প্রবন্ধ।। লেখকের দায়িত্ব।। শওকত আলী
প্রবন্ধ।। লেখকের দায়িত্ব।। শওকত আলী
লেখক হওয়া মানেই নিজেকে বৃহতের সঙ্গে যুক্ত করা, এক থেকে বহু হয়ে যাওয়া। শুধু নিজেরই কথা কখনো কোনো লেখক লেখেন না। কিংবা বলা যায়, লেখক যাই লিখুন, তা যদি কেবলমাত্র নিজের কথাও হয়, তাহলেও সে রচনাকে সবার কথা হয়ে যেতে হয়। যদি না হয়, তাহলে সেই রচনার সাহিত্য হিসেবে কোনো দাম নেই। শুধু একের কথা না হয়ে বহুর কথা হতে গেলে রচনার শরীরে ও আত্মায় যা থাকে তারই মধ্য দিয়ে লেখক নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
এখন লেখকের রচনার শরীরে ও আত্মায় কী থাকে সেইটি দেখা দরকার। সাধারণভাবে রচনার শরীর ও আত্মা মিলিয়ে এমন একটি জগৎ সৃষ্টি করা হয় যা পাঠকের আকাঙ্ক্ষিত, বিশ্বাসযোগ্য, জীবন-সংলগ্ন এবং সম্ভাবনাময়। এ জগৎ এমনই একটি জগৎ যার দিকে মানুষ আকৃষ্ট হয়, অবস্থান করে এবং আনন্দ বেদনা আশা নিরাশার মানবিক উপলব্ধির নানা পর্যায় অতিক্রম করে নতুন উপলব্ধি নিয়ে, প্রায় নতুন মানুষ হয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়। মহৎসাহিত্য পাঠের সময় এইরকম এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়। মোটামুটি এইভাবেই সাহিত্য মানবসমাজকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে আসছে। এবং এই প্রক্রিয়াতেই সাহিত্য জীবনপ্রবাহের সত্যস্বরূপকে উদঘাটিত করে চলেছে। তাই আমরা দেখতে পাই, যাঁর রচনায় চিন্তা আবেগ অনুভূতি এবং আশার যতো বেশি সমাবেশ, যতো বেশি বিকাশ, তিনি ততো মহৎ লেখক । একজন মহৎ লেখকের তৈরি জগতে সেই কারণেই বেশি সংখ্যায় মানুষ প্রবেশ করে, অবস্থান করে এবং অবস্থান করে নতুন প্রেরণায় ও বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে।
ব্যাপারটা সেই কারণেই নিজেকে যুক্ত করার। অবশ্য যুক্ত সবাই করেন-রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, ব্যবহারজীবী সবারই সাধনা নিজেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, যেভাবেই হোক, বৃহতের সঙ্গে, বহুর সঙ্গে যুক্ত করা। মানুষের জীবন তাঁদেরও বিষয়। কিন্তু তাঁদের পদ্ধতি আলাদা। তাঁরা প্রকরণে বুদ্ধিকে কাজে লাগান বেশি। যুক্তি পরম্পরায় তাঁরা অনিবার্য সিদ্ধান্তে পৌঁছান। ভুবন সৃষ্টি তাঁদের কাজ নয়। কিন্তু লেখককে শুধুমাত্ৰ বুদ্ধির এবং যুক্তির উপর নির্ভর করলেই চলে না। সিদ্ধান্তে পৌঁছলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাঁকে একটি জগৎ সৃষ্টি করতে হয়। বহুর সঙ্গে যুক্ত করার তাঁর ওই একটিই পথ। যুক্তি ও বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবেগ ও অনুভূতির ভেতর দিয়েও তাঁকে অগ্রসর হতে হয়। এবং তাঁর ওই সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পুরনো চিন্তা-ভাবনা উজ্জ্বল করে নতুন চিন্তা-ভাবনার জন্ম দিতে হয়। অর্থাৎ সাহিত্যকার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন আদ্যন্ত মানুষকে। শুধুই মানুষের কাজকর্ম বা চিন্তা-ভাবনা নয়—তার আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা কল্পনা, রুচি সংস্কার, সন্দেহবোধ, ঘৃণা-তার শরীর, তার আচরণ, তার হতাশা আশা-সবকিছুই, বলা যায় পুরো মানুষটাই লেখকের বিষয়। এবং এইসব মানবিক উপাদান দিয়ে তৈরি জগতে মানুষকে আকৃষ্ট করতে হয়, আলোকিত করতে হয় এবং তার মনোজগতের মধ্যে একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া চালু করে দিতে হয়।
এই জগৎ সৃষ্টির উপাদানগুলো লেখক কিভাবে পান? এর খুব সোজা জবাব হচ্ছে, লেখকের লেখার মধ্য দিয়েই উপাদানগুলো পাওয়া যায়। গোর্কি যেমন কেন লিখি, এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে যে—তার চারপাশের জগতের নিষ্প্রাণ বৈচিত্র্যহীন একঘেঁয়েমি এমনই পীড়াদায়ক যে না লিখে তিনি পারেন না, আবার চারপাশের জগতের এতো কথা তাঁর মনের মধ্যে জমে উঠেছে যে সেগুলো না লিখেও তার উপায় নেই। রোমান্টিসিজম আর রিয়েলিজমের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে যদিও গোর্কি প্রসঙ্গটি তুলেছেন, তবু ওই প্রসঙ্গটিই আমাদের বুঝিয়ে দেয় লেখক তাঁর ভুবন সৃষ্টির উপাদানগুলো কিভাবে পেয়ে যান। মানবজীবনের বঞ্চনা হতাশা এবং দারিদ্র্য এতো গভীর যে মানুষকে কল্পনার মধ্যে তার মূলের ছবিটি দেখতে হয়। এই রকম প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই মানুষ জীবনে যা পায়নি অথচ তার যা পাওয়া উচিত, তা কল্পনা করে নিতে ভালবাসে। এই উপাদানটিই হলো লেখকের ভুবনের সেই জিনিস যা মানুষকে আলোকিত করে, জাগিয়ে তোলে, কল্পনা দিয়ে দিগন্ত অতিক্রমের জন্য মনে সাহস সঞ্চার করে। আর অন্য পক্ষে তাঁর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানবজীবনের যে পরিচয় তিনি পেয়েছেন, তার বহু, বিচিত্র এবং জটিল তথ্যগুলো তিনি বর্ণনা করেন। বর্ণনা করেন এমনভাবে যেন বর্ণনার মধ্য দিয়ে জীবনপ্রবাহের সত্য স্বরূপটি ধরা পড়ে—এই প্রক্রিয়াতেই এসে যায় বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ এইভাবে, লিখবার ইচ্ছা থেকেই লেখক তার সৃজ্য ভুবনের উপাদানগুলো নিয়ে সৃষ্টি করেন আশ্চর্য এক ভুবন, যা সর্বাংশে মানবিক, যার কল্পনা ও বাস্তবতা অসংখ্য মানুষকে লেখকের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়।
ব্যাপারটি তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, সাহিত্যশিল্পী তাঁর শিল্পীসুলভ মন ও কলাকৌশল নিয়ে এমন একটি অস্তিত্ব, যিনি মানুষের সঙ্গে অর্থাৎ তাঁর চারপাশের অধিক সংখ্যক মানুষের সঙ্গে সর্বতোভাবে যুক্ত। কথাটা উপমা দিয়ে এইভাবে বলা যায় যে, লেখক যেন সেই গাছ যার শিকড়গুলো অসংখ্য মানুষের মধ্যে প্রসারিত এবং অসংখ্য মানুষের জীবন থেকে রস গ্রহণ করেই তাঁর সাহিত্যশিল্পের ফুলগুলো ফুটে ওঠে।
২.
উপরের সিদ্ধান্ত থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি যে, পারিপার্শ্বের অধিক সংখ্যক মানুষের সঙ্গে লেখককে একাত্ম হতেই হয়, পারিপার্শ্বের মানুষের সঙ্গে নিজেকে একেবারে রাসায়নিকভাবে সংযুক্ত না করে লেখকের উপায় নেই। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলে, আলাদা করলে, আর যা-ই হওয়া যাক, লেখক হওয়া যায় না। প্রত্যক্ষভাবে হোক, পরোক্ষভাবে হোক, লেখক মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকবেনই। মহৎ লেখকদের তা-ই থাকতে হয়েছে। বিচ্ছিন্ন যখনই হয়েছেন, তখনই তাদের শিল্পকর্মে বন্ধ্যাতত্ত্ব দেখা গিয়েছে।
এখন পারিপার্শ্বের, মানুষ বলতে আমরা কোন মানুষ বুঝবো-এ প্রশ্নটি আসে। এবং এই প্রশ্নেই কেউ কেউ মানুষ বলতে যে-কোনো মানুষ বলে বিষয়টি সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকেন। আর এই বিভ্রান্তির অবকাশেই ব্যক্তির মনোবিকলন, বিকার ইত্যাদিকে সাহিত্যের প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ধনতান্ত্রিক বিশ্বের শিল্পচর্চায় এইসব বিকার ও বিকারজনিত জটিলতাগুলোকেই বড় করে এবং প্রধান বিষয় হিসেবে দেখানো হচ্ছে ।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোন মানুষ ? কোন্ মানুষের সঙ্গে লেখক একাত্ম হবেন? যে মানুষ কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, যার শ্রমে জীবনের রূপান্তরের সম্ভাবনা নেই—যে শুধু শোষণ করতে জানে, জীবনের বিকাশের পথগুলো রুদ্ধ করে রাখে-যে যুদ্ধ বাধায়, দুর্ভিক্ষ আনে, সেই মানুষ, নাকি সেই মানুষ যে ক্ষুধায় পীড়িত হয়, স্বেদসিক্ত হাতে সভ্যতার চাকা ঘোরায়, বিক্ষুব্ধ হয়, বিদ্রোহ করে—যার সৃজনশীল চেতনা নতুন সম্ভাবনার দুয়ারে প্রতিনিয়ত আঘাত হেনে চলেছে—সেই মানুষ? এই প্রশ্ন সম্পর্কে লেখকের নিঃসংশয় হওয়ার প্রয়োজন আছে।
শিল্পকলার সঙ্গে সৃজনশীলতার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। কেননা শিল্পকলার ইতিহাস নিজেকে ক্রমেই অতিক্রম করে যাওয়ার ইতিহাস। সে কারণেই মানবজীবনের সেই অংশই শিল্পকলার বিষয়, যে অংশ স্থির নয়, যার বিকাশের পথ রুদ্ধ নয়, যা নিজেই নিজের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখেনি। জীবনের যে অংশে ভাঙাগড়া ও রূপান্তরের কাজ চলছে, যেখানে জীবন ক্রমেই এক স্তর থেকে আরেক স্তরে পৌঁছবার জন্য চঞ্চল, নতুন থেকে নতুনতর বিন্যাসের কাঠামোয় নিজের গুণ ও ব্যাপ্তিকে বিধৃত করার জন্য তৎপর—সেখানেই লেখকের আলোকপাত । উপন্যাস সাহিত্যের জন্ম সেই কারণেই হয়েছে। ব্যক্তি ও অচলায়তন সমাজের বৈরী সম্পর্কটাই লেখকের প্রধান বিষয় আজ পর্যন্তও । ব্যক্তির অন্তর্লোক যদিও আধুনিককালের লেখকদের প্রধান বিষয়, কিন্তু ব্যক্তি কখনোই স্বয়ম্ভূ হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যক্তির অবস্থান সবসময়ই অচলায়তন সমাজের প্রতিপক্ষে। পরোক্ষে হোক, প্রত্যক্ষে হোক ব্যক্তি সমাজের স্থিতাবস্থা ভেঙেচুরে দিয়ে নতুন একটি বিন্যাস সৃষ্টির জন্য আকাঙ্ক্ষী। ব্যক্তির এই অবস্থান এবং প্রচেষ্টাকে