প্রবন্ধ।। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।। শাহরিয়ার কবির
তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। তিরিশ লাখ মানুষের জীবনদানসহ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারি হিসাবে লাখ, বেসরকারি হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, পনের লাখেরও বেশি মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনীর হাতে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে শরণার্থীর বিড়ম্বিত জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের অন্য কোনো দেশের মানুষ এত জীবনদান, নির্যাতন ও ত্যাগ স্বীকার করেননি।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরই ভিত্তিতে এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর ’৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ছিল নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ভিত্তি।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ডে লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।
পাকিস্তানি শাসকচক্র ২৩ বছরের শাসনকালে বাঙালির যে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। এদেশের মানুষের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানের বিবেচনায় ইসলামবিরোধী ও ভারতের চক্রান্ত। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। জন্মলগ্নেই এই কৃত্রিম অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল যখন ’৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ বাংলা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির ভেতর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতা ও ভারতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সম্পর্কে বাঙালির মোহভঙ্গ হতে সময় লেগেছিল মাত্র সাত মাস। ’৪৮-এর মার্চে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকা সফরে আসেন, তখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল।
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয় ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চ‚ড়ান্ত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি রফিক, জব্বার ও বরকতসহ অগণিত ভাষাশহীদের আত্মদানে। এই ভাষা আন্দোলনের পলল জমিতে বেড়ে উঠেছে নব আঙ্গিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালিত্বের পরিচয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠলেও অচিরেই বাংলার রাজনীতিও এই চেতনায় উদ্ভাসিত হয়।
ইউরোপে জাতীয়তাবাদকে মূল্যায়ন করা হয় সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনা হিসেবে। ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে। হিটলারের নাৎসিবাদের জন্ম হয়েছিল জার্মান জাতীয়তাবাদের উগ্রতা থেকে। এই জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ সেমেটিক ইহুদিরা হলেও যা কিছু প্রগতি ও উদারনৈতিকতার সমার্থক সবই নাৎসিদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়। আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। বাঙালিত্বের চেতনা মূর্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রচনা ও গানে, যখন তিনি লিখেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি,’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল’, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ প্রভৃতি গানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা নানারূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। নাৎসি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সব সময় বিদ্বেষ নয় সম্প্রীতির কথা বলেছে। ছয়শ বছর আগে বাংলার কবি চণ্ডিদাস লিখেছিলেন ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ দেড়শ বছর আগে বাংলার আরেক মরমী কবি লালন শাহ লিখেছেন ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ আর খৃস্টান/ জাতিগোত্র নাহি রবে।’ প্রায় একশ বছর আগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন/কাণ্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল এই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাঞ্জাবি শোষক চক্র বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক শোষণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। ২৩ বছরের সীমাহীন শোষণে পশ্চিম পাকিস্তানের উষর মরুভ‚মি হয়েছে শস্য শ্যামল এবং সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল শ্মশানে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন এই প্রশ্নের উত্তর বাঙালি খুঁজে পেয়েছে মধ্য ষাটে আওয়ামী লীগের ছয় দফায়। বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছে সত্তরের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সকল হিসাব ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর পক্ষপাত বিভিন্ন অধ্যায়ে বিধৃত হয়েছে। ষাটের দশকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব সমাজতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয় করেছে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা, বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশে গণহত্যার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে যখন বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবার আহ্বান জানান। ৭ মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।’ তারপরই বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই একটি আহ্বান সমগ্র জাতির চেতনায় স্বাধীনতা ও শোষণ-পীড়ন মুক্তির যে বোধ সঞ্চারিত করে তা মূর্ত হয়েছে পরবর্তী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে, যা ছিল সার্বিক অর্থে একটি গণযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখবার জন্য নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জনপদ ধ্বংসসহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তাদের এই নৃশংসতার প্রধান দোসর ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম নামক উগ্র মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের দল। ইসলামের দোহাই দিয়ে এই সব দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যেভাবে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে প্ররোচিত করেছে নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে গঠন করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী। এইসব ঘাতক দলের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও কামরুজ্জামানরা কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালিদের হত্যা করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং দলের কর্মীদের প্ররোচিত করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সেই সময় প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এর প্রতিদিনের পাতায়। জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানা থাকবে না। পাকিস্তান রক্ষার দোহাই দিয়ে জামায়াতিরা তখন যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে ইসলামের নামে। এভাবেই তারা ইসলামকে হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন ও ধ্বংসের সমার্থক শব্দে পরিণত করতে চেয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন তারা জামায়াতের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ইসলামকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাকিস্তানের ৯০ হাজারেরও বেশি নৃশংস সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়েও জামায়াতিরা তাদের প্রাণপ্রিয় পাকিস্তান রক্ষা করতে পারেনি। পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা তালিকা তৈরি করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগেই জামায়াতের শীর্ষ নেতারা যারা সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্যরা দেশের ভেতর আত্মগোপন করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ী জামায়াতিদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছিল।
’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী দুজনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি।… শেখ সাহেব তাঁর দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কীসের এত মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য…। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’
’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের এই চার মূলনীতিকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা অর্জিত হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে। এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
৪ নভেম্বর (১৯৭২) গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু এক অনন্যসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। আমার মতে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বরের এই ভাষণ, যেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নতুন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা আছে এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যে সব দেশে চলেছে, দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্রের ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো আমার দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সাথে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক সিডিউলে রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারোর সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয় আমরা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, কাপড়ের কল, পাট কল, চিনির কারখানা সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষকগোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৪ নভেম্বরের ভাষণে বলেছেন ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি; এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা ঐগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্রের জন্মভ‚মি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্র গাছের ফল নয় অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছা যায়। এবং সেজন্য পহেলা স্টেপ- যাকে প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি; শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কি আবহাওয়া, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে, এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পাশে বাস করেও যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া নিজ দেশের পরিবেশ নিয়ে, নিজ জাতির পটভ‚মি নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান, দেখা যাবে, ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না; তা যারা করেছেন, তাঁরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কারণ লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না যেমন তা পড়ে আন্দোলন হয় না। সেজন্য দেশের পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের রীতিনীতি, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয় দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সোশ্যালিজম এনেছে তারাও সেগুলো করতে পারেননি, এ ব্যাপারে আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু প্রচলন করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা প্রসেসের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
অনেকে বলেন ১৯৭২-এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র যুক্ত করেছেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের প্রভাবে। কমিউনিস্ট না হয়েও যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করা যায় এটি বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের ভাষণে স্পষ্ট। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সমাজতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তাঁর অবস্থান একাধিক স্থানে স্পষ্ট করেছেন ‘আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান। শোষক শ্রেণিকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম অপপ্রচার করা হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে প্রদত্ত ৪ নভেম্বরের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। … মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।’
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের শুধু সামরিক পরাজয়ই হয়নি, তাদের ধর্মের নামে রাজনীতি, হানাহানি, হত্যা ও ধ্বংসের দর্শনেরও পরাজয় ঘটেছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল সকল ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালিত্বের চেতনায় জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালিত্বের এই চেতনার প্রধান রূপকার, যার ভিত নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির এই ঐক্য পাকিস্তান ভেঙেছে, ধর্মের নামে রাজনীতির অমানবিক ধারণা ভেঙেছে। পরাজিত পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসররা বাঙালির এই ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য প্রথমে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীদের হত্যা করে পাকিস্তানের সেবকদের ক্ষমতায় বসিয়েছে, ’৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে বাঙালিত্বের চেতনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ধর্মকে, যা তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা থেকেই করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি ও সন্ত্রাসের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির জনক জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য জাতিকে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি-বাংলাদেশী, ধর্মনিরপেক্ষতা-ইসলাম (রাজনৈতিক), সমরতন্ত্র-গণতন্ত্র প্রভৃতি দ্বন্দ্বে বিভক্ত করেছেন। ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ানস’ এই ঘোষণা দিয়ে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বলে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক আদর্শকে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিনাশ ঘটানোর পাশাপাশি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির এই বিভাজন ঘটানো হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে অধিকাংশ সময় এ দেশটি শাসন করেছে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে পাকিস্তানিকরণ/মৌলবাদীকরণ/ সাম্প্রদায়িকীকরণ আরম্ভ হয়েছে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি প্রায় এক যুগ একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা ’৭১-এর চেতনায় ফিরে যেতে পারিনি। ’৭২-এর সংবিধানে জেনারেল জিয়া কর্তৃক বাতিলকৃত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হলেও এখনও সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক থেকে সংবিধানকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যায়নি। সেখানেও বাধা হচ্ছে বিভাজনের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রাবল্য।
’৭২-এর সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে ধর্মের নামে এত নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের ৪৮ বছর এবং পাকিস্তানের ৭২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সমগোত্রীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো, যা তারা করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে। ’৭২-এর সংবিধান এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শ মান্য করতে হলে ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত রাখতে হবে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও হত্যা বন্ধের পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য।
বাংলাদেশ যদি একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, যদি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চায়, যদি যুদ্ধ-জেহাদ বিধ্বস্ত বিশ্বে মানবকল্যাণ ও শান্তির আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চায় তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।