কবিতাবিশেষ সংখ্যা

কবিতা।। আসাদ মান্নান।। ফেব্রুয়ারি কবিতা উৎসব সংখ্যা

আমি যখন এ কবিতাটি লিখছি



কুয়াশাকে কাঁধে নিয়ে সামনে যায় মানুষ এগিয়ে;

উড়ন্ত ঘোড়ায় চড়ে পাড়ি দেয় জলের পাহাড়

নক্ষত্রের জামা গায়ে জয় করে নীলিমার নদী–

শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ফুরিয়ে যাবার আগে

সন্তানের মুখে দেখে অমরত্ব—উত্তরাধিকার;

আশা ও স্বপ্নের নামে চায় মৃত্যুকে হটিয়ে দিতে;

তবু থাকে মৃত্যু ভয়– হাতে ধরে অলৌকিক লাঠি:

সাজানো গোছানো ঘর সংসার তছনছ করতে করতে

জনারণ্য ভেদ করে অদৃশ্য তীরের ফলা; হায়!

ধনী বা নির্ধন ছোট বড় নির্বিশেষে যাকে পাচ্ছে

তাকে ধরছে– বিদ্ধ করছে — নিখুঁত নিশানা :

ঠুস ঠাস শব্দ করে ফেটে যাচ্ছে প্রাণের বেলুন

স্বনির্মিত অন্ধকারে বন্দি পাখি হারিয়েছে ডানা।

৬.

যখন এ কবিতাটি আমি লিখছি তখন পৃথিবী

একটা স্তব্ধতা চোখে অসহায় ভিক্ষুকের মতো

হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে; তার চারপাশে

মশা-মাছি দুই সহোদর আনন্দে গাইছে গান

পুরনো মেথরপট্টি জেগে রয় নতুন উদ্যমে

রাতভর পথভোলা মাতালের অশ্লীল নেশায়

ছায়াকে জড়িয়ে গায়ে অন্ধকারে হাঁটে পথচারী

যৌবন বিপন্ন হয় রক্তহীন বরফের নিচে।

শরীরের দায় দেনা বেচা কেনা তবু থেমে নেই;

মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে– নিশিকুঞ্জে নেশার আড়ৎ :

কিছু কিছু নেশা আছে কেটে গেলে নেশাই থাকে না;

কিছু নেশা আছে এমন উদগ্র আর দুর্বিনীত

কেটে গেলে ইচ্ছে হয় আবার নতুন স্বরে গাই

মহুয়া ফুলের গন্ধে জীবনের অজানা সঙ্গীত।

৭.

যখন এ কবিতাটি আমি লিখছি তখন বাইরে

কী অদ্ভূত প্রক্রিয়ায় চলছে এক অচেনা কার্ফিও,

যে কার্ফিও পৃথিবীর বাসিন্দারা কখনো দেখেনি–

এ উদ্ভট উল্টোরথে যে-মানুষ কখনো চড়েনি

সেও আজ চলতে থাকে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে

এ রথ পেছন দিকে এইভাবে যেতে থাকে যদি

হয়তো-বা চাকা খুলে ঢুকে যাবে রাক্ষসপুরীতে;

আহা,মানুষের এই পেছনযাত্রা কে পারে থামাতে !

কোন পথ ধরে হাঁটে মানুষের বাঁচার ঠিকানা?

যে গ্রহে মানুষ নেই জীব-জন্তু কখনো ছিল না

সে গ্রহের নাম মুখে জ্বলবে নাকি সন্ধ্যার জোনাকি;

ক্ষেতের ফসল ফেলে মাঠ ছেড়ে তাকে যেতে হয়

কুয়াশা তাড়ানো ভোর আসবে কবে দিগন্তের পেটে–

নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে তাজা শিউলি ফুটবে কবে!

৮.

আমি এই কবিতাটি যখন লিখছি তখন দেখছি

শহর-বন্দর গাঁয়ে পথে ঘাটে বাজারে মাজারে

এমনকি গণিকার নিখদ্দর বেকার কুটিরে

গার্মেন্টস পল্লী হতে শুরু হয়ে শপিং সিঁড়িতে

অফিস পাড়ায় আর কেরানীর গোপন পকেটে

হোটেল মোটেল পার্ক শরণার্থী রোহিঙ্গা শিবিরে

সারি সারি মিলিটারি টহলে নেমেছে; দেখি

সৈনিকের হাতে কোনও মারণাস্ত্র নয়, ধরা আছে

বন্দুকের পরিবর্তে নিরাপদ স্যানিটাইজার,

মাস্ক মুখে হাঁটে খণ্ডখণ্ড ব্যক্তিগত নিরাপত্তা—

সামাজিক দূরত্ব বিধানে মানুষের আয়ু তাতে

যদি-বা নিশ্চিত করা যায়!একজন সৈনিকের

মাথার খোড়লে সারাক্ষণ পড়ে থাকে গুলিবিদ্ধ

স্বপ্ন নয়, লক্ষ কোটি মানুষের বিপন্ন হৃদয়।

৯.

মানুষ মারার জন্য মানুষেরা বহু আগে থেকে

দেশে দেশে গড়ে তুলছে সশস্ত্র বাহিনী, দক্ষ যোদ্ধা!

এসব যোদ্ধার হাতে দেশ ও মানুষ রক্ষা পায়

বিদেশী শত্রুর গুপ্ত কিংবা প্রকাশ্য হামলা থেকে;

সর্বদা প্রস্তুত থাকে সৈনিকেরা– যে-কোনো দুর্য়োগ

মোকাবিলা করে থাকে অসীম সাহসে, এমনকি

জীবন উৎসর্গে তারা কিছুতেই পেছনে হটে না–

‘মার কিংবা মরো’ –এই মন্ত্রে সব দেশে সৈনিকেরা

দীক্ষা নেয়—প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে, অন্য কোনো রাস্তা

খোলা নেই একজন পেশাদার সৈনিকের চোখে।

অথচ এমন এক মহাযুদ্ধে নিরস্ত্র সৈনিক

অদৃশ্য শত্রুর আগ্রাসন কী ভাবে থামানো যায়

তা-ই ভেবে শঙ্কাহীন দিন রাত টহলে রয়েছে–

মানুষ বাঁচাতে তার এ কেমন অকুণ্ঠ সাহস!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *