কবিতা

সঙ্গীতা ইয়াসমিন-এর কবিতা

সম্পর্কের উপাখ্যান

কিছু সম্পর্ক যত্ন করতে হয়;
তেলে-জলে তিল তিল বাড়তে দিতে হয়।
হেমন্তের হলুদাভ পাতার মতো নিরস, নিঃসঙ্গ হতে দিতে নেই,
ঝরে যেতে দিতে নেই অবেলায়; তাতে রক্তক্ষরণ হয়।

কিছু মানুষ-কে বুকের ওমে রাখতে হয়।
হৃদয়ের গোপন খামে, গোপন সিন্দুকে
সোনার ফ্রেমে এঁটে, প্রতিদিন ধূলো ঝেড়ে,
স্মৃতিভ্রষ্টতার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দিতে নেই।
ভালোবাসার মণিহারে জড়িয়ে রাখতে হয় কিছু সম্পর্ক অন্তহীন।

সম্পর্কের ব্যাপ্তির মতো দীঘল হোক ভালোবাসার ঋণ;
সময়ের বিলম্বিত কাঁটায় অনাদায়ী ঋণের পাতায়
কিছু সম্পর্ক নিলামে যাক, বেদনার বেনোজলে ভেসে।
নামহীন হোক কিছু সম্পর্ক অসরকারী খোলসে।
নির্ভরতা বাড়ুক অথৈ বেওয়ারিশ মোড়কে।
আড়াল-আবডালের ধূপছায়া মুছে নির্ভার থাকুক সুজন,
কাঁচের দেয়াল পড়ুক খসে, নির্ভয়ে বাঁচুক দুজন।

তান্ডবলীলায় ভেঙে যাক চারধার, ভীষণ ঝড় উঠুক
কিছু প্রেম দুঃখের অনলে পুড়ুক
ছাইয়ের অবশেষে মণি-কাঞ্চন যোগ।
কিছু মানুষ কাছে নয়, আজীবন পাশে থাকুক,
সম্পত্তি নয়, বিত্ত নয়- বৈভব হোক।

সম্পর্কের চোয়াল থেকে খসে যাক মুখোশের মুখ।
রোজকার দায় থেকে বেরিয়ে, কিছু সম্পর্ক কেবল সম্বন্ধ হয়ে উঠুক।

ফেরা হয় না আর

কিছু কিছু কষ্ট লুকিয়ে থাকে বিছানায় বালিশে তোশকে
রোজকার ঝার পিঠের মতো ঝেড়ে ফেললেও
সটান দাঁড়িয়ে থাকে বুকের কবাটে, মনের শিথানে।
জানান দিয়ে যায়, আড়চোখে উঁকি দিয়ে বলে,
আমি আছি, তোমার ছায়ায় ছায়ায়!

সত্যমিথ্যের দোলাচলে কিছু বোধ
অহর্নিশ তাড়িয়ে বেড়ায়
অবোধ অন্ধকারের ধু ধু বালুচরে
আলোমুখী পতঙ্গ নিজেরই ছায়ায় ওড়ে,
জীবনের জটিল সমীকরণে;
ডানায় আলোর গন্ধ মেখে আহুতি দেয় অবশেষে।

কিছু কিছু বেদনা অমরত্বের স্বাদে অমৃত
আকরের আদিম রূপে কত গহীন যাতনা
কামারই জানে কেবল তার কথা।
কিছু কথা খুবই গোপন
আগল খুলে যায় না বলা
খুব প্রিয়তর কেউ কিংবা কোন সহজিয়া হয়না তেমন।
নিশীথের অভিসার, জ্যোৎস্নায় স্নান,
আনত প্রেম, পরাভূত আনন্দ, অনুভবের ঘ্রাণ।

কিছু যন্ত্রণা প্রসব যন্ত্রণার মত,
ভাঙনের অকল্যাণও মধুর কখনো কখনো
সৃষ্টির আনন্দযজ্ঞে মিথ্যাচারও শিষ্টাচার
কিছু কিছু ভুল ভড়ংয়ে মোড়ানো, কিছু প্রতিশ্রুতিও,
উৎসেই বিলীন জেনে জন্ম যার অনাদিকালে।

কোনোদিন আর ফিরবে না জেনে
চলে যাওয়াই সত্য জেনে
মিথ্যেটুকু স্মৃতির আঁতরে মুড়ে;
না গেলে তো ফেরা হয় না আর।

অবিক্রিত বাসনা

কেবল শর্তহীন ভালোবাসার
দামেই বেঁচে দিতে পারি সব।
নিলামে উঠাতে পারি ঘর-দোর, জমি-জিরাত
যাবতীয় অর্জন, সাফল্যের বৈভব।
বদলাতেও পারি আমূল;
ভ্রমের চক্রে দৃষ্টি যদি না হয় বেভুল!

অন্তর্দৃষ্টির লোভে এক জীবনের
সবটুকু খেদ উড়িয়ে পুড়িয়ে শেষে
ছাইয়ের ভস্মে ঘি ঢেলে দিতে পারি।
নিভে যাওয়া আগুনে সলতে দিয়ে
ফিনিক্স পাখি হয়ে জ্বলতে পারি।

আবার, সমর্পিত সব আয়োজন তুচ্ছ করে
নির্দয় অনিমেষ হেঁটে যেতে পারি একা
আসমুদ্র হিমাচল;
মুছে কান্নার রঙ, ধুয়ে তৃষ্ণার জল ।

হৃদয়হীনের কাছে হৃৎপিণ্ড জমা রাখলে
অবিক্রিত থাকার বাসনা থাকে না আর!

বসুধা তোমার জন্য

প্রতিশ্রুতির মুচলেকায় করুণা মিশিয়ে
কবির হৃদয় চাইনি দখলে
নক্ষত্রবীথিতে ছায়াপথ অরণ্য যাপন
অনবদ্য পঙক্তি যদি পায় জোৎস্নার প্লাবন
তবে সেও মুক্ত হবে অসুর্য্যস্পর্শ্যা অভিশাপ থেকে।
আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা পেলে বার বার ফেরো উৎসমূলে,
প্রেমহীন পৃথিবীতে এখন হিংসার চাষাবাদ দুর্বার
মক্তবে-পাঠশালায়, গির্জা-প্যাগোডায়, মন্দির-মসজিদে
নিষিদ্ধ প্রেম আজ মানব-মানবে,
ভালোবাসা এখন চূড়ান্ত দণ্ড পেয়ে আমৃত্যু নির্বাসনে।
মায়া-মমতা, স্নেহ- প্রেম এখন বড্ড ক্লিশে
বড় বেমানান শতাব্দীর সংবিধানে।

অর্থ, বস্তু কিংবা বায়বীয় ভার্চুয়াল প্রেমেই এখন বাজার সয়লাভ;
ক্ষমতা ও যশে নিত্য নিমিত্তের গভীর আগ্রহ আছে।
বিত্ত-বৈভবে, স্বভাবে-অভাবে, রেস্তোরায়-কাবাবে
কাঁচা কিংবা আধেক ঝলসানো রোটি;
সুরা-সাকীতেও অরুচি নেই দিনের আলো নিভে গেলে।
বস্তুত প্রেমের মতই নারী মাংসও হালাল,
রাতের সামিয়ানায় সকলই এক কাতারে এলে।
তখন বেদ-বাইবেল, ক্বোরাণ-পুরাণ একই সুরে কথা কয়।
আদতে…আলোতেই মুখোশ যত, আঁধারে সব বরাভয়।

প্রেমহীন পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল আমি
যুদ্ধ চাই না দেশে-দেশে, জাতে-বেজাতে, তত্ত্বে-তথ্যে, মানুষে-মানুষে।
চাই না দ্রোহের অনলে পুড়ুক প্রেম-সঙ্গীত আর পুড়ে খাক হোক বিশুদ্ধ নীলাকাশ।
দুহাতে বিলাতে চাই বুকভরা প্রেমান্ন নিরন্ন মানুষের জন্যে,
শ্বাস নিতে চাই বিশুদ্ধ অনুভবের মলয় বাতাসে।

বিশ্বাস করো,
আজতক একটি পিঁপড়েও পিষে মারিনি
একটি শিশু মৃত্যুরও কারণ হইনি আমি
রাস্তায়-ফুটপাতে যতো নুলো ভিখিরি আছে,
ওদের এই বিকলাঙ্গের কারণ আমি নই
কিংবা এই শহরের যত বড় বড় অগ্নিকাণ্ড, পুকুরচুরি হয় দিনে রাতে
সরকারী ইঁদারায়, ডোবা-নালায়, খানাখন্দে
যত মৎস শিকার হয়, রাতের আঁধারে,
দিনের আলোয়, নদী-খাল-হ্রদ ভরাট হয়,
জলের আগুনে জ্বলে যত জলাভূমির অন্তর।
কিংবা দুগ্ধবতী মহিষের বাথানে পোড়ে কত খামারীর বাড়ি-ঘর;
তার কোনো হিস্যেয় নাম নেই আমার।

কে কত বাটোয়ারা পায়,
কীভাবে কার ব্যালট কোন বাক্সে যায়
সেই মতলবও কোনোদিন আঁটিনি আমি
খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো, এই জীবনে একটি মাছিও মারিনি।
নিতান্তই ছা-পোষা, হাড়-মাংস-অস্থি সর্বস্ব সাড়ে তিন হাত দৈর্ঘের
এক অতি সাধারণ মানবী।
রূপে-গুণে-বিদ্যে-বুদ্ধিতে পাঁচের মধ্যে প্রথমাও নই আমি।
তবুও সেই আমি,
সেই আমিই তোমাকে ভালোবাসবার দুঃসাহস করি।
কারণ, ওই বিদ্যেতে অনেককেই পারি আমি অনায়াসে ডিঙাতে।

নিন্দার কাঁটা, সমাজবিধির রক্তচক্ষু, বন্দুকের ট্রিগার
জেল-হাজতবাস, কিংবা ধরো যদি নরকবাসও হয় পরকালে আমার
তবুও বলছি, ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।
প্রেমহীন আঘাতে তুমি আজ আক্রান্ত অজানা অসুখে,

এমন নিঃশর্ত প্রেমাসক্ত শুশ্রূষা চাই তোমার,
নিবিড় নিবিষ্ট পরিচর্যায় মুহূর্তেই সেরে ওঠার,
প্রিয়তমা পৃথিবী আমার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *