কাব্যশীলন বইঘর

প্রি-অর্ডারে সফল উপন্যাস অমরাবতীর একটি অধ্যায় থেকে

অমরাবতীর উপন্যাস থেকে একটি অধ্যায়
কজনকে মারল ফরিদরা? সতেরোজন? নাকি আটাশজন? নাকি আটষট্টি? কেউই হিসাব জানে না বোধ হয়। ফরিদ-আজম—এরাও একরকম মরিয়া হয়ে উঠল যেন। কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। আগের মতো গ্যাপ যায় না এখন আর।
এখনো পদ্ধতিটা আবিষ্কার করতে পারেনি ওবায়েদ। তবু হাল ছাড়েনি সে। এদের বোঝানোর জন্য নানানভাবে চেষ্টা চালায় সে। বহু কষ্টে বুঝিয়েসুঝিয়ে আটকে রাখতে চায়। ভয় দেখায়। তাতে খুব লাভ হয় না। সে কজনকে চোখে চোখে রাখবে? ওবায়েদ এখন পুরোপুরি নিশ্চিত, শুধু ফরিদ নয়, অন্য সবাই এর সঙ্গে জড়িত। নইলে এতজনকে মারা সম্ভবও হতো না। ফরিদকে অনেকবার চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছে, তাতেও মৃত্যুর হার কমেনি। ফরিদকে ছেড়ে অন্যদের দিকেও চোখ রেখে দেখেছে। কোনো লাভ হয়নি। বরং অন্যরা তাকে আরও সন্দেহ করছে।
সবকিছু অস্থির লাগে ওবায়েদের। কীভাবে বোঝাবে এদের, মাঝেমধ্যে দুয়েকজনকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সবাইকে মারতে গেলে ধরা খেতেই হবে। ফরিদের না হয় কম বয়স, বেশি ইমোশনাল। আজমও না হয় ইমোশনাল। কিন্তু অন্যরা? কেউ কি বুঝবে না সিচুয়েশন?
ফরিদকে একদিন শক্তভাবে ধরে ওবায়েদ। ফরিদ গায়েই মাখে না তার কথা। সে কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তার সোজা কথা, যেটাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে, সেটাই বের হয়ে আরও কয়েকজন বাঙালিকে মারবে।
ওবায়েদ বোঝায়। বলে, আমিও বুঝি ফরিদ। কিন্তু ধরো আমরা ধরা পড়ে গেলাম।
ওবায়েদকে থামিয়ে দেয় ফরিদ। সে উত্তেজিত হয়ে বলে, আপনাকে না ‘আমরা’ বলতে বারণ করেছি, ওবায়েদ ভাই? আপনি তো নেই আমাদের সাথে। বললে ‘তোমরা’ বলবেন। যা করার আমরা করছি। সেই ‘আমরা’র মধ্যে আপনি নেই ওবায়েদ ভাই।
ওবায়েদ বলেন, আচ্ছা, তোমরা। তোমরা তো মরবেই। মরবে জেনেই করছ। কিন্তু তোমরা মারা যাওয়ার পর তো হাসপাতাল বন্ধ হবে না। বরং আরও কয়েকটাকে মারার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
ফরিদ উত্তেজিত স্বরে বলে, তাই বলে ছেড়ে দেব। ভেবে দেখেছেন, এরাই আবার সুস্থ হয়ে আমাদের ভাইদের মারবে। সে অর্থে আমরাই কি আমাদের ভাইদের মারছি না?
ওবায়েদ বলে, ধরে নাও বড় কিছুর স্বার্থে ছোট কুরবানি দিচ্ছ। মেনে নাও ফরিদ।
ফরিদ মানতে চায় না। আজমরাও কেউ মানতে চায় না।
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। এখনো তালপাকা গরম। যদি নারকেল পাকার কোনো ব্যবস্থা থাকে, এবার মনে হয় তা-ই পেকে যেত। গরমে সবকিছু অস্থির লাগে। সবারই পরিবারের কথা মনে পড়ে। ওবায়েদ ভাবে তার স্ত্রী ছবির কথা। দুই সন্তান মহি আর ওহির কথা। ফরিদ-আজমরা ভাবে তাদের পরিবারের কথা। ফরিদ কাঁদে এখনো। ফরিদকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েই নিজেদের শোক ভুলে থাকে অন্যরা। চেষ্টা করে, ফরিদের সামনে যাতে কোনো ধরনের দুর্বলতা ধরা না পড়ে। সবাই তাকে একধরনের স্নেহের চোখে দেখে। আবার তাদের দলের অঘোষিত নেতাও এখন ফরিদ।
আগস্টের শেষ দিকে এক সৈন্য এল পায়ের পাতায় গুলি লেগে। দেখতেই ডাকাতের মতন। গুলি লেগেছে, ভাবে মনে হচ্ছে পায়ে কাঁটা ঢুকেছে। ফরিদ ফিসফিস করে বলে, ওবায়েদ ভাই, আমি নিশ্চিত, এর বাপ জল্লাদ। নইলে কসাই। ব্যাটা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করে।
ওবায়েদ হাসতে হাসতে বলে, ফরিদ, আমরাও কিন্তু এখন হাসতে হাসতে মানুষ খুন করছি।
ফরিদ আহত চোখে তাকায়। ওবায়েদ ‘আমরা’ উচ্চারণ করায়, নাকি ফরিদদের খুনি বলায় সে আহত বোধ করছে, ঠিক বোঝা যায় না অবশ্য। সে বলে, ওবায়েদ ভাই, আপনি আবারও এদের মানুষ বলছেন? এরা একজনও কি মানুষ? হাত-পা-চোখ-মুখ থাকলেই বুঝি মানুষ হয়?
