আলমগীর রেজা চৌধুরীর গুচ্ছ কবিতা
মানুষ
সুদীর্ঘ রজনীর ঘেরাটোপে কুহক বারবার ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
ও পাখি ও বিহঙ্গম। কণ্ঠ মন্থন করে রাতভর বৃক্ষ কর্তনের
আসুরিক নিনাদে চৌচির। কী কষ্ট ওর। কষ্টের মধ্যে পৃথিবীর
ক্রন্দন। সাবধান। ক্লোরোফিলকাতর ন্যাড়া পাকুরতলায়
গল্পগুলো উপন্যাস হয়ে যায়। উপন্যাস ঝুলে থাকে জলপাইর
মগডালে। পদাবলীর নায়িকা কী জানে,আত্মঘাতী মনুষ্যকূল-
কালোবীজ জরায়ু শরীরে। কাতরায় মানব ক্লোন। হায়
ঈশ্বর! কে বলবান? মানুষ-মানুষ-মানুষ…আমি তো তাই।
মেঘ বালিকার গল্প
হাউজিং আকাশ জুড়ে এরোপ্লেন ওড়ে,
শরতের মেঘ ছুঁয়ে যায় গৃহবধূর স্বপ্নজাল
হাত দিয়ে ধরতে ধরতে জানালার পর্দায় খেলা করে
রৌদ্রস্নাত ভোরের সকাল। চিলতে বারান্দা জুড়ে সাদা
মেঘ বালিকার কলরব। ক্যাসেটে প্রিসলি’র রক এ- রোলের
তুমুল সিম্ফনি। টবে এইমাত্র ফুটেছে নাইনোক্লক।
ওর নাম সুস্মিতা। ও ইডেনে সাহিত্য পড়ে। চন্দ্রাবতীর নায়িকা-
করুণ বিহাগে গেয়ে ওঠে, এভরি নাইট ইজ মাই ড্রিম…
রিসার্চ স্কলার যৌবন পুরুষ ইলিনার ডরমেটরিতে ক্যাথি’র
কোমর জড়িয়ে ট্রাভোল্টার মুদ্রায় মদালস প্রহর কাঁপিয়ে তোলে
সুস্মিতা, মাই ড্রিম-
স্বপ্ন সঙ্গমে সময় বাড়ে। আহারে মধ্যবিত্ত জীবন!
ঠিকুজি
হাঁটু গেড়ে পাকা গেরিলার মতো অব্যর্থ নিশানায় এখানে বসবাস করে
নাবাল বাঙ্গাল ।
প্রেমকুমার নই, বঁইচির মালাগাথা মগ্ন নায়ক
‘জল ভর সুন্দরী কন্যা’ কাতর বেহুলা সেজে প্রেম প্রেম খেলে
করুণ বিলাপে গেয়ে যায় ভাটিয়ালি সংগীত।
সে কি জানে!
মদনকুমার উপাখ্যান হয়ে আছে।
বটবিরিক্ষির ঝুল বেয়ে ঈগল চক্ষু হেনে স্টেন উঁচিয়ে ধরে
তরুণ গেরিলা ময়েজউদ্দিন বাবু,
হাঁটু গেড়ে জন্ম দিয়েছে এই বদ্বীপ-
‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।’
তা তা থৈ থৈ
জল এবং রক্তে শুয়ে স্বপ্ন দেখেÑ গোয়ালে দুগ্ধবতী গাভী,
রশি ধরে থাকা প্রৌঢ় রমণী একজন রহিতন বেওয়া
যার চোখের চাঁদে ওড়ে নীল নীল প্রজাপতি
দূর কদলী গ্রামে ওর বাপের বাড়ি
ও স্বপ্নের পরিব্রাজক,
কষ্টে নীল হয়ে অনুভব করে-
তার সন্তান একাত্তরে রণাঙ্গন থেকে ফেরেনি, রক্তাক্ত নিশান
ওড়ে কার্ণিশে, ছাদে। ও শুধু আকাশ দেশে, মেঘের নিকট
জীবনানন্দের সোনালি চিল ধূসরতায় লীন
ভাবে, জল দাও, দাও বৃক্ষ সংগীত।
তুমি কোন ছাড়?
আমি নাবাল বাঙ্গাল।
কতিপয় মুখ
কী ছিলো নগরীর দরজায়, তুমি ফিরবে কেন?
গাঢ় অন্ধকার, আলোকিত প্রতিভাসে মুখখানি কার !
তুমি ফিরবে কেন?
আমি ওই গৃহ চিনি, ওর যোনিদেশে বসবাসরত
মনুষ্য জীবন, আমার জন্ম সহোদর।
আমাদের মঞ্জুলিকার ভাই, আহ! গুপ্তঘাতক খুন
করেছে সোনার কিশোর।
ওই নগরে একজন রাজনীতিবিদ থাকেন, যে
প্রতিরাতে নষ্টনারীর মাঠে চাষ করে সিফিলিসÑ
যে তোমার মাতা
তুমি ফিরবে কেন?
নগরে তুমি যাবে, খুঁজে নেবে গুপ্ত ফটক
ওফ, ডেভিল! ডেভিল!
আদল
ওই আদল লুকানো যায় না।
সরীসৃপের মতো পিলপিল করে হাঁটে
ওরা আণবিক টোটেম, নাগাসাকি ফসিল
আর শতাব্দীর গভীর ক্রন্দন।
হলুদ বিরাণ মাঠে আহত ঘাস ফড়িং
ফ্যাঁকাসে পাখনায় সবুজ পালিয়েছে।
বাতাসে মাংস পোড়ার গন্ধ,
ওই আদলে হন্তারকের ছায়া
হৃদয়হীন মরু হাহাকার।
বকুলতলার পুকুর পারে জলের মধ্যে যে আকাশ
জলের নাচনে টলমল করে, ওড়ে ঝাঁক ঝাঁক হরিয়াল
এ বিমুগ্ধ ছবি ওই আদলে মানায় না।
যেমন মাসকান্দার কানিবক ঈগল চেনে না।