গুচ্ছ কবিতা সালমা আক্তার টিউলিপ
তুমি তাঁদেরই একজন প্রত্যেক
প্রত্যেক কবিই বেড়ে ওঠেন তার নিজস্ব আলো -বাতাসে
তারই প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে তাঁর
কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে।
শক্তিশালী অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত প্রস্রবণ ঘটায়
দেশপ্রেম, সাম্যবাদ, বিপ্লব বা আধ্যাত্মবাদে,
কখনো বা কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বিস্ফোরণে। রূপক, উপমা, স্বাধীনতার অমোঘ উচ্চারণ
বাংলা ভাষায় খুব কম কবির কন্ঠেই শোনা গেছে
কবি আল মাহমুদ তুমি তাঁদেরই একজন।
আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে খাঁটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ
নদী নির্ভর জনপদে চরাঞ্চলের জীবন প্রবাহ,
প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ সবকিছু
অভিনব সৌন্দর্যে অবলোকন করে;
নিজের কবিসত্তা দিয়ে যিনি সবার মাঝে
ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস করেছেন;
কবি আল মাহমুদ তুমি তাঁদেরই একজন।
আধুনিক বাংলা ভাষায় প্রচলিত কাঠামোর মাঝে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ যেন আলাদা শৈল্পিক সৌন্দর্য দান করেছে বাংলা কবিতায়। কবিতার সেই স্বর্গীয় আলোকচ্ছটার কথা
যে আলোয় আলোকিত না হলে কোনো কবিই সত্যিকার অর্থে খাঁটি কবি হয়ে ওঠেন না,
বাংলা ভাষার সেই সব দুর্লভ কবিদের মাঝে
কবি আল মাহমুদ তুমি তাঁদেরই একজন।
কবিদের চেতনার জগত ও কল্পনাশক্তি অসীম
সেই জগতে নিজের চিন্তা দিয়ে শব্দ নির্মাণ করেন,
তাঁর কল্পনাশক্তিকে প্রকাশ করেন
আপন ছন্দের মহিমায়।
নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে অবলম্বন করে
নারী ও প্রেমকে কবিতায় অবলীলায় ধারণে,
উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা
ও ভোগের লালসাকে
যিনি শিল্পের অংশ হিসেবে দেখাতে পেরেছেন,
কবি আল মাহমুদ তুমি তাঁদেরই একজন।
স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত ও
অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের রাস্তায় সতত পরিভ্রমণশীল যার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে তাঁর অমর কিছু কাব্য, যাকে আপাময় বাঙালির মাঝে
যুগ-যুগান্তরেও বাঁচিয়ে রাখবে
কবি আল মাহমুদ তুমি তাঁদেরই একজন।
কবিদের সৃষ্টির পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়
সত্য হয়ে ওঠে তাঁর চেতনার রং -রূপ-রেখার শব্দাবলী। জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই
সত্যকে বাস্তবে রূপ দেন;
তবেই কবির উত্তরণ ঘটে কবিতার সার্বভৌমত্বে।একদিন কবিরাও মহাকালের অনন্তস্রোতে বিলীন হন
তাঁদের বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণা
আমাদেরকে করে কাতর, মর্মাহত।
কিন্তু তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মই তাঁকে
অমর করে রাখে পৃথিবীর বুকে;
কবি আল মাহমুদ তুমিও যে
সেইসব দুর্লভ কবিদেরই একজন।
পূত-পূর্ণ শরৎ
ঋতুচক্রের আবর্তনে বর্ষার পরেই শরৎ আসে
শুভ্র জ্যোৎস্না আর পুষ্পসুষমা নিয়ে
খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলায় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে।
বর্ষার মেঘ শরতের আকাশে সাদা পাল তুলে
ছুটে বেড়ায় ইতস্তত, শিশিরধৌত শারদ-প্রভাতে।
নদীর দুই তীরে সাদা কাশফুল বাতাসে দোল খায়
পদ্ম,কাশ আর শেফালি ফুলের অনাবিল সৌন্দর্যে
সকলের মন বিমোহিত হয়।
মেঘমুক্ত আকাশের নীলিমায় ভেসে ওঠে
রূপার থালার মত পূর্ণ শশী,
ঘাসের ডগায় চমৎকার দেখায় প্রভাতের শিশির।
সদ্যঃস্নাতা শরতের তরুণী মূর্তি ধারণ করে
অপরূপ মহিমায় নিজেকে বিকশিত করে।
ঘরে-বাইরে আলোছায়ার লুকোচুরি খেলায়
শরতের সূর্যাস্ত প্রকৃতিতে এক মোহনীয় দৃশ্য ফুটায়,
আমাদের প্রাণ মনও আনন্দে ভরিয়ে তোলে
মেঘমুক্ত নীল আকাশ আর ঠান্ডা হওয়ায়।
গাছে গাছে পত্র-পল্লবে সবুজের ছড়াছড়ি
পূত-পুণ্য শরতেই দেবী দুর্গা
মর্তলোকে বেড়াতে আসেন কৈলাশ ছাড়ি।
বর্ষা
ওগো লাবণ্যময়ী বঙ্গভূমি
প্রকৃতির সুরম্য লীলানিকেতন,
লীলাময়ী প্রকৃতিতে সৌন্দর্য ও মাধুর্য
তুমিই করেছ বিতরণ।
তোমার সৌন্দর্যে শাশ্বতকাল ধরে
মুগ্ধ কবিচিত্ত,সংগীতের উৎসধারাতে;
অনির্বচনীয় ভাবের হিল্লোলে আজ
ভাবুকের হৃদয়ও চায় যে হারাতে।
গ্রীষ্মের রুক্ষতা মুছে দিতে
মহাশূন্যের কোন এক গুহা থেকে,
দুরন্ত বেগে বাঁধনছেঁড়া বায়ু
দিগ্বিদিক হয়ে আসে যেন ছুটে।
গ্রীষ্মের খররৌদ্রে শান্ত প্রকৃতিতে
বর্ষা ফেটে পড়ে অশান্ত দুর্দম আবেগে।
মুছে দিয়ে গ্রীষ্মের সব রুক্ষতা
প্রবল ধারায় চলে বর্ষণ,
গ্রীষ্মের তপস্যার অবসানে
তবেই প্রকৃতিতে ঘটে বর্ষার আগমন।
বর্ষার ধারা, বর্ষণ জগতের যত কথা
আজ সব ডুবিয়ে মূক-
প্রকৃতির কন্ঠে,
এনে দেয় যেন মুখরতা;
মৃতপ্রায় পৃথিবীর বুকে অকস্মাৎ
বিরাজ করে প্রাণচঞ্চলতা।
মাটির তলদেশ থেকে
উঁকি মারে তৃণাঙ্কুর
এত দিন ছিল যা
রুক্ষ, শুষ্ক, শীর্ণ আর ভঙ্গুর।
তরুলতার অঙ্গেও আজ জাগে যেন
তারুণ্যের সবুজ শিহরণ।
এমনি করে অবিরল ধারা বর্ষণে
বিকশিত হয় বনরাজি,
সজল গন্ধে বিদায় নেয়
বর্ষা প্রকৃতি।
ইচ্ছেরা গেছে নির্বাসনে
কোন একদিন কাউকে কথা দিয়েছিলাম
নানা ইচ্ছে দিয়ে স্বপ্নেরও ফুলঝুরি সাজিয়েছিলাম,
সেই থেকে ইচ্ছে,কথা আর স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি
অন্তর মাঝে যক্ষের ধনের মত আজও আগলে রেখেছি। আমার কল্পনাতে বরাবরই ব্যক্তিগত কিছু ইচ্ছে ছিল, ইচ্ছে ছিল ঝুম বৃষ্টিতে খালি পায়ে
আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দুজনে পিচঢালা রাস্তায় হাঁটবো। সময়ের কড়াক্রান্তির হিসেব না করে বহুদূরে
অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবো আর
কোনো টংয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি চা খাব।
এরপর বহু বর্ষা এল – গেল
বৃষ্টির অবিরাম ধারাও বয়ে চলেছিল কিন্তু
তুমি হীনতায় বৃষ্টিকে আলিঙ্গন তো দূরের কথা
ছুঁয়েও দেখা হয়নি আর,ইচ্ছেও করেনি কখনো।
ইচ্ছে ছিল এক চিলেকোঠায় দুজনে
টোনাটুনির মতো সংসারে আবদ্ধ হবো,
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে দুজনে
গোধূলি আলোয় বিমোহিত হব।
মধ্যরাতে কাঁধে মাথা রেখে
জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মাখবো।
গল্প করতে করতে সারা রাত কাটিয়ে দিব আর
ভোরে মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা আস্বাদন করবো।
ইচ্ছে ছিল জীবন নামক ডায়েরিতে শুধু
তোমার নামটিই লিখে রাখবো,
এসব ইচ্ছে আমার কল্পনার মাঝে আজও সীমাবদ্ধ। জানি আর ব্যস্ত পথে খুব খেয়ালে
কোন দিন ধরবে না আমার হাত,
দুজনের মাঝে আজ যে মস্ত বড় দেয়াল!
জানো,যত ইচ্ছে ছিল তারা আজ
স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গেছে,
কোনো কোনো ইচ্ছে হয়তোবা আত্মাহুতিও দিয়েছে! তবে আগের মতো তোমায় ভেবে ভেবে
বেশ কেটে যায় সময় আমার,
আজ ভাবনার মাঝে পার্থক্য শুধু
বিষন্নতার বসবাস,লুকিয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস!
অভিনয়ে ভরা হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায়
বিভোর করে রাখতে আমায়,
তাইতো আজ সময়ের প্রয়োজনে তুমি গিয়েছো এগিয়ে
আর আমি?
হিসেবের গোলমালে এখনো রয়েছি পিছিয়ে।
সবাই পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়
পৃথিবীর রূপ, রং দেখে দেখে আজ
আমি বড় ক্লান্ত।
প্রতিদিনই যেন একটু একটু করে আমি ফুরিয়ে যাই,
কে পারে,কে পারে নিজেকে এভাবে
তিলে তিলে নিঃশেষ হতে দেখতে?
ব্যস্ততা শেষ হলেই আমার বুকের মাঝে
চিনচিনে ব্যথা হয়, জীবনটা হয়ে ওঠে বর্ণহীন!
রাতের আকাশে তারারা আছে,
বিষন্ন,নিস্তব্ধ রাতে হাহাকার বাড়ে।
তাকে ছাড়া আজও সবকিছুই যেন
রং চটা ঐ দেয়ালের মতো!
সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না
কিছু কিছু ভালোবাসা বালিশেই শুকিয়ে যাওয়া,
চোখের পানিতে হারানো
এক তীব্র একাকীত্বতা নিয়ে
কষ্টের গল্পও হয়ে রয়ে যায়।
খুঁজি চির চেনারে
এ ধূলি মলিন ধরায়
জীবনের যত কথা, যত ভাষা
আজ যেন ফুলদল হয়ে রয়,
হৃদয় মোর ব্যথিত হয় সে ভাবনায়।
মোর বেদনার হীমাচল
বহমান বেদনার ভাঙা এ খেলাঘর,
চারিদিকে বিরাজমান মোর জীবনের
শুধু নিরাশা পাথার আঁধার।
আমি পথ চলি একাকী এ ধরায়
আমার চেতনায়, আমার বিশ্ব থাকে
অনাবিল সুখ উচ্ছলতায়;
অম্লান থাকে যেন সদা জ্যোতির্ময়।
তবুও প্লাবিত হয় হিয়া
প্রজ্জ্বলিত মোর প্রণয় পাতায়,
স্বর্গীয় ঐশ্বর্যের দীপ্ত দীপিকায়
অনিবার্ণ প্রেম মহিমায় হয়ে বিস্ময়।
অনাদিকাল হতে বিরহে তোমার
ঝরেছে যে আঁখিজল,
নিখিল ধরায় গড়েছে তাই
অকুল সিন্ধু বারিধার।
হৃদয় প্রদীপ জ্বেলে যুগ যুগান্তরে
বেদনার বালুচরে,
সৌরলোকের অসীম পথে
খুঁজি মোর চির চেনারে।
লোক-লোকান্তরে
তোমায় খুঁজি আকুল বিরহে,
তিমির অন্ধকারে
অকুল পাথারে রিক্ত হৃদয়পুরে।