কবিতা

রাসেল আশেকীর।। গুচ্ছ কবিতা

মনে পড়ে সেই অক্ষয় মাঝির কথা

মনে পড়ে, অর্ধমানুষ অর্ধপশু তাড়ানো রাখালের মতো
নদী ও বায়ুপোষা শক্ত সুঠাম গর্দানসীন সেই অক্ষয় মাঝির কথা!
যাঁর যাদুময় কণ্ঠের থেরাপিতে, সত্যেশ্বর প্রাণেস্মরে,
জাগতো মাটি, নামতো আকাশ, মানুষের ময়দানে
স্বাধীনতার মাঠে।
আমরা থাকতাম প্রবাহে প্রাণবন্ত, উৎসবে পঞ্চমুখ।

কিন্তু মৃত আত্মার কিছু জীব তাঁকে হত্যা করে রাখলো
পূজার বেদিতে, বসালো দেবতার আসনে!
তারাও ছাই-ভস্ম হয়ে উড়ে গেল চিরমৃত্যুর কাফনে!
ভালোবাসা ফিরে গেল স্বর্গে, নেমে এলো নরকের যন্ত্রণা
বিষবৃক্ষের ছায়াতলে!
কেউ দেখলো, কেউ দেখলো না, কেউবা আসন গাড়লো
সিংহাসনের লোভে!
আর মনভাঙা মনমরা মানুষের দৃশ্য দেখতে দেখতে
আবেগভরা নারী ও মায়াকুমারীর মতো কান্নারত চোখে
নদী ও মাঠগুলো আরেকজন মাঝির আগমনের দিনক্ষণ গুনতে লাগলো–
আমি বললাম, মাঠবেষ্টিত নদীসকল শোনো, আবর্জনাস্তূপ থেকে বেরিয়ে দেখো, এসে গেছে
সেই রাখাল, সেই মাঝি।
ওরা মুগ্ধশ্রোতার মতো আমার কথা শুনলো এবং
তা-ই হোক, তা-ই হোক, বলে স্রোত ঘুরিয়ে দিলো
মহাস্রোতের দিকে, মহাগর্জনে বেরিয়ে এলো মানবদরিয়া।
আর আমার আত্মাস্মরের টানে উপবিষ্ট বালক-বালিকা
সারি সারি গাবগাছ হয়ে ড্যাবড্যাবে চোখে
হা-করে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে
কেউবা নকল রাখাল সেজে অনুসরণ করতে লাগলো
আমার ভাষা ও কথার পোশাকসহ আলোর শহর
গড়ার গোপন হাত!
তৎক্ষণাৎ সাতপাকে ঘুরে দাঁড়ালো বাতাস, আর আমার ভিতর দিয়ে এলো সেই কণ্ঠস্বর–
বারবার আমাকে মারলেও মরি নি আমি…
দেখো, দেহহীন হাঁটছেন তিনি।

আপনার জন্ম একটি নতুন সময়ের ইঙ্গিত

পথবিন্দু থেকে রক্তবিন্দুর সিংহাসন অবধি
বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বমানবতার জননী
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা
আপনার প্রতি নিবেদিত এই কবিতা…

পথের দূর্বাঘাসও আপনাকে চেনে
আপনাকে চেনে তালগাছে ঝুলে থাকা বিরল বাবুইপাখি
খুব বেশি চেনে ভোরের কাক ও কোকিলের চোখ
আর দোয়েলের শিসে দোল খাওয়া ঝিঙেফুল মৌমাছি।

অমন চেনার সরলতায় ফড়িং প্রজাপতি
তুলতুলে ডানায় আপনাকে দেখায়, আর বলে, ‘ভূমণ্ডলে
আপনার তুলনা আপনি, আপনার বিকল্প আপনি
আপনার কর্ম অশেষ, আপনি দাঁড়ালে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।’
আর কই মাছের ফুসফুস থেকে বেরোনো বাতাস
প্রবল জীবনীশক্তির মধুর বিস্ময়ে জানায়
‘আপনি সেই রত্নগর্ভের সুযোগ্য পরমা
বিমূর্ত থেকে মূর্ত যুগের আলোকবর্তিকা।’

এখনো আপনি অমল পুরাণের সেই দুর্গতিনাশিনী
আর ইতিহাসের নেফারতিতির মতন স্বজাতির মুখে
হাসি ফোটাতেই সমপৃথিবীর জনসমুদ্রে একাই এক
উন্নত শির দেশমাতৃকা!
যেদিকে তাকান সেদিকেই আলোর ভুবন
যেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন সেখানেই আঁধার ভীষণ!