ওবায়েদ বলে, হয় ফরিদ। হাত-পা-চোখ-মুখ থাকলেই মানুষ হয়। যুদ্ধ এদের পাল্টে দেয়। দেখো, এরও ছোট্ট একটা মেয়ে আছে হয়তো তোমার মতো। হয়তো এ-ও নিজের বাচ্চার সঙ্গে বল খেলে। ঘোড়া সেজে পিঠে ওঠায়। চিঁ হিঁ হিঁ শব্দ করে। এর স্ত্রীও এর জন্য অপেক্ষায় বসে আছে, কবে যুদ্ধ শেষ হবে, স্বামী ফিরে যাবে বাড়ি। যুদ্ধ বড় খারাপ জিনিস। সবাইই এর অবসান চায়। যত দ্রুত সম্ভব।
ফরিদ মাথা নাড়ে। সে এটা মেনে নিতে রাজি নয়। বলে, আপনি জানেন, ব্যাটা সেদিন কী বলছিল? পাশের বেডের সৈনিকটাকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, কটাকে মারলেন? আমি আজই তিনটা মেরে এলাম। একটাকে ন্যাংটা করে পিটিয়েছি। তারপর সোজা ‘ওখানে’ গুলি করেছি। হঠাৎ এক ব্যাটা মরতে মরতেও কীভাবে কীভাবে যেন গুলি করল। কপাল খারাপ ছিল দেখে পায়ে এসে লাগল। দিয়েছি ব্যাটাকে পরে। অন্তত তেরোটা গুলি করেছি মাথায়। কোনোমতে সেরে উঠি, এর শোধ নেব।
সেই সৈনিক বলল, মাথায় তো গুলি করলেন তেরোটা? আবার কী শোধ নেবেন? তেরোটা গুলি খেয়ে তো বেঁচে থাকার কথা না।
ব্যাটা কিছুক্ষণ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল। ডাকাতের মতো দেখতে এই হারামজাদাটা আবার কী বলে জানেন? বলে, এরপর যে ব্যাটা মুক্তিকে পাব, চৌদ্দটা করে গুলি করব। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি। জোড় সংখ্যা হলে ভাগাভাগিতে সমস্যা হবে না। নইলে তো পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন বলবে, আমরা সাড়ে ছয়টা গুলি পাব। ভাগ করতে গেলে বলবে, তোমাদের অর্ধেকটা বেশি বড়। হা হা হা…
…এমন কুৎসিত রসিকতা আমি জীবনে শুনিনি, ওবায়েদ ভাই!
ওবায়েদ কিছু বলে না। ফরিদও কিছু শোনার জন্যই তাকিয়ে আছে। কিন্তু কী বলার থাকে ওবায়েদের? কোনো জবাব না পেয়ে ফরিদ বলে, এই ব্যাটাকে আমি মেরে ফেলব। বাঁচতে দেওয়া যাবেই না।
ওবায়েদের ক্ষীণভাবে মনে হয়, ফরিদ বোধ হয় সত্যি সত্যি একে মেরে ফেলবে। কিন্তু এতটা বোকামি কি ফরিদ করবে? পায়ের পাতায় গুলি লেগে এসেছে, এই রোগী মারা গেলে তারা সবাই ধরা খেয়ে যাবে, এটুকু বুদ্ধি নিশ্চয়ই ফরিদের আছে। তবু সে সিদ্ধান্ত নেয়, ফরিদকে চোখে চোখে রাখবে। একা ছাড়া যাবে না।
ফরিদকে চোখে চোখে রেখেও কোনো লাভ হয় না। ফরিদই; কিংবা অন্য কেউ সেই রহস্যময় পদ্ধতিতে মেরে ফেলে সৈনিকটিকে।
.


পায়ের পাতায় গুলি লাগা মানুষ কীভাবে দুদিনের মাথায় মারা যেতে পারে? কী অদ্ভুত! শোনা যেত, প্রাচীন যুদ্ধের সময় তিরের ডগায় বিষ মাখিয়ে সেটা ছোড়া হতো। ফলে আহত ব্যক্তি মারা যেত তীব্র বিষক্রিয়ায়। এরাও কি গুলিতে-টুলিতে বিষ মেশায় নাকি? সৈন্যটি যেন অ্যাকিলিস, গোড়ালিতে তির লেগে মারা গেছে।
কর্নেল শামসেদই প্রথম বললেন, আচ্ছা, এমন হতে পারে না, বিষ পরে মেশানো হয়েছে? বিষ মিশেছে। সেটা আগে না পরে, সেটাই বের হওয়া জরুরি।
অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকমল আর কর্নেল শামসেদ। দেয়ালে একটা পেন্ডুলাম ঘড়ি দুলছে। সেটার দুলুনি দেখতে দেখতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকমল বললেন, বলতে চাইছেন এখানকার কেউই বিষ দিয়েছে? কারা? সার্জন? কিন্তু তারা তো আমাদেরই লোক। তারা কেন বিষ দেবে?
কত কারণ থাকতে পারে! হয়তো সার্জনদের মধ্যে ওদের কোনো চর আছে। হয়তো অন্য কোনো অজানা কারণ। কিংবা…
আগের কথার খেই ধরেই কর্নেল শামসেদ বলতে থাকেন, সার্জনদের যারা অ্যাসিস্ট করছে, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টদের কেউ। কিংবা অন্য কেউ। কতজনই তো আসা-যাওয়া করে একটা হাসপাতালে। তবে আমি নিশ্চিত, এটা কোনো বাঙ্গালির কাজ। অন্য কারও কোনো স্বার্থ থাকতে পারে না।
আচ্ছা এমন কি হতে পারে না, সৈন্যটির সঙ্গেই কারও শত্রুতা ছিল। সে-ই এ কাজ করেছে!
কী বলছেন? যুদ্ধের সময় এখন আমাদের শত্রু শুধু পূর্ব পাকিস্তানিরাই। আর ভারত। ওরাই চাল চালছে। কিন্তু এখানে ভারতের কে আছে? তার মানে বাঙ্গালিরাই। আপনি দ্রুত লাশ পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। পোস্টমর্টেম হোক। তখন আসল কালপ্রিটকে বের করা সহজ হয়ে যাবে।
ওকে। ততক্ষণ বাঙ্গালিগুলোকে চোখে চোখে রাখা হোক। আমার ধারণা কালপ্রিট অনেক।
চোখে চোখে রাখার কোনো দরকার নেই, আকমল। বরং সবকিছু স্বাভাবিক দেখান। ওদের জানিয়ে দিন যে লাশ পরিবারের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
এর মধ্যে যদি নতুন কোনো রোগী আসে?
আসুক। কতজন মারা গেছে এ পর্যন্ত, হিসাব কষেছেন? আর দু-চারজন মারা যাক দুদিনে। আমি চাই না, কেউ বুঝুক এদের সন্দেহ করা হচ্ছে। এমন হওয়ার সম্ভাবনাও শূন্য নয় যে এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা। এদের সন্দেহ করা হলে বরং কারও কারও মাথায় ঢুকে যেতে পারে যে এভাবেও তো এদের মেরে ফেলা যেতে পারে। সেটা কারও মাথায় ঢোকাতে দিতে চাই না।
আচ্ছা।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেতে কদিন লাগতে পারে?
বড়জোর সপ্তাহখানেক, কর্নেল স্যার।
আপনি ব্যবস্থা করুন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে পাঠান। অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। মনে রাখবেন, সবাই জানবে, লাশ পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ওকে কর্নেল স্যার।
দ্রুত করুন। খুব চাপে আছি। আতঙ্কেও।
.
পায়ের পাতায় গুলি লাগা রোগীর মৃত্যু সিএমএইচে থাকা ওপরের সারির সমস্ত অফিসারের মধ্যে তীব্র আগুন ধরিয়ে দিল। যদিও সবাই জানে, লাশ পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আসলে পাঠানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের পিএনএস সেফা হাসপাতালে। এরা এখনই ধরা দিতে চাইছে না। কিছু একটা ঘটছে যে, এটা স্পষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *