গুচ্ছ কবিতা আফিফ জাহাঙ্গীর আলি
লালচোখে
বান ডাকে ভরা যৌবনা কংশ নদী
আকাশ আর জলে নিবিড় মিতালি।
দেখা মেলে স্ফীত প্রবাহে রূপা বর্ণের মাছ লাফিয়ে জলের ওপর
জলতরঙ্গ উৎসবে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি গন্তব্যহীন অজানা গন্তব্যে।
পাখির খাদ্যান্বেষণে জলের ওপর ওড়াউড়ি করে
কমান্ডো হেলিকপ্টারের মতো টহল দেয়—
যেখানে জল নড়ে শালিক—ফিঙে ঝাঁপিয়ে সেখানেই আহার সন্ধান করে।
ক্ষুধার্ত মাছরাঙ্গা ডালে বসে শিকারের অপেক্ষায়
লম্বা চোখা চঞ্চু তাক করে আটকে দেয় বিকাল,
বিকেলের সোনামাখা রোদের ছানিতে উদ্দাম বিস্তীর্ণ জলরাশি জমকালো
সোনাখচিত ঝলমলে পর্দা বিস্তৃত জলে ব্যাপ্তি
কবুতর ছানার মত কাাঁপা তির তির করে নৈসর্গিক অপরূপ ঢেউ ছলছল।
মহাশোল মাছের লালচোখে থেমে যায় স্রোত।
কী অপরূপ– জলে ভাসা সোনালি বিকেলের মাতাল রূপ।
ক্রমশ বিকেলের সোনা রোদ পোড়ে জলের কফিন রঙ ধারণ
অত: পর বর্ণীয় সন্ধের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য অবলোকনে মোহিত হয়ে ঘরে ফেরা।
মৃত্যুর সন্তান নেই
জীবন ঝরে পড়া ফুল
মৃত্যু তাঁর চিরঞ্জীবী ফল
জন্ম-মৃত্যুর দূরত্ব সন্ধিক্ষণ—এটাই জীবন
মৃত্যুর স্বাদ কর্মফলে শাশ্বত
মৃত্যুর কোন সন্তান নেই
তাই তো অনুসার করে হৃদয়বিদারী শূন্যতার বিস্তার
ফুটফুটে জন্মের আলোয় সূর্য উঠে—
শোকের আঁধার মৃত্যুতে সূর্য ডোবে
জীবন নিয়ে কত সংকল্প—সন্তর্পণ
কিন্তু মৃত্যু ভাবনা নেই মননে
অথচ মৃত্যুর কোলেই শেষ যাত্রা—
আলো ছেড়ে অন্ধকারের অতলে?
বেঁচে থাকার ভালোবাসায় অবধারিত মৃত্যুর কথা ভুলে গেছি।
ভাসিয়ে সুখের নাও
দেয়াল ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দে ঘুরছে না
শয্যায় ঘুমের ঘুরে ঘড়িটা বড় কাজের; তা অকেজো
তাই পাখিদের বলে দিয়েছি- ভোর ভোর জাগাতে
অত: পর অদমিত মনোদিগন্তে প্রত্যুষের হাওয়া খেলিয়ে
ছুটে চলা গারো পাহাড়ে সাতসকালে।
অতীতের চারমুঠো ক্লেশ ছুড়ে দিয়েছি পাহাড়ে—
বুকচিড়ে বহমান নদীর ছলাৎছলে ভাসিয়ে সুখের নাও
নিষ্কলঙ্ক পবনে শীতল হয়ে অরণ্য থেকে মায়াবী অনুরাগে নির্জনতার স্নানে ঘরে ফেরা-কটা দিনই আর পেরিয়েছে
প্রণয়ীনীর স্থানাপন্ন ফায়দা লুটার অহমিকায় আড়াল হয়েছে সব। ভুলে যেও; আমি আর অতীতের দিকে ফিরবো না?
