গুচ্ছ কবিতা তুষার কবির
তাঁবু
ওখানেই পড়ে আছে যতো ঘুমের ঘুঙুর;
মদ মোহ প্রেম কাম আর মধু-
যারা শুধু চাইছে কেবলি আজ ডুবে যেতে
অভ্র, ভায়োলিন আর ভ্রমরের স্বরে-
তাদের আস্তিনে দ্যাখো জমে আছে
সিরামিক রোদ, পরিযায়ী তিতিরের ডানা—
ওষ্ঠের কুঠুরি খুলে তারা জড়ো করে
লালাভ দ্রাক্ষার রস, চকমকি প্রিজমের কণা!
তন্দ্রালস তুন্দ্রাঞ্চল থেকে উঠে আসা
এই তাঁবু—নভোনীল থেকে দেখা যাচ্ছে
ঠান্ডা বরফকুটির—ঝলসানো হরিণীর ঘ্রাণে
শিকারির বুনো রক্ত মেতে ওঠে কুহক বিভ্রমে!
তাঁবুর নিচেই আজ চাইছি দু’হাতে
শাদা শাবকের ডানা, মেদহীন তরুণীর নাভি—
কোয়েল যেভাবে ঘুম দেয় সেই
পালক ছড়ানো ঘুম—স্বর্গভ্রষ্টা ডাকিনীর চাবি!
জঙ্গলে
জঙ্গলের তৃণপথে হেঁটে যাই বিকেলের শেষ রোদে।
পুরনো ছাতিম গাছে নিকেল ঘণ্টির সাইকেল খানিক
হেলান দিয়ে রেখে আমি হেঁটে যাই জেগে ওঠা ঘাসের জঙ্গলে।
কোত্থেকে যেনবা ভেসে আসে শুধু ময়ূরীর মনোলগ—তার মৃদু পাখসাটে মৃদঙ্গ বাজে ধীর লয়ে!
কোথাওবা সুর ওঠে দরবার-ই-কানাড়ার;
কান পেতে আমি শুনে যাই বাগ্দেবীর কড়া নাড়া!
জঙ্গলের কিছুটা ভেতরে গিয়ে দেখি এক ঘুমঘোর সরোবর—যার ছেঁড়া ছেঁড়া পদ্মের কোরকে বেজে ওঠে দূরের সরোদ! টোপাজ পাথর জ্বলে চকমকি রোদে—
ফুঁসে ওঠা সাপের ফণার নিচে;
তার জ্যোতির দ্যুতিতে আমি মিশে যেতে থাকি হাওয়া ও হরিদ্রায়!
এ জঙ্গলেই আমি লিখে যাচ্ছি দ্যাখো ধূলিতে মোড়ানো প্রেমগাথা,
রক্তের হরফে লেখা ভাঁজপত্র আর ছড়ানো পথের নোটবুক!
কানাড়া
আজ পণ্ডিত শ্রীমান যশরাজ এসেছিল আমার ছড়ানো বারান্দায়; তাই বৃষ্টির কিছুটা ছাঁট এসে পড়েছিল হারানো কার্নিশে—আর কামিনী ফুলের ঘ্রাণ জেগেছিল জড়ানো বুকের মাঝে! নীলাভ একটি ময়ূরীর ডানা থেকে ঝরেছিল অভ্রদ্যুতি—জ্যোতির পাথর! কোটরের ফাঁক থেকে গ্রীবা বের করে দেয়া টিয়া আর ডেরা থেকে ছুটে আসা ডাগর ডাহুকী নেচেছিল বৃষ্টির মাতাল শব্দে—জাদুকরী যশরাজ সুরে! দরবার-ই-কানাড়া বেজেছিল তোমার ¯স্নানঘরে—রক্তাভ গোলাপ পাপড়িতে—কোরক ছড়ানো সরোবরে! ভিজে ভিজে শুদ্ধ ¯স্নানে তুমি মেতেছিলে বৃষ্টির আরকে। যশরাজ সুরে সুরে খুলে গেল তোমার শরীরের সবকটি ভাঁজ; আড়মোড়া ভেঙে তুমি ডুবে গেলে সুর লহরীর ইশারায়—জমাট বৃষ্টির শব্দে তুমি হঠাৎ হারিয়ে গেলে সান্ধ্য কানাড়ায়!
শীতচিঠি
শীতের চিঠিরা ওড়ে—জেগে ওঠে মোহ, মায়া, ভ্রম
কে যেন শীতের ব্যথা লিখে যায় অচল পয়ারে
রেস্তোরায় সুর ওঠে—সরাইখানায় জাগে প্রেম
শীতের ওমের খোঁজে চিঠি লিখে কে আর কাহারে!
মধুকণ্ঠি প্রেম জাগে—আরো জাগে রতির পালক
শীতলাগা বেড়ালের চোখে নাচে ঘুম আশাবরী
তাঁবুর মাঝেতে জানি জড়ো হয় খড়ের কোরক
বেজে যায় একটানা—সান্ধ্যস্বরে দূরের কিন্নরী!
তুমিও শীতের কাছে চাও শুধু রক্ত, মাংস, ওম
দূরের পয়ারে দ্যাখো বেজে যায় কান্না পরম্পরা
শীতের সরোদ শোনো—শুধু জাগে প্রত্ন দুঃখক্রম
তোমার নাভির খাঁজে আছে জানি দূর সন্ধ্যাতারা!
শীতের শরীর খুলি, খুলে যায় পাখোয়াজ ভাঁজ
কিছুটা প্রেমের টানে জেগে ওঠে ধূলির পথিক
শীতের বাকল নাচে–ঘুঙুর সুন্দরী দ্যায় নাচ
ঘোড়ার কেশরে দ্যাখো জেগে ওঠে শীতের লিরিক!
নাচঘর
কেয়া ও কামিনীর ঘ্রাণে তুমি ছুটে এসেছ এই সান্ধ্য অপেরায়!
ঘুঙুরের দানা গড়ানো সড়ক ধরে—প্রহরী ও পায়রাঘেরা প্রাচীর পেরিয়ে—তোমার পায়ের ছাপ ধরে আরো এসেছে এক বিষাদ ময়ূর!
নাচঘর থেকে কিছুটা দূরেই পুড়ছিল প্রণয়ীর শেষ পাণ্ডুলিপি—ছায়া ও ছাতিমতলা থেকে আরো কিছু দূরে উড়ছিল মুঠোভরা শাদা পাতা—শুনতে কি পাচ্ছ সেই কান্নাভরা দাহগাথা?
ময়ূর যে পথে হেঁটে যায় তৃণলিপি পার হয়ে—সেই পথে আমিও ছুটে যাই—কোরক ছড়ানো আমলকীবনে!
শোনো, জগতের এই ভ্রম অপেরায়, তুমি আমি সকলেই, পাটাতনে তলিয়ে যাওয়া কোনো দণ্ডিত নর্তক!