প্রবন্ধ।। শোক ও শক্তির উৎস- সেলিনা হোসেন
বাঙালি, বাঙালিত্বের নির্যাসে যুক্ত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অমোঘ উচ্চারণ ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’ এই উচ্চারণের সঙ্গে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় বাঙালিকে উজ্জীবিত করে বাঙালিত্বের গৌরবকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই সময়ে তার মৃত্যু বিশ্বজোড়া বাঙালির সামনে শুধু শোকের দিন নয়। গৌরব এবং মর্যাদার জায়গা থেকে তিনি বাঙালির সামনে মৃত্যুহীন মানুষ।
হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ভূখ- নানা নামে পরিচিত হয়েছিল। বলা হতো বঙ্গ-পুংর-সুহ্ম-গঙ্গাঋদ্ধি-বজ্রভূমি-বরেন্দ্র-প্রাক-জ্যোতিষপুর-সমতট-হরিকেল-তাম্রলিপ্ত চন্দ্রদ্বীপ-রাঢ়-গৌড়-বাগঢ়ী ইত্যাদি নাম ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের। ইতিহাসবিদ মহম্মদ আমীর হোসেন তার ‘বঙ্গ বঙ্গাল বাঙ্গালা বাঙ্গালী বিনির্মিত নির্মাণ’ বইয়ে বলেছেন, পাল ও সেন বংশের শাসনকালে বর্তমানের বাঙ্গলা অঞ্চল সাধারণভাবে গৌড় বলেই পরিচিত হয়েছে। আর ওই বর্ণহিন্দু সমাজ সাধারণভাবে নিজেদের ‘গৌড়জন’ বা ‘গৌড়বাসী’ বলেই চিহ্নিত করতে চেয়েছে স্থানবাচক জাতিত্ব পরিচিতির বিষয়ে। বাঙ্গলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ)।
তিনি তার এই ব্যাকরণের নামকরণ করেন ‘গৌড়ীর ব্যাকরণ’। বাঙালি, বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদেই বাঙালি শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদরা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার বিচারে বাঙালি জাতি একই নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার বংশধর নয়। বাঙালি একটি সংকর জাতি। একাধিক নৃগোষ্ঠী ও রক্তের সংমিশ্রণে বর্তমানের বাঙালি জাতির (জধপব) উৎপত্তি।’ ইতিহাসবিদরা আরও বলেছেন, এই জাতিসত্তার মানুষরা মূলত ‘পূর্ববঙ্গীয় ভূমিপুত্র।’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘বাঙ্গাল’ শব্দের অর্থ হিসেবে লিখেছেন পূর্ববঙ্গের অধিবাসী’।
বাঙালির পরিচয় খুঁটিয়ে দেখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে এটা সত্য যে, সে সময়ের পূর্ববঙ্গ আজকের বাংলাদেশ। যে বাঙালি সংকর জাতি হিসেবে অবজ্ঞাত ছিল তার পরিচয়ের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আজ আমি বলতে পারি, আমি বাঙালি। আজ আমি বলতে পারি, বাঙালি একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি, বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই।’ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘গৌড় নাম লইয়া বাংলার সমস্ত জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই।
সেই সৌভাগ্য লাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত এবং যে বঙ্গ-নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই; তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে পরিচিত হইল। ইংরাজ আমলে বাংলা নাম পূর্ণতর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, যদিও আজিকার বাংলাদেশ আকবরী সুবা বাংলা অপেক্ষা খর্বীকৃত।’
বিশ্বজুড়ে বাংলার যে পরিচিতি সেই অর্থে এই ভূখ-কে শুধু ভৌগোলিক আকারে খর্বীকৃত বলার সুযোগ নেই। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অপেক্ষায় সময়ের পরিসর অতিক্রম করেছে। তিনিই উপমহাদেশের একমাত্র নেতা যিনি উপমহাদেশের মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এই অর্জনে নিজেদের নিবেদন করেছেন বীরদর্পে। মানুষের ভালোবাসার অবিস্মরণীয় চেতনাবোধে সিক্ত হয়েছে তার নেতৃত্বের দৃঢ়তা। তার মৃত্যুদিবস মৃত্যুর উর্ধ্বে জীবনসত্যের বড় পরিচয়। বিশ্বের অনেক নেতা যেভাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আছেন অজেয় প্রেরণায় তেমনি বঙ্গবন্ধু আছেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি পরিচয়ের মুগ্ধতা নিয়ে বলেন, ‘আমার হিমালয় দেখা হয়নি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বে এই মানুষটিই হিমালয়সম। এতেই আমার হিমালয় দেখা হলো।’ এভাবে বাংলাদেশ নামের ছোট ভূখ- বিশ্বের সামনে বিশাল হয়ে উঠেছিল। শুধু ভৌগোলিক আকারের খর্বতা কাটিয়ে উচ্চতার শীর্ষে ওঠার যে দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধু সেই অসাধ্য কাজটি পূর্ণ করেছিলেন। বিশ্বের অন্য অনেক নেতার মতো তিনি দেশের পরিচিতি বিস্তৃত করেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, হো চি মিনের নামের সঙ্গে ভিয়েতনাম, সুকর্নের নামের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, মিসরের সঙ্গে কর্নেল নাসের, প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইয়াসির আরাফাত এমন আরও অনেকে। তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান। তার নাম উচ্চারণ না করে বাঙালির আত্মপরিচয় কখনো পূর্ণ হবে না। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয় ইতিহাসের বঙ্গের পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু তার জাতিসত্তার দর্শনের জায়গা থেকে পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ববাংলা বলার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি গণপরিষদে বলেন, “স্পিকার মহোদয়, সরকার পূর্ববাংলার নাম বদল করেছে। পূর্ব পাকিস্তান। ‘বাংলা’ নাম ব্যবহার করার জন্য আমরা দাবি জানাই। বাংলা নামের ইতিহাস আছে, তার ঐতিহ্য আছে। এই নাম পরিবর্তন করতে হলে বাংলার মানুষকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নাম বদল করার জন্য তারা রাজি আছে কিনা তা তাদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।” নিজ আইডেনটিটির পরিচয় হিসেবে বাংলা শুধু শব্দমাত্র ছিল না, ছিল জীবনদর্শনসহ জাতিসত্তার পরিচয়। মানুষ হিসেবে পরিচয়ের পরে প্রতিটি মানুষকে জাতিসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার সত্য ধারণ করতে হয়। তিনি এই বিশ্বাস প্রত্যেক বাঙালির রন্ধ্রে ঢুকিয়েছেন।
১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি গণপরিষদে আবার বাংলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন : ‘শেখ মুজিবুর রহমান : মহোদয়, একটি বিশেষাধিকার প্রশ্নে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মহোদয়, পাকিস্তান গণপরিষদের কার্যপ্রণালি বিধি ২৯-এর অধীনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংসদের সরকারি ভাষা হচ্ছে তিনটি : ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু। কিন্তু মহোদয়, আপনি জানেন যে দিনের আলোচ্য কর্মসূচি কেবল ইংরেজি ও উর্দুতে বিতরণ করা হয়, বাংলায় করা হয় না। আমি জানি না বিষয়টি আপনি অবগত আছেন কি নাই, কিংবা এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে কিনা।… শেখ মুজিবুর রহমান : কার্যবিবরণী নিশ্চয়ই বাংলায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেহেতু তিনটি ভাষাই সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত সেহেতু তিনটি ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিতে হবে। যদি দিনের আলোচ্য কর্মসূচি ইংরেজি ও উর্দুতে প্রকাশ করা হয়, তা হলে তা অবশ্যই বাংলাতেও করতে হবে। কেননা দিনের আলোচ্য কর্মসূচি কার্যবিবরণীরই অংশবিশেষ।… যেহেতু দিনের আলোচ্য কর্মসূচি ইংরেজি ও উর্দুতে প্রকাশ করা হয়েছে সেহেতু তা বাংলাতেও করা উচিত ছিল।’
এভাবে নিজের জাতিসত্তার অধিকারের প্রশ্নে তিনি অনড় ছিলেন। কোথাও সামান্যতম আপস করেননি। ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মরণে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আজকের এই দিনে স্মরণ করি সেইসব শহীদকে যারা নিজের জন্মভূমিকে ভালোবাসার অপরাধে অত্যাচারী শাসকের মরণযজ্ঞে অকালে আত্মাহুতি দিয়েছেন।… যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এ দেশে মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্তা থাকবে, ততদিন শহীদদের আমরা ভুলতে পারব না। আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। এই বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়।’
শহীদদের আত্মত্যাগকে তিনি বাংলার অস্তিত্বের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন শহীদের জীবন-উৎসর্গ চিরজাগরূক থাকবে।