যদি বিচ্ছিন্ন বলে ধরে নিই, তাহলে ভুল করা হবে। এই প্রচেষ্টার পেছনে সমাজের মধ্যকার বড় রকমের একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে থাকে। সেই সামাজিক দ্বন্দ্বটি বাদ দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের বিরোধের ব্যাপারটা কখনো বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি সবসময়ই তার নিজের শ্রেণির প্রতিভূ, সেখানেই তার অবস্থান। সে আমার বিষবৃক্ষ অথবা চোখের বালি, ওয়ার অ্যান্ড পিস অথবা জাঁ ক্রিস্তফ যা-ই বলি না কেন, সব শ্রেণির রচনাতেই ব্যক্তির পেছনে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলো সক্রিয় থাকে।
যদিও জমিদার সামন্তপতি এবং নগরবাসী সংস্কৃতিবান লোকদের কথাই উল্লিখিত শিল্পকর্মগুলোর উপাদান, কিন্তু এদের পেছনে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, প্রত্যক্ষে হোক পরোক্ষে হোক, কোনো না কোনো সামাজিক অথবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কাজ করছে। সোজাসুজি বললে বলা যায়—এসব রচনার বিষয়গুলোর মূলে বহুসংখ্যক মানুষের অস্তিত্ব কাজ করছে। এই বহুসংখ্যক মানুষ হলো সেই মানুষ, যারা সামাজিক স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে নতুন সামাজিক বিন্যাস সৃষ্টির জন্য তৎপর। তারা সবাই পুরনো অচলায়তনের দেয়াল ভাঙছে। পুরনো সংস্কারের ভিতে আঘাত হানিছে, বাজে বিশ্বাসের শিকড় আলগা করে দিচ্ছে।
ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে এই যে সৃজন প্রক্রিয়ার বহমান ধারা—এই ধারাতেই শিল্পকর্মের প্রধান বিষয়গুলো বিধৃত। এবং বলা বাহুল্য এই ভাঙচুরের ও সৃজন প্রক্রিয়ার ধারাটি বহমান থাকে সেই শ্রেণির মানুষের কর্মপ্রবাহের দ্বারা যারা নিরুদ্বিগ্ন, নিশ্চিত, স্থিত জীবনের অংশীদার নয়। সমাজের এই শ্রেণির মানুষরা প্রত্যক্ষত সাহিত্যের বিষয় হলো কি হলো না, কিম্বা তাদের যথার্থ প্রতিফলন সাহিত্যে পাওয়া গেলো কি গেলো না তা নির্ভর করে তৎকালীন সামাজিক অবস্থা ও লেখকের সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থানের উপর। যেখানে সামন্তবাদী শোষণের ওপর সমাজ এবং লেখক দাঁড়িয়ে, সেখানে কৃষাণ জীবনের যথার্থ প্রতিফলন অসম্ভব। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথের পক্ষে কৃষাণ জীবন নিয়ে সাহিত্য রচনা সম্ভব হয়ে ওঠে না, আর বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্রোহী কৃষকের কথা না লিখে লেখেন দেবী চৌধুরাণী আর আনন্দমঠ ।
কিন্তু তাঁরা যা-ই লিখুন, ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে সৃজন প্রক্রিয়ার যে ধারা—তা থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি। কোনো না কোনো পক্ষে তাঁরা ছিলেন এবং যতোখানি যে পক্ষে ছিলেন, ঠিক ততখানিই সেইমতো সৃজনশীলতার স্বাক্ষর তাঁদের রচনাবলী বহন করছে।
অর্থাৎ সৃজনশীলতার ব্যাপারটি মানবসমাজের সেই অংশটির সঙ্গে সম্পর্কিত যে অংশে আলোড়ন, যে অংশে সচলতা, যে অংশে রূপান্তরের প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল। মধ্যযুগে ব্যক্তির স্বাধীনতাই ছিলো অম্বিষ্ট, কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজে দেখা গেলো ব্যক্তির স্বাধীনতা আসল কথা নয়, কেননা অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপারটা অর্থহীন; অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যক্তির নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে। তাই আজ ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের মুক্তিই হলো প্রধান কথা। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির চেষ্টাই এখন সমাজকে বিকাশের ও সৃজনশীলতার নতুন প্রান্তে নিয়ে চলেছে। এই অবস্থায় যে-শ্রেণির মানুষ সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষায় দৃঢ়সংকল্প, রূপান্তরের বিরোধী, বিকাশের অন্তরায়-সেই শ্রেণির সৃজনশীলতা সীমাবদ্ধ। মানুষকে নতুন দিগন্ত এই শ্রেণির পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। এরা একদিকে যুদ্ধ বাধাতে পারে, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে পারে আর অন্যদিকে বড় জোর পর্নোগ্রাফিক সাহিত্য তৈরি করতে পারে।
এই জন্যই বর্তমান অবস্থায় একজন লেখক কোন শ্রেণির সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত রাখবে-এ প্রশ্নের জবাব অনিবাৰ্যভাবে একটিই, আর তা হলো লেখক নিজেকে সম্পর্কিত রাখবে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে, কৃষণের সঙ্গে, শ্রমিকের সঙ্গে। এ সম্পর্ক রাখা মহানুভবতা দেখানোর জন্য নয়, কিংবা অন্যের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্যও নয়-এ সম্পর্ক রাখা লেখকের নিজেকে সৃজনশীল রাখবার জন্যই। কেননা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যেই সমাজ রূপান্তরের বীজ উপ্ত হচ্ছে। সেখানেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটছে। দিক বদলের হাওয়া সেখান থেকেই নতুন মোড় নিচ্ছে—এবং সেখানেই লেখককে থাকতে হবে, তার রচনার প্রাণরস সেখান থেকেই উঠে আসবে। সুতরাং গভীর জীবনোপলব্ধির তাগিদে, সৃজনশীলতর নতুন নতুন দুয়ার খুলে দেয়ার জন্যই লেখকের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে একাত্ম না হয়ে উপায় নেই। শিল্পীর একটাই পক্ষ, আর তা হলো জনগণের পক্ষ। শিল্পী আধুনিক শিক্ষা গ্ৰহণ করবেন, আধুনিক কলাকৌশল আয়ত্ত এবং প্রয়োজনে আবিষ্কারও করবেন; কেননা প্ৰচলিত ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে তিনি কাজ করবেন না। সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করতে হবে তাঁকে এবং সেই সঙ্গে নিজেকেও অতিক্রম করা চাই তাঁর-সেইজন্যই কলাকৌশলগুলো আয়ত্ত রাখা তাঁর প্রয়োজন। তবে এসবই হলো তাঁর নিজেকে তৈরি রাখার ব্যাপার-বলা যায় যন্ত্রের মতোই-যে যন্ত্র তিনি মহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজে লাগাবেন। সবকিছুর দিক নিয়ামক হলো ওই একটি শর্ত—আর তা হলো, জনগণের সঙ্গে থাকা-শোকে দুঃখে, বিদ্রোহে বিক্ষোভে, কর্মে চিন্তায়, অবিরল অবিচ্ছিন্নভাবে জনগণের মধ্যে ডুবে থাকা ।
৩.
একজন লেখক জনগণের সঙ্গে কিভাবে থাকতে পারেন? এ প্রশ্নের আগে আরো একটি প্রশ্ন আসে। আর তা হলো মানুষের সঙ্গে মানুষ কিভাবে মিশতে পারে। কোন সম্পর্ক আমার জন্য জায়গা করে দিতে পারে, আমাকে গ্ৰহণ করতে পারে সেইটি ভেবে দেখা দরকার। কিভাবে গেলে একজন কৃষক তাঁর অতীত-ভবিষ্যৎ, তাঁর দৈনন্দিন কর্মধারা, তাঁর ঘৃণা-ক্ষোভ, তাঁর ভালবাসা-প্রতারণা সবকিছু আমাকে জানতে দেবেন, সেইটি লেখক হিসেবে আমার জানা দরকার।
এ প্রশ্নের উত্তর একটাই-আর তা হলো ভালবাসার সম্পর্ক। এই ভালবাসার, প্রীতির, আত্মীয়তার সম্পর্কেই আমি জনগণের ভেতরে চলে যেতে পারি।
এ ভালবাসা প্ল্যাটোনিক বা বৈষ্ণবী ভালবাসা হলে কাজ হবে না। কাজেকর্মে তার প্রমাণ থাকতে হবে। দুঃখের দিনের সহমর্মী, সংগ্রামের সাখী এবং আনন্দের অংশীদার হতে হবে। তার লাঙল, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি, তার আকাশ, গাছপালা, ঘরবাড়ি, চাষাবাদ, লোকাচার, দেশাচার, সম্পূর্ণ জগৎটার মধ্যে ডুবতে হবে।
এখানে স্মরণ করা ভাল যে, আমরা বাঙালি লেখকরা জনগণকে খুব কম জানি। আমরা অনেকেই জানি না কোন ফসলের জন্য কোন সময়, বৃষ্টি বেশি হলে কি কম হলে কোন ফসলের কী রকম ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়-কৃষির উপকরণাদির কী কী নাম, ভূমিহীন কৃষকরা কতরকম পদ্ধতিতে শোষিত হয়; আমি যে শ্রেণিতে অবস্থান করি, আমার ঘনিষ্ঠ পরিজনরা যে শ্রেণিতে অবস্থান করে, তাতে আমার বা আমার পরিজনদের সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকদের সত্যিকারের সম্পর্কটা কী-এ সবের অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই। এ দেশে কৃষকরা কতকাল ধরে বিদ্রোহ করে আসছে—সে খবর জানার আগ্রহও আমাদের নেই। যদি থাকতো, যদি জানতাম তাহলে কৃষক-বিদ্রোহের ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা মহৎ উপন্যাস আমরা পেতে পারতাম। জেলেদের মাছ ধরার কাহিনী আমাদের সঞ্চয়ে থাকতে পারতো, নৌকাচালক মাঝিরা মহৎ উপন্যাসের কুশীলব হয়ে উঠতে পারতেন। সীঞ্জ-এর নাটক, হেমিংওয়ের গল্প, শলোকোভ-এর উপন্যাস কম-বেশি বাংলা সাহিত্যেও পাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু হয়নি, হয়নি এজন্য নয় যে উপকরণ ছিল না। না হওয়ার কারণ-সেই উপকরণগুলোর সঙ্গে লেখকের পরিচয় ছিল না এবং লেখক সেগুলো তার শিল্পে ব্যবহার করার তাগিদ বোধ করেননি।
এই তাগিদ আসে মনের ভেতর থেকে এবং তাগিদ আসার পেছনে থাকে ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ এবং সহমর্মিতা—যা আমাদের ছিল না। আমাদের সৃজনশীলতার চৌহদ্দি সেই কারণেই শহর এবং মধ্যবিত্ত। তার বাইরে আমরা যেতে পারি না-কারণ যোগাযোগ নেই। মূল থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন।
যেদিক থেকেই আমরা দেখি না কেন, আমাদের সাহিত্যের বন্ধ্যাত্ত্ব, তার সীমাবদ্ধতা, তার বৈচিত্র্যহীনতা, তার দারিদ্র্য-এসবের কারণ একটাই আর তা হলো আমাদের লেখকরা নিজেদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এই দায়িত্ব পালনের জন্য শ্রমজীবী মানুষের কাছে যেতে হবে। থাকতে হবে তাদের সঙ্গে, তাদের দুঃখের শরিকানা নিয়ে। বিদ্রোহের সখ্য নিয়ে, আনন্দের অংশীদার নিয়ে। এই দায়িত্ব পালন যদি লেখক করতে পারেন, তাহলেই তাঁর আসল দায়িত্ব পালন হয়ে গেলো-সামাজিক, রাজনৈতিক বা আধ্যাতিক দায়িত্ব আলাদা করে তার পালন করবার দরকার নেই।