কবিতা

গুচ্ছ কবিতা শব্দনীল


রেজীনামা

সকালের রোদ ছুঁয়ে আমার মা প্রজাপতি হতে চায়
ডানা মেলে, নিত্য একটু সময় খুঁজতে
আমি বা তার সংসার সে সুযোগ কখন দিয়েছি কী?
ঠিক মনে পড়ে না।

তার এক জনম যাচ্ছে কেটে ক্ষয়ে ক্ষয়ে
ধোয়াপাল্লার থালাবাসনের সাথে।

একদিন মাকে বললাম, ‘আপনি কবে প্রথম শাড়ি পরেছেন?’
সাধারণ প্রশ্ন কিন্তু কী আশ্চার্য!
এই প্রশ্নে জেনেগেলাম মা হাসতে পারে,
মাও লজ্জার কিশোরী মেয়ের ঢংয়ে কথা বলতে পারে!

অথচ, আমি কখন বিশ্বাস করতে পারিনি,
আমার মায়ের শৈশব ছিলো।


অবোধ যাত্রী

ব্যর্থতার সাথে যেদিন প্রথম পরিচয়
সেদিন ছিল মুখভার করা আকাশ
সময়ের চাকাতলে হারিয়ে যাওয়া এক মুখ
হাত দেখিয়ে বলেছিল,
পেতে চাস আমাকে
তবে এই হাত ভরে
নীল চুড়ি দে,
তাতেই দেখবি প্রজাপতির ডানার মতো
পবিত্র আঁচল বিছিয়ে দিয়েছি।

সদ্য আঠেরো বছরের এক যুবকের পকেট তখন
হাহাকারের দাস
দাসত্বের কল্যাণে, আচলের উষ্ণতা
হলো না পাওয়া।

এক বৃষ্টিভেজা সকালে
মুনিয়া বলেছিলো,
লাল-কালো টিপ যদি দিতে পারিস কপালে
তাহলে দেখা করিস গোধূলীলগ্নে।

যে জীবনে দুপুরই আসেনি
গোধূলী তো সোনার হরিণ।

যেদিন তোমার যাওয়ার হলো সময়
তখন মস্তিষ্কে ঘুরছিল একটি বাক্য
চুয়াত্তরে পা দেওয়া বলকের চিবুকে
চুম্বন করার নামই বেঁচে থাকা।

ত্রিশে থেমে গেছে জীবন
এই জনমে আর চুয়াত্তর আসবে না।

ক্ষণেক্ষণে পরিচয়ের গোলমেলে হিসাবের
অংকে আমি কাঁচা
কফিনের মাঝে শুয়ে থাকা যাত্রীর
কোন ব্যর্থতা থাকে না।


ক্ষণিকের প্রলাপ

একটি মধ্যবিত্ত সংসারে দুটো চড়ুই ঘর বাঁধতে এসে থমকে দাঁড়ায়। তাদের এখন কলকলানি সুখ। এসব ডাল আনতে পান্তা ফুরানো সংসার, তাদের পছন্দ না হওয়ারই কথা।

সুন্দরী চড়ুই ঠোঁটে আহ্লাদ ঢেলে বললো, ‘দেখো এমনটা আমার ভালো লাগে না। কোণাঘুপচিতে শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। তার উপর দুর্গন্ধ, চিৎকার-চেঁচামেচি। তারচেয়ে বরং আমরা আসমানে থাকি। আমার কিচ্ছুটি লাগবে না, তোমার বুকটা হলেই চলবে।’

পুরুষ চড়ুইটি একটু দমে গিয়ে নব্য প্রেয়সীর কামুক ইশারায় জলের মতো সরল হয়ে বললো, ‘চলো তবে এই আকাশ করি দুজনের।’

সংসার থেকে বের হতে হতে মধ্যবয়সী কর্তার সাথে দেখা। সে শুধু মুচকি হাসলো।

কিন্তু আকাশ তার নীলচে আবীর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। কোথা থেকে বেরসিক মেঘ এসে নিজের সম্পর্কে জানান দিতে দিতে ছুটলো দিগন্তের দিকে। মেঘ ছোটে চড়ুই ছোটে, মেঘ ছোটে চড়ুই ছোটে।

কোন এক গাছের আড়ালে এযাত্রায় নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টায় উৎরে, যখন ঝলমলে রোদের দেখা পেলো তখনই সুন্দরী চড়ুই বললো, ‘চললাম তবে, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। বাঁচতে হলে বুক নয় অট্টালিকার কার্নিশ লাগে।’


ভরদুপুরে সন্ধ্যা নেমে এলে

ভরদুপুরে সন্ধ্যা নেমে এলে আমি জীবন নিয়ে পাঠ করতে বসি। প্রথমে হারানো দেবীকে একবার প্রণাম করি, ক্যালেন্ডারের ধুলো ঝেড়ে।

ছেড়ে আসা দিনগুলোকে নাড়াচাড়া করি, প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে রুচিহীন মানুষটির মতো। অনুভব করি, ইচ্ছা থাকা সত্যেও খেতে না পারার কষ্ট।

সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে এরপর, নতুন কিছু খুঁজি। যাকে নিয়ে পরবর্তী অধ্যায় খুলতে পারি। কিন্তু হায়, পুরাণ অধ্যায়ে বারবার ফিরে আসি!

অসময়ের ফুলের মধ্যে যেমন ঘ্রাণ খোঁজে পথিক। তেমনি ভরদুপুরে সন্ধ্যা নেমে এলে আমি জীবন নিয়ে পাঠ করতে বসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *