেক্ষার নানাবিধ বৈশিষ্ট্য, যেমন: (১) উপমান (২) উপমেয় (৩) তুলনামূলক শব্দ এবং (৪) সাধারণ ধর্ম। বয়সের অভিজ্ঞতা একজন কবির কবিতাকে সেরা করে না। একটি সার্থক কবিতা তার চিত্রকল্প, তার বিভিন্ন অলংকারের উপর নির্ভরশীল। চুলপাকা বয়সের উপর নয়। বয়স হিসেবে বিবেচনা করলে জীবনান্দ দাস, সুকান্ত, কীটস, শেলী বা সামছুর রাহমান কবি হতে পারতেন না। একটি কবিতায় কবিতার উপাদানের উপস্থিতিই কেবল কবিতাকে মধুর এবং শক্তিশালী করে তুলতে পারে। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে শুধুমাত্র ছন্দ নয় ; মিথ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক-এর সমন্বয় একটি চমৎকার চিত্রকল্পই একটি সার্থক কবিতার সৃষ্টি করতে পারে।
~~~কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না।” কবিতা ও ছন্দ নিয়ে সাহিত্যিকগণ অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন! কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর এ কথাটি সত্যি নিগূঢ় অর্থ বহন করে! কবিতা একটা প্রগাঢ় অনুভূতির নাম, যা আবেগে দোলে, স্মৃতিচারিতায় স্পন্দিত হয়!
খুব সুন্দর লিখেছেন! লেখাটিতে তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহার যেমন রয়েছে, তেমনি কবিতা ও ছন্দ সম্পর্কে অনেক নতুন কথা রয়েছে! সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হবে আশা করি!