অণুগল্প।। ঝড়বৃষ্টিরাতে।। আনোয়ার রশীদ সাগর
হঠাৎ হারেজানের ঢেউ খেলানো স্বপ্নগুলো তছনছ হয়ে যায়। ঘরের কোণে বাঁশবাগানের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। মনে পড়ে যায়, রেলস্টেশনের মইরদ্দির কথা।
হারেজান যে গৃহস্থ বাড়ি কাজ করতো, সে মালিকের পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে। ওই বাড়ির কর্তা মনির মণ্ডল, তার বউ আনুরা খাতুন এবং হারেজানের স্বামী কিয়ামসহ দূর্ঘটনায় তিন বছর আগে মারা যায়।তারপর থেকে এ বাড়িতে নিজেকে এতিম-এতিম লাগলেও সে টিকে ছিল।
গা-গতরে কাজ করে, হেঁসেল ঠেলে-ঠেলে, তার ছেলেটাকে বড় করে তোলার ছিল বড়ই প্রত্যাশা।
নিজের বাপ-মা’র সাথে কিয়াম মারা যাওয়ার কারণে, এ বাড়ির বড় ছেলে হারেজানের প্রতি বেশ সহানুভুতি দেখিয়ে আসছিল। সবই শেষ হয়ে যায়, গত চারদিনে। বোনরা শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে জমির ভাগ চায়। ছোট দু’ভাই যৌথ সংসারে থাকবে না। তারাও পৃথক হয়ে যাওয়ার জন্য বড় ভাইয়ের শরীরে হাত তোলে। এমনকি হারেজানের সাথে বড় ভাইয়ের মিথ্যা ফষ্টি-নষ্টির গল্প সাজায়।অবশেষে সাত-সকালে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে, যার যার মত, সেই সেই নিজ ঘরে রান্না শুরু করে।শুধু বড় ভাই-ভাবী আর হারেজানের আকায় হাড়ি ওঠে না। দুপুর গড়িয়ে গেলে হারেজানও ছেলেটার হাত ধরে,মায়া-মমতা ভুলে, রেলস্টশনের দিকে হাঁটা শুরু করে। অনেক কষ্টে,রেখে আসে, এ বাড়ির ছোট-ছোট ছেলে-মেয়ে গুলোর প্রতি স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা। একবার পিছনে তাকায় আর একবার সামনে আগায়। সঙ্গে তার ছেলে রিয়াজ মা’র হাত ধরে হাঁটতে থাকে। হারেজান বাম হাত ধরে ছেলেটাকে টানে আর সামনে আগায়।রিয়াজও তার ছোট-ছোট পা ফেলে শক্ত করে,মায়ের হাত ধরে থাকে।
প্রায় বিকেল হয়ে যায়। হারেজানের তামাটের রঙের শরীরটা কালো হয়ে যায়। স্টেশনের ধারে এসে দেখতে পায়, মইরদ্দি চা-পান-বিড়ি বেচায় ব্যস্ত। সে চা’র দোকানের সামনে এসে, ঝুলন্ত একটা পাউরুটি ছিড়ে, তার ছেলে রিয়াজের হাতে দিতেই, ছলছল চোখ পড়ে মহিরদ্দির চোখে। সে চোখে থাকে আত্মবিশ্বাস, মইরদ্দির প্রতি। এই আত্ম বিশ্বাসই, নীড়হারা-ভুমিহীন হারজানকে, মনের টানে টেনে এনেছে, এই কোলাহলপূর্ণ স্টেশনে।
মইরদ্দি অতিদ্রুত ছোট টিনেঘেরা দোকান থেকে বেরিয়ে, রিয়াজকে কোলে তুলে নেয়, বাপজান খিদে লাইগিছে?-
রিয়াজ আধো-আধো শুকনো গলায় বলে, পানি খাবো।
হারেজানের চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি টপটপ করে, তারই সামনে পড়ে। মইরদ্দিও একদিন ওই গৃহস্থবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল।
অপরাধ ছিল, কোন এক ঝড়বৃষ্টির রাতে, বিধবা হারেজানের সাথে মইরদ্দি ভুঁসিঘরে কাটিয়েছিল।
পড়ে ভালো লাগলো।