ঈদসংখ্যার কবিতা।। মিনার মনসুর
তাকডুম তাকডুম বাজে…
জীবিতরা নিরুদ্দেশ। বিউগল বাজেনি, হয়নি একুশবার তোপধ্বনি─ তারপরও জয়বাংলার
রক্তগালিচায় ঢেকে সসম্ভ্রমে যাদের রেখে এসেছিলাম তোমার জিম্মায়─ আমি তাদের ফিরিয়ে
নিতে এসেছি। হে বিবর্ণ আম্রকানন, ফিরিয়ে দাও আমার যৌবন। অকস্মাৎ ঘন কুয়াশায়
ঢেকে যায় রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। হিমশীতল জলের চাবুকে আর্তনাদ করে ওঠে বেআব্রু বনভূমি।
সেই বার্তা পৌঁছে যায় বটতলায় কবিদের আড্ডায়।
কী এক অলৌকিক উচ্ছ্বাসে রাতুল দেববর্মণের রাজসিক চোখ থেকে মুখ থেকে রাশি রাশি নক্ষত্র
ঝরে পড়ে। ‘বুঝলানি বাংলার কবি, আমি তহন বাইশের যুবক। লিচু বাগানে লাইন ধইর্যা হেরারে
ঘুম পাড়াইয়া রাখছিল। ছুডু ছুডু পোলাপাইন সব। ব্যানার্জি বাড়ির লিচু, কী যে মজা
আছিল তার! অহন কিচ্ছুই খুঁইজ্যা পাইবা নারে পরানের ভাই। তাকডুম তাকডুম বাজে…!’
‘কেডা কইছে, নাই? আছে, আছে, হগ্গলেই আছে। ফরেস্ট রিসার্চ সেন্টারের কংক্রীটের তলে
ঘাপটি মাইর্যা আছে।’ গোমতী হাসে। ‘মেলাঘর, তুমারে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। বুঝি
বুঝি, তোমারও বুক চিনচিন করে! পাহাড়ের বেডি আমি। হাজার বছর ধইর্যা ঘর করি পাষাণের
লগে। কিন্তু মানুষ এমুন পাষাণ ক্যান─ বুঝি নারে ভাই।
চক্রব্যুহ
অভিমন্যু জানতো না তাতে কী, আপনি তো জানতেন সব! মহাভারত যাঁকে ত্রাতা বলে জানে
আপনার অভিন্ন হৃদয় সেই মহান সারথি─ যাঁর অঙ্গুলি হেলনে খা-বদাহন হলো, কুরু পাণ্ডবের
রক্তে রচিত হলো অন্য এক মহাভারত─ তাঁরও অজানা ছিল না কিছুই। সর্বোপরি, মাথার ওপর ছিল
ভগবৎ-ছায়া। তারপরও কী অবলীলায় যে ছিল আপনার ছায়াসঙ্গী সেই গাণ্ডীবও অবাধ্য হলো।
খড়কুটোর মতো উড়ে গেল দেবদত্ত অব্যর্থ অস্ত্রশস্ত্র যতো। তুচ্ছ রাখাল বালকের হাতে লুণ্ঠিত হলো
আপনার যত শৌর্য ও সম্ভ্রম।
অভিমন্যু অর্বাচীন, কিন্তু আপনি তো কৃষ্ণসারথি, সব্যসাচী! (আপনার কর্ণযুগল স্বাক্ষী)
জগদ্বিখ্যাত একটি মহাকাব্য লেখা হয়ে গেছে আপনার উছিলায়।
বলুন কীই-বা ফারাক তবে?
২
যে-নামের ওপর মহাভারতের আভূমিলুণ্ঠিত বন্দনা ঝরে পড়ে─ ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা
সুপেয় জলের মতো পান করে যাঁর চরণামৃত সুধা─ দেখো, মহাপ্রস্থানের পথে মুখ থুবড়ে পড়ে
আছে তাঁর অপ্রতিরোধ্য রথখানি। পার্থসারথি মন্দিরের বেয়াড়া বলদও মাড়িয়ে যায় তাঁকে।
কর্মেই তোমার অধিকার─ কেবল কর্মেই তোমার অধিকার─ আহা, এ গূঢ়তত্ত্ব আপনার চেয়ে
ভালো কে আর জানে! কুরুক্ষেত্র স্বাক্ষী, কর্মের করোটি আর রক্তস্রোত আপনিই তো ঢেকে
দিয়েছেন মহাভারতের জটিল মানচিত্র।
এখন কূলে একা বসে আছেন, কোথায় ভরসা!
৩
পেছনে ফেরার কথা ভাবছেন? ওসব ভাবা-টাবার কাজ যুধিষ্ঠিরের ওপর ছেড়ে দিন– পথের কুকুরও যার
ওপর ভরসা রেখে ঠিক পার হয়ে যায় স্বর্গ ও নরকের জটিল গোলকধাঁধা। আপনার তো ছিল কেবল
গাণ্ডীব আর এক কৃষ্ণ বাজিগর। সব পাখি ওড়ে গেছে। পড়ে আছে জংধরা খাঁচা।
খাঁচার আবার কিসের এতো মরা-বাঁচা!
৪
পার্থসারথি মন্দিরে যথারীতি উপচে পড়বে জনতার ভিড়। পাঁঠার করুণ মুণ্ডুখানি ঘিরে ক্রমেই
উদ্দাম হয়ে উঠবে পাণ্ডার খড়্গ-নৃত্য। বেয়াড়া বলদেরা দাপিয়ে বেড়াবে মন্দিরের চারপাশ। মুহুর্মুহু
উলুধ্বনি হবে। ঘণ্টার শব্দে প্রকম্পিত হবে আসমুদ্রহিমাচল।
কেবল আপনিই হাঁটু ভেঙে পড়ে থাকবেন মহাপ্রস্থানের পথে।
৫
চারটিই দরোজা। তিনটি তার বেদখল হয়ে গেছে। জরায়ুমুখ বন্ধ করে উধাও হয়ে গেছেন
জন্মদাত্রী। (‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনা-জালে,/হে ছলনাময়ী’)
সম্মুখে গর্জমান কুরুক্ষেত্রের তরল অন্ধকার। হয়ত সেখানেই ওত পেতে আছে গোপালক দস্যুদল─
যাদের উদর থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে ক্ষুধা ও বঞ্চনার ক্রুদ্ধ লালা। গাণ্ডীব বিগড়ে গেছে। তার চেয়েও
বিশ্বস্ত আর লক্ষ্যভেদী যে দুটি চোখ তারাও বিমুখ আজ। অসূর্যম্পশ্যা যাদব নারীরা লুট হয়ে
গেছে আগেই। তাহলে আর কীই-বা থাকলো বাকি?
চলুন, সামনেই যাওয়া যাক।
মুক্তি
তার স্পর্ধা দেখে সূর্যও ভ্রু-কুঞ্চিত করে।
অতলান্তিকের ক্রুদ্ধ জলরাশি তাকে শাসায়। কুয়াশার কাফনে আপাদমস্তক মুড়ে অদ্ভূত ভঙ্গিতে যিনি ঝুলে আছেন জল-স্থল আর অন্তরীক্ষজুড়ে তার ভৌতিক নীরবতার ভাষাও কম ভয়ঙ্কর নয়। কত নিরীহ-দর্শন এই খাঁচা, অথচ কী বিশাল তার সৈন্যসামন্ত! কী প্রচণ্ড তার দাপট।
তবু ইকারুস শূন্যে ভাসিয়ে দেয় তার মোমনির্মিত দুই ডানা। ঘুরপাক খায় সূর্যদেবের ক্ষুধার্ত অগ্নিরথ ঘিরে। সহস্রবর্ষী খাঁচা রুদ্ধশ্বাসে তাকে দেখে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না তার।
হা করে আছে তেরশত লেলিহান আগুনের নদী। জল-স্থল আর অন্তরীক্ষজুড়ে মহাপরাক্রান্ত সূর্যের ক্রোধ। তবু ইকারুস উড়ছে।
তুমি শুধু পোড়ামাটি চেয়েছিলে
কোথায় না দেখেছি তোমাকে!
কত নামে কতবার নাজেল হয়েছো তুমি এই ধরাধামে;
পৃথিবীর পথে পথে পরিত্যক্ত খুলিতে খোদিত আছে সব কীর্তিগাথা।
খাণ্ডব খেয়েছো তুমি; তোমার পোট্রেট
আঁকা আছে কুরুক্ষেত্রের বিশাল ক্যানভাসে। গোয়েরনিকায়
তোমাকেই এঁকেছেন পাবলো পিকাসো তাঁর মহান তুলিতে।
মাই লর্ড, আর কত সাক্ষ্য চাও তুমি?
গ্যাসচেম্বারের বধির দেয়াল কি যথেষ্ট নয়?
কান পাতো কালিদহে— দজলা-ফোরাতে।
সপ্তডিঙ্গা ডুবিয়েছো— চাঁদগৃহে চরিয়েছো ঘুঘু।
ভিয়েতনামের নদী নারী আর নীলিমা যখন পুড়ছিল,
পাইলটের পাশের সিটে বসে তুমি হাসছিলে।
পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকার আকাশে শেষবার
তোমাকে দেখেছি; তুমি শুধু পোড়ামাটি চেয়েছিলে–
শুধু পোড়ামাটি! অপূর্ণ বাসনা নিয়ে তাই বুঝি
আবার এসেছো ফিরে এ-বাংলায়। কলার ভেলায় যার সমগ্র জীবন
তাকেই পোড়াতে চাও সামান্য আগুনে! বণিকের বহু আমি—
কার সাধ্য নত করে অধমের অনত মস্তক!
যতই পোড়াও তুমি— চাপা দাও মাটি—
ছাইভস্মের ভেতর থেকে ফের জন্ম নেব আমি।