কাব্যশীলন উৎসব সংখ্যার কবিতা কবি আবুবকর সিদ্দিক
স্বেচ্ছাদণ্ড
পৃথিবীর যত তাপ, যত দুঃখ, যত নখক্ষত,
যেখানে যে চোরামার, যত অপমান, বলাৎকার,
নির্লজ্জের যত হামবড়াই, যেখানে যে
রক্তদাগরাজি, কূটকচাল, জ্ঞাতির লড়াই,
আত্মঘাতে ফর্দাফাই ফুসফুস, যত আর্তনাদ;
সব ভার তোকে কেন মাথা পেতে নিতে হবে কবি?
কী তোর জন্মদায়? কে তোকে মাথার দিব্যি
দিয়ে রাখে কোন্ শর্তে? মূর্খ কবি! কেন তুই
পরের গরল পিয়ে নীলকণ্ঠ হবি? তোর অন্ন
মেরে খায় ভাড়াটে ঘড়েল, তুই অনাহারী!
বল, কে তোকে পোছে? তুই যত গলগ্রহ
জোটাস স্বেচ্ছায়। সূক্ষ্ম তোর চেতনায় বর্বরের
অভিঘাত পড়ে, যেমন ডানায় নেয় বুলেটের দাগ
বালিহাঁস। সংবেদী! সবই টের পাস তুই,
মানুষের বুকচাপা হেঁচকি ও হিক্কা আর
প্রান্তরের স্নায়ুকোষে শিশিরের ছাপাকান্নারোল।
আমরা নিখিলপাপী, তোর কাঁধে চাপিয়েছি
যত পাপতাপ। একালের যীশু তুই কাঁধে
পাথর জোয়াল বয়ে ঠেলে নিবি পাহাড়চূড়ায়;
ওখানে পাতানো আছে ক্রুশকাঠ কাঁটার মুকুট।
এ কি কম শোক
মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে কবিতার ব্যবহার থেকে
এ কি কম শোক!
শুঁড়ের ডগায় কোনো সংবাদ নেই ভালোমন্দ,
এ কি কম শোক!
ন্যাতাকানি নিউজপ্রিন্ট কতটুকু শুষে নিতে পারে?
পচা কুষ্ঠ ঝরছেই।
এই যে বিশাল মহাসংসার এ তো চেনে না
কে বা কবি বটে।
চক্রাবক্রা জামা পরে: প্রেসের কাছেই বসে থাকে,
এইভাবে চেনা দেয়।
মানুষের ছাই আর মানুষের মাটি আর দীর্ণ
ধ্বংসের শব্দ
বাতাসে শুকিয়ে যায়, ঘুরে ঘুরে মরে–বনকানা।
দিক ধিক ধিক
একা একা আত্মক্ষয়ী কবি কী যে করুণ দুবলা,
পকেটে পিগমী প্রেম।
আটকে পড়েছে দেখো কংক্রিটে ঘূরণধাঁধায়,
কে বা তাকে বোঝে।
কবিতার ব্যবহার থেকে সব দূরে সরে যাচ্ছে
এ কি কম শোক!
ঝরে পুঁজ ঝরে রক্ত, কবিরা ইজের পরে শাদা,
কপাল কপাল।
এইটুকু রিপোর্টাজ, এর বেশি কবিতায় নেই,
আর সবই ছিন্ন।
কে নেবে কবির দায়
মাথা মোড়া দাসখৎ ঘুঁটের মেডেল;
রাজভোগে পেট ঠেসে একদিন চোরের মতন
চিরস্থায়ী প্রস্থানে নিকেশ।
ধিক এই গণিকাবিলাস।
এই যে সুখের মল,
এই ভাণ্ডে আকণ্ঠ নিমগ্ন
যাঁহাদের মোক্ষ জোটে, তাঁহারা অমর,
তাঁহাদের খুরে গড় করি, তাঁহারা ঘড়েল।
বরং আমাকে দাও একটুখানি স্বর্গীয় দুর্লভ নির্বাসন
আপ্রভাতসন্ধ্যা নির্জন প্রান্তর বাতাসের বাঁশি;
দাও মুক্তি সুলতানের রাজকীয় রং ও তুলির,
দাও ইচ্ছামৃত্যু চিত্ৰাতীরে অবিমৃষ্য সুলতানের মত।
কে নেবে কবির দায় এ বখিল বৈশ্য সংসারে?
কে দেবে রাজটিকা এ নির্বোধ ম’দো গুঁড়িখানায়?
শব্দ
দেখেছি অনেক কবি শব্দ নিয়ে গুটলি পাকায়,
হড়হড়ে গর্ভস্রাব কারো কারো; সুগমদুয়ারী
এই সব স্বভাবকবির অতিব্যবহারে তূণ
শূন্য হয় খুব দ্রুত; ফলাফল শূন্য থেকে যায়।
কবিতা কি পোষ মানে লম্বা চুলে পাঞ্জাবীর ঝুলে?
এ প্রশ্ন পাকিয়ে ওঠে সঙ্গত কারণে। “অই, কবি যায়,”─
আর্শ্চয! কী দিয়ে সত্যিই শনাক্ত করে ভক্তগণ
জনেক কবিকে আকবির ভিড় থেকে? রহস্য নয় কি?
উড়ে যায় বিদ্যুতের পাখি, তাকে পাকড়ে ধরে কে?
’কবি’। খুঁড়ে খুঁড়ে অমোঘ শব্দটি তুলে আনে কোন্
অতিমানুষ? কবিই। একটি শব্দের জন্য সারা
রাতভর লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত কে? সে তো কবি।
কুঁদে কেটে ডানেবায়ে,─ বার বার তবুও অতৃপ্তি।
একটি শব্দের জন্যে হন্যে হয়ে ফেরে, চুল ছেঁড়ে,
অভুক্ত অনিদ্র রুক্ষ তান্ত্রিকের আচরণ। যেন
বুক ফেটে মরে যেথে বসেছে সে পরকীয়া প্রেমে।
হায়! এই কৃচ্ছ্রতার অর্ধেকও জপেতপে যদি
উচ্ছুণ্ড্য করত তবে হয়ত হত ঈশ্বরপ্রাপ্তি।