মুনীর আহমেদ সাহাবুদ্দীন-এর কবিতা
কবিতা
প্রেম-নদী-স্বর্গ
কুঁড়েখানি ঘিরে বয়ে যায় নিতুই বিরাট চাঁদের হাট,
মানুষ আর মন লুকোচুরি খেলে ওই ধান জমি মাঠ।
ঘরখানি মোরা থাকি দুজনি, জোনাকিরা দেয় আলো।
সন্ধ্যা নামিছে দেখিয়া নদী প্রদীপ জ্বালিয়া গেল।
লালপেড়ে শাড়ির আঁচলে দেখি, নদী মোর লুকিয়েছে হাত,
দিনভর তার শ্রম ঘেঁটে চলে, বিশ্রাম দিয়ে রাত।
নদীরে ডাকিয়া আদরে হাসিয়া, কহিলাম “দেখো তুমি!
শরতের মেঘে ঢেকে আছে চাঁদ, প্রকৃতি দিয়েছে চুমি।
দেখনা কেমন জোয়ারের নদী, তোমার নামের সনে,
এদিক ওদিক বয়ে যায় শুধু, কত খুশি তার মনে।”
মোর নদী আসে বসিয়া পাশে, মুছিয়া দিয়া ঘাম,
গোলাপী অধরে কপালে আঁকে, হাজারো প্রেমের নাম।
ভোরবেলাতেই প্রভাত জাগিয়া নদীরে ধরে জড়ি,
আঁকাবাকা পথ বহিয়া আমি জীবনে নামিয়া পড়ি।
উঁচুনিচু বাঁক বাহিয়া চলি, কঠিন লাঙ্গল ধরি,
ঝকঝকে রোদে ঘাম জবজবে, সোনালী দিবস গড়ি।
দুপুর বেলাতে রোদ আর মেঘ জড়াজড়ি দুজনি,
মোর নদী আঁচলে খাবার ঢাকিয়া কহিল “এই খাও দিকিনি”।
রঙ্গীন গামছায় ঘাম মুছিয়া নদীর পানে চাই,
লজ্জাবদন ঘাম চিকচিকে আরো কাছে পেতে চাই।
দুপুর বেলায় স্বর্গতেজে বয়ে যায় অবসর,
কঠোর হাতে লাঙ্গল ধরি, সন্ধ্যা বেলায় ঘর।
এটা সেটা দেখি, খড় দেই গরু, ভাঙ্গা ঘরে বেড়া,
তটিনী পাশে গৃহখানি মোর পৃথিবী স্বর্গ সেরা।
রাতের আকাশ নামিছে দেখিয়া তারারা দেয় আলো,
দুই হাতে নদী জড়ায়ে ধরিয়া কত রাত কত গেল।
যখন নদীরে কাছে টানিয়া চাঁদ দেখিতাম মুখে,
মিটিমিটি তারা আর রুপালি আকাশ জড়িয়ে যাইত সুখে।
কাঁকনের সুর তুলিয়া কহিল “চুপ! বাছারা রয়েছে ঘুমি!”
আলতো পাশে বসিয়া বাছাদের এঁকে দিত কত চুমি।
চুপচাপ বসে নদী আমার কইত কত কথা,
স্বর্গ ভেলায় ভাসিতে ভাসিতে ঘুম জড়াতো কোথা।
মোর ঘামে আর নদীর প্রবাহে বয়ে যায় সব বেলা,
ভালবাসা দিয়ে স্বর্গ গড়ে কুঁড়েতে করি খেলা।
জানি নবান্নে, হব ধন্যে, সোনার ধান্যে ভরে,
কত সুখ নদীর মুখেতে ভাসে, কখন কোথা হতে কি করে।
যুগে যুগে আসে নদীর স্বর্গ, এভাবেই জাগে প্রাণ,
কুঁড়েঘর মোর জাগিয়া ওঠে প্রেম স্বর্গের বান।
মা আমার মা
ছোট্ট আমি কোলে তোমার
জাপটে শুতে চাই।
বলনা আবার দুলিয়ে আমায়
“কাজলী কোলে আয়”।
“আয়রে বাবা কোলে আমার
গান শুনবি আয়।
চাঁদ মামা, ঘুমপাড়ানি,
আয়রে টিয়া আয়।”
পুকুরপাড়ে নীলপদ্ম
আসবে আবার ভেসে।
আমার কথায় ঝলমলে চাঁদ
ফের উঠবে হেসে।
তেঁতুল গাছের চিরল পাতা
হিসহিসিয়ে বাজে,
সন্ধ্যেবেলায় ‘মাগো’ বলে
ছুটবো তোমার কাছে।
কোল ছেড়ে মাগো আমায়
পায়ে দিও ঠাঁই।
তোমার চরণতলে যেন আমি
স্বর্গ খুঁজে পাই।
মহুয়া
মন খারাপ করে বসে থাকতে থাকতে,
সন্ধ্যাবেলায় মিছেমিছি হাসলাম।
ভাবলাম বারান্দায় যাই।
গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে ডাক দিই মহুয়াকে।
কিন্তু মহুয়াতো ‘তুমি’ না!
‘এ’ ব্লক থেকে গার্লস স্কুল হেঁটে যেতে দীর্ঘ পথ,
আড়ালে-আবডালে, সিঁড়ির কোণে,
এমনকি এলিভেটরে।
ছায়া-কায়া নয়!
অমূলপ্রত্যক্ষে টের পাই,
তোমার সাথে আমার পায়চারি,
আমাদের আলিঙ্গন,
তোমার ঠোঁটের প্রথম পরশ।
সারাদিন লোডশেডিং এ থাকতে থাকতে,
মিছেমিছি গান শুনি রাতেরবেলায়।
চেনা সুর মিশে যায় অচেনা বিরহে।
ভাবলাম মহুয়াকে আবার ডাকি।
না হোক মহুয়া ‘তুমি’।
তাকে একটা গল্প বলি।
তোমার পাশে দুরন্ত বাইক হাঁকানো যুবকটা,
নীল জামা পড়া, বুকের বোতাম খোলা,
অবলীলায় তার রোমশ বুকে রাখো হাত।
ইডেন কলেজে থেকে
বুয়েট, মেডিকেল,
কোচিং সেন্টার, মধুর ক্যান্টিন,
নিউ মার্কেট, রমনা উদ্যান,
হেলমেট হ্যান্ডেলে রেখে তোমাকে নিয়ে
দাপটে ঘুরে বেড়ায় যে যুবক,
আমাকে চেনে না সে।
যেমন মহুয়া চেনেনা তোমাকে!
শোনো,
তোমার কাছে এই আমার শেষ চিঠি।
আমি ভালো নেই।
তুমি ভালো আছো তো নীলা?
অধরা
ফেরার পথে থামবো ক্ষণিক
দেখবো তাহার বাড়ি।
চাঁদজোসনা, মহুয়া বন,
বৃক্ষ সারি সারি।
থামবো বারেক, কইবো কথা,
মন নিয়েছে কাড়ি,
ওই পারে যে আছে তাহার
স্বপন বসতবাড়ি।
পথ যেখানে শেষ হয়েছে
শাল মহুয়ার বনে
পানকৌড়ি, শীতল দিঘী
পড়ে কী তাহার মনে?
ফিরতি পথে কমতি সময়
হিসেব কষে দেখি
সোনার বালা, রুপোর নূপুর
পাওনা তাহার বাকি।
এক পশলা বৃষ্টি মাখি
সোনার বিকাল বেলা,
শান্ত নদী, ছোট্ট নাও
ওইপারেতে মেলা।
ছোট্ট চিঠি হাতে আমার
তাহার বুকের ব্যাথা
বৃষ্টিফোঁটা জলের কণা
কইবে তাহার কথা।
ওইপারেতে গিয়ে আবার
শুনবো তাহার কথা।
চলে যাব জানতে পেলে
আর নিও না সামলে,
আকাশ হয়ে বুকে তোমার
চেপে রেখো আগলে।
উদাম হাওয়ায়,
বৃষ্টি ফোঁটায়,
ফিসফিসিয়ে শুনবো আবার
‘ফিরে এস’ বললে।