নষ্টজলের বিষাক্ত বুদ্বুদ
শানবাঁধানো পুকুরের স্বচ্ছ জল রেখে
তুফানে পাড় ভাঙা অববাহিকায়
ভাঙা পাড়ের নষ্টজলে পা দিয়ে
নৈতিক ক্ষয়ে পুষ্পদ্বার পিছল
ভিজা পা থেকে সংক্রমিত করোটির ভেতর
নষ্টজলের বিষাক্ত বুদ্বুদ ক্রিয়া আকাশকুসুম
অনুতাপে ধ্বসে পড়ছে
শানবাঁধানো পাকা ঘাট স্বচ্ছ জলে
অনাবিল সুখে—
সাগর-নদী একাকার হত যেখানে অহোরাত্রি।
তোমার শূন্যতাজুড়ে
মৌন অভিমানে দূরে চলে গেলে—সুদূরের পথে একা ফেলে
বিশ্বাস হয়নি—বারেবারে মিছে বললে ভালোবাসি!
অবিশ্বাসের দোলাচলে কখন যে, বিশ্বাস জন্মেছিল জানিনে,
নক্ষত্রবিহীন আকাশ থাকে রাতের প্রলেপে ঢাকা
তুমিহীন আমার আমি শুধু একা—নীরবতার সংসার
তবুও তোমার অভিমানে—অভিমানী হয়ে পিছু ডাকিনি
তাই তো আমাকে পোড়ায় —তোমার শূন্যতাজুড়ে স্মৃতি
একদা তোমার—আমার হাত থার্মোমিটারে বানিয়ে
প্রথম স্পর্শে ভালোবাসা মাপ হয়েছিল যেদিন
সেদিন শিহরিত দাবানলে মিলিয়ন ফারেনহাইট তাপে
মোমের মত গলে আমার হাতে লেপ্টে আছে তোমার হাত
মন পুড়েছে শূন্যতার হাহাকারে -পুড়েনি স্পর্শের অর্ক হাত!
নিত্যদিন সূর্যডোবার প্রাক্কালে
তোমার মৌন অভিমানের দেখা মেলে— সন্ধে ফোটা ঝিঙে ফুলে
আর আমার সুপ্ত অভিমান,
দিনের শেষে নেতিয়ে পড়া বিবর্ণ বিষণ্ণ ঘাসফুল।
চোখেই শুধু কান্না থাকে না
এলোমেলো ঝঁঝাটে—
নির্ভার মনোভূমি পতিত —তৃষ্ণার্ত বিরান প্রান্তর
মধ্যাহ্নে জীবন সমতাহীন; ভাবনার সৃজন মৃত
কী পেলাম—কী হারালাম?
সময়ের পৃষ্ঠায় করা হয়নি তা লিপিবদ্ধ
নিয়তির কলম পকেটে কালিশূন্য
ব্যথা দিয়ে যতই ক্ষতবিক্ষত করো মন-প্রাণ
তারপরও কোন অভিযোগ নেই
নির্লিপ্ত চোখ—কর্ণকুহর বিদীর্ণ যাতনায় হয়েছে ভরাট
তবে জেনো—
চোখেই শুধু কান্না থাকে না?
যারা বধির তাদের ঘৃণা শক্তিও প্রবল
বুঝে নিও।
শরৎ ক্যানভাসে
শরত এলে স্ফীত জল করে টলমল
নদীর পাড়ে জাগে শান্ত জলের ঢেউরেখা নিদর্শন মৃত্তিকায়
কাশবনে ধবল সম্ভারে পেলব ঢেউ জাগে মৃদু হাওয়ায়
শরত ধবধবে সফেদ ভারহীন তুলার ত্রিপল
শিমুল কলার মত ফেটে ছোপ ছোপ ছড়িয়ে পড়ে
অহোরাত্রি মেঘের ভেলা নীলাকাশজুড়ে
রৌদ্রছায়া—মেঘবৃষ্টির জড়াজড়ি
সুবজ ঘাসে নতুন শিশির রুপো খচিত মখমলের ব্যাপ্তি
ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টে-শুভ্র নির্মল পাহাড় দণ্ডায়মান—
সাঁঝের বহর তা অতিক্রম করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়
যৌবনের পাখায় ওড়া একজোড়া উদাসী ফড়িং তখন দিশা হারায়
পরে সন্ধান মেলে আকাশে গেঁথে থাকা শরত আইসক্রিমে
কাশফুলের সমারোহে ঢেউ উঠা অভ্যর্থনা জানায়
কাশবনের নিরুপম শরত সভায়
শরত এলে হলুদ গোলাপ সাদা হয়ে যায়!