যেভাবে আপনার আত্মার অশ্রুতে-ভরা নদীও জেগে ওঠে পৃথিবীর সবুজে, ক্ষমাও হতে থাকে ভালোবাসার
বিকল্প শক্তি!
কেননা, আপনার জন্ম একটি নতুন সময়ের ইঙ্গিত
আর পিতার মহাস্বপ্নের মুক্তি।

যে মুক্তির অনন্ত আলোয় জেগে উঠছে একটি সাহসী
মানুষভূমি, আপনি সেই সাহসী মানুষভূমির
মমতাময়ী জননী।
সালাম সালাম সালাম হে বিশ্বমানবতার জননী
সালাম আপনার প্রতি।

মাটির জবান

আমি সাদাকে সাদা কালোকে কালো রঙে চিনি
হাজারো মিথ্যার মধ্যে থেকেও সত্যকে ভালোবাসি।

জানি, কোথাও ভয়ের কিছু নাই
তবু চলছে ভয়ের কারবার, আর লজ্জা বিক্রির হিড়িক।
সম্ভাবনার চোখে মুখে আস্থার অবক্ষয় দেখতে দেখতে
আমিও পড়েছি প্রতারণার ফাঁদে, আমিও গিয়েছি
অসম্ভবের কাছে, সম্ভবের নবোদ্যমে। তবু
মানতে পারিনি, করুণ মানবিক দুর্যোগে
চরম বৈরী হাওয়া।

কেননা, এখনো ফুরিয়ে যায়নি আশা
স্বপ্ন আর সাধ্যের পায়রা এখনো মেলছে ডানা।
আকাশের রঙে এখনো বাতাস ফুরফুরে করে দেয়
গাছের সবুজ পাতা। এখনো রাত গভীর হলে জাগে সূর্য। পাখিরাও উপভোগ করে দিগন্তের আলো–
তাড়িয়ে মাড়িয়ে উড়িয়ে ভাসিয়ে
অসঙ্গতি আর বৈষম্যের খেলা।
শান্তি আর স্বাধীনতা চির প্রত্যাশিত বলেই,
এখনো চুল পরিমান নড়চড় হয়নি মাটির জবান– পুরো মুল্লুকজুড়ে উঠছে আওয়াজ : স্বাগতম, স্বাগতম হে সত্যদ্রষ্টা- বিশ্ববন্ধু।

এখনো খুঁজি সেই পথস্রষ্টা, যার সাক্ষাৎ পেতে
প্রতিটি মুখ দেখতে হয় অন্তর্চোখে, অদৃশ্যের দৃশ্যপটে।
কেননা, গভীর থেকে জেগে ওঠা প্রেমে কেউ নাই
তার স্থানে।
সেই-যে আমার বাল্যবন্ধু, ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র
নূরুল ইসলাম হতে পারতো দেশের যোগ্য দিশারী–
রাষ্ট্রনায়ক কিংবা মন্ত্রী। কিন্তু রাজনীতির শক্ত কনুই
আর পকেটছেঁড়া থাবা, তাকে নিয়ে গেছে কবিতার
সদর দপ্তরে।
সে এখন নতুন নতুন কবিতার শিরোনামগুলো আওড়াতে আওড়াতে পায়চারি করে রাজধানী ঢাকার
ফুসফুস : সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ, কাটাঁবন!

আর সেই পরমাসুন্দরী কোকিলকণ্ঠী শাহান আরা, যে বিশ্ববিদ্যালয় মাতিয়ে হতে চেয়েছিল দেশমাতানো কণ্ঠশিল্পী। আজ তার কণ্ঠ ভারি! সে এখন বিত্তবান স্বামী আর উন্মাদ সন্তানদের খোয়াড়ে বন্দি।
ভাত-কাপড়ের বিনিময়ে বেছে নিয়েছে
একপ্রকার জেলজীবন!

আর সেই জিন্দার আলী, রো রো রবে ডাকছাড়া
রফু পাগলা, দরবেশ বাড়ির হাশেম ফকির, অন্ধবাউল,
আয়নাল দাদু–যারা সহজ জীবনের সরলতায় নিজেকে রাখতো পদ্মসাদা। আজ তারা একা, নিঃসঙ্গ, বিরল–মুখে একটাই প্রশ্ন, আমরা কোথায়?
যেভাবে কষ্টে থাকা আইজুদ্দিন করুণকণ্ঠে বলতো,
দিল্লী বহুদূর, আমেরিকা আরো দূর, আমার কবর কোথায়?

আর যে জন্মভূমি রক্ষার শিরদাঁড়া
আগুন-আলোর তরঙ্গবাহী অভিভাবক,
মঙ্গল মৈত্রীর বিবেক, আঁধারভাঙা নেতা, ভুবনজয়ী শাসক–কেউ কি জানেন, মানুষের শেষ পরিণতি কোন
অভিধায়?

আর যারা দেশের মালিক, ক্ষমতার স্তম্ভ–সেই জনগণ
আজ রিপুর হাবড়ে স্থানচ্যুত মূল্যভ্রষ্ট তন্দ্রাচ্ছন্ন বলে
বিদিশার চক্করে চক্করে হায় হাঁটুজলে হাবুডুবু দশা
আর অনেক কথার ভিড়ে একটি কথাই জেগে ওঠা
যেখানে ভয় সেখানে জন্মে সাহস, দাঁড়ায় বীর
পাখিরাও খুঁজে নেয় প্রশান্তির ছায়ানীড়।

গণিত শাহ

যখন তোমাকে ভাবি
সে ভাবনা তোমার মধ্যে থাকে না
হয়ে যায় সবার, সবার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে
তুমি এত বড় এত সহজ ভাবতে পারি না ভাষায়।

ক্ষুধা তৃষ্ণা ব্যথায়–সুখ দুঃখ আনন্দে
সমান তোমার গতিবেগ। ঘর আছে কী নেই
রিজিক কার হাতে, কী ঘটতে যাচ্ছে কী ঘটবে
কোনকিছুই ভর করে না তোমায়, জীবনের প্রয়োজনে
শান্তির আয়োজন ছাড়া।
তবে কি তুমি গণিতের গণিত শাহ
আলগোছে মাথায় তোলো জগতের সত্য
সুপথে রাখো পদচিহ্ন। ভয় নাই
আছে সাহস, ক্ষয় নাই আছে খাদ্য, মিলবে ঠাঁই
বাণীবাক্যে স্থানকালপাত্রে ঘটাও শান্তির প্রবেশ
মেলাও শান্তির হাট, যাও শান্তির আড্ডায়।

কী করো কী খাও কার সাথে থাকো
হিসাব মেলে না কারো, তবু পাগল সময় থাকে
ক্ষমতার সাথে খবরদারির খেয়ালে! তুমি সময়ের
গলায় হলুূদঘণ্টা বেঁধে খোলা মনে হাঁটতে থাকো
আগে আগে, সাথে নিয়ে প্রেম প্রেরণা গতি,
বাণীবহ থেকে আসমানকান্দি যেতে যেতে ভাবো,
পৃথিবী মহাবিশ্বের প্রেমতলা, সেখানে তুমি
হাতকে ছিঁড়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করো না কেন,
কার হুকুমে–জানে সব মাঠ হাট ময়দান।
তোমার সাথে কারো চলে না মান অভিমান
তুমি অভিনব পন্থায় নিত্য কর্মরত, নিজেই নিজের
অভিযোগ করে বশ, আগাছা তুলে লাগাও গাছ।

অতঃপর, বারবার বহুজন্মে বহুরূপে যুগে যুগে
অঙ্কিত তোমার কর্মরেখা উচ্চারণ করো হে আমার
সশব্দ পুরুষ–জীবনের সাথে যোগ করে স্বাধীনতা মুক্তির পথ, হৃদয়ে সংযোগ করে নতুন নাম নতুন অধ্যায়। শহরে বন্দরে গঞ্জে গ্রামে বিন্দুতে বিন্দুতে
ডিজিটে ডিজিটে পরিবর্তিত হওয়াই তোমার
অঙ্গীকার, বুঝে দুনিয়াদারির শুভঙ্করের ফাঁকি!
যখন তোমাকে ভাবি
সে ভাবনা তোমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না
হয়ে যায় সবার, সবার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ো তুমি।

তবু কারো কারো অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য
কোনো কোনো পুত্র-কন্যা মাটির সুযোগ্য
সবার জন্যই তুমি ন্যায়বিচারক, ন্যায়দণ্ড কাঁধে
তুলে বলো–মাটিতে সবার অন্ন, টাকাতে সবার হক
সুন্দরে অধিকার প্রতিটি চোখের, কাজের দাবিদার
প্রত্যেক হাত…
বলতে বলতে গ্রাম থেকে ঘর হয়ে
হাতে হাতে ঘোরা পৃথিবী দেখতে দেখতে
বাড়তে বাড়তে হাসতে হাসতে জগৎসংসারের
অসাধ্যকে সাধ্যে আনার সাধনায়, অধরাকে ধরার
ক্ষমতায়, বিশ্বনেতার দরবারে হয় তোমার অাবির্ভাব
হয়ে আলোর দোকানদার।

মানুষের সাথে মানুষের সংযোগে তুমি অন্তর বিজ্ঞানী
বিশ্বের আপনজন, কথার ওজনে কমাও কষ্টের বোঝা।
পথের ধূলি মেশে সবার সাথে চেয়ার পারে না জেনে
মানুষের কথা শুনতে শুনতে নিজের কথা লাগাও কাজে
কুদরতি নজরে মোছো চোখের ময়লা জ্বালাও দেহবাতি
ঢেউখেলা মাঠের বাতাসে থাকে না অভাব বাড়ে চাহিদা
কেননা, নাই বলে কিছু নাই জগতে আছে অফুরন্ত
হয় চাওয়ামাত্র।
তুমি প্রেমে শান্ত প্রতিবাদে প্রচণ্ড বিপ্লবে বীর পণ্ডিত
বিরোধিতা নয় সহযোগিতায় রাখো হাত
দিকে দিকে জাগাও সুবর্ণ প্রভাত।
দানে অনুদানে শিক্ষাজগতে উন্মুক্ত করো গুরুশিক্ষা
নতুন দিনের শিশুদের মনে তৈরি করে বিবেকের ঘর।

হে গণিতের গণিত শাহ, পৃথিবী তোমার পাঠশালা
বাড়াও কর্মদক্ষতা, মানুষের হাতে হাতে বিলিয়ে নতুন কাজ। পৃথিবী আজ তোমার দিকে তাকিয়ে মাটিকে করছে প্রণাম, সামনে দাঁড়িয়ে মা দিচ্ছে অভয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *