গুচ্ছ কবিতা – অর্ণব আশিক
সত্য জেগে থাকে
সত্য জানা বড়ো কঠিন
পর্বতের মতো ঘাড়ে তুলে নিতে হয় বহু ভার
বহু কষ্ট নিতে হয় প্রাণে;
পর্বত বেয়ে নেমে আসে জল, কঠিন দুর্গতি বেয়ে সত্য
জল রূপ নেয় ঝর্ণার, মিথ্যা পরিশুদ্ধ হয় সত্যতে
ঘনান্ধকারেও সত্য জ্বলে ওঠে
সূর্যের মতো আলো দিতে।
বয়সের ভারবাহী মানুষ,
কুড়ায় জীবনের ধুলো, দেখে স্বার্থের সাম্রাজ্য
বেড়ে উঠে ঈর্ষার ভ্রুকুটিতে
দেখে ভালোবাসা থেকে ছিন্ন হয় রক্তের বীজ, আপনজন;
ফুলের পাপড়িতে জমে বিষ, ঘৃণা
পড়ে থাকে শূন্য ময়দান, পোড়া ছাই
তবু সত্য জেগে উঠে জীবনের মোহনায়।
সত্য জানা বড়োই কঠিন
স্বার্থ সচকিত চতুর্দিকে, অকৃতজ্ঞতা সর্বদা চুরমার করে,
ওলোটপালট করে সব
ভুতুড়ে জমিন স্পর্শ করে প্রতিদিন
ছুরি বিঁধে সরল জমিনে।
তবু সত্য জেগে থাকে
পার্বত্য নির্ঝর।
সন্ধ্যা জলের অথৈ গভীরে
ফাগুন বাতাস নিয়ে গেলো সব
প্লাবিত জোছনার গভীরে
ঢুকে গেলো মায়াবী খুনি চাঁদ
নদীটিও শূন্য কলসির মত ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে
স্বভাব জানান দিলো, কোমল স্রোতের।
সবুজে ঢাকা গ্রামগুলো ঝিমিয়ে পরার আগে
কাঁখে ভরা কলসি নিয়ে নদীতে নেমে যায়
অনাহারী কঙ্কালসার কয়েকটি ধ্রুপদী রমণী
গা ধুতে ধুতে জনম দুঃখের মলম লাগায় গেঁয়ো বধু
একে অপরের মনে, শরীরের লোনা ঘামও ধুয়ে দেয় সাত জনমের গ্রন্থী খুঁজে খুঁজে।
রাত গভীর হয়ে এলো বলে
হাসির বিদ্যুৎ নিয়ে গড়িয়ে পড়ে
একে অপরের গায়ে, ধ্রুপদ লয়ে
জলেতেই আলগা করে কাঁচুলি ও বিনুনি
মাংসের উষ্ণ সৌন্দর্য মেলে দেয় মধুর সৌরভ
জল ও শরীরের সহস্র ছিদ্রময় প্রণয়ের।
জোছনার মায়াবী আলোতে নাকছাবি ছলোচ্ছল করে
বুক ও নিতম্বের ঢেউ তোলা পুকুর।
ফোঁটা ফোঁটা জলকণা তিরতির ঢেউ
জলে ডুবা নারী চুল ঝাঁকাতেই
অফুরন্ত অগ্নিতে রূপ নেয় তার যৌবন-
টগবগ শরীরের সুপ্রাচীন বুনো ঘ্রাণ
কোমল চিবুক থেকে ঝরে পড়ে, ফোঁটা ফোঁটা
বেতসলতার মতো জড়ায় গহীনে
চেনে অচেনা দুঃখ গুলো জীবনে জড়ায় যেমন।
জল থেকে তুলে দেহ উঠে যেতে যেতে
স্বপ্নে দেখে সাজানো ঘর, বাড়ন্ত ফসল, স্বামীর সোহাগ
আদরে ব্যকুল সোয়ামি সহজিয়া কামুক ধরন
হোচট খেয়ে তীরে উঠে দেখে,
বিলীয়মান বিন্দুতে দাঁড়িয়ে
স্বপ্ন তার মিলের চেয়ে অমিল হা করে আছে
ভীষণ রকম।
কাঁখে তুলে নেয় ভরা কলসি
দুঃখের কলসি জীবনে যেমন।
কিস্তিমাত চাল
এ দেশে এখনো
পাতা ঝরে বিকেলের ঝড়ে
এ দেশে এখনো
মানুষ খাদ্যের অভাবে মরে।
এ দেশে এখনো অবিশ্বাস
আস্তিনে তুরুপের গর্ব
কতটা ঘেন্না জমা হলে
এদের বিনাশ হবে খর্ব।
এখানে মানুষ মানবতা খোঁজে
শকুনির কিস্তিমাত চালে
এখানে মানুষ সত্য খোঁজে
মৃত্যু পরোয়ানার খাপে।
মিরা মাসির ভিটা
আনন্দ উবে গেছে চোখর জলে
ভিটা উজার খাঁখাঁ
মিরা মাসি, তুই যেথা যাবি যানা
রাত এখন উনুন পাখি, ঝকঝকে ফাঁকা।
প্রতিবাদে হারালো বর, আগুনে পুড়লো ঘর
রাস্তার পাশে, প্রভাতে লাশ দেখে প্রতিবেশী ডাকে
মিরা মাসির ছানা ভরা ছোখ, অশ্রু গড়ায়
এভাবেই বেঁচে আছে, এভাবেই বেঁচে থাকা।
জীবন আছে, শ্বাস নেয়া টেনে টেনে
মুখ গুজে থাকো, মানা কান্না চিৎকার
যত পারো ঝাপটাও ডানা, মিরা মাসি তবু কাঁদে
সব গেছে, এ ভিটা নয়কো আর তার।
মিরা মাসি চিৎকার করে
বুক তার ঝাঁঝরা
মরার জন্য তাঁর বেঁচে থাকা।
বিস্ফোরণ
কিছু শব্দ জলের, কিছু শব্দ পাতার
কিছু শব্দ তোমার, কিছু শব্দ আমার
কিছু শব্দ হাড়-সর্বস্ব মানুষের, কিছু শব্দ জনতার,
কিছু ব্যথা আমাকে পোড়ায়, কিছু যন্ত্রণা তোমাকে
কিছু যন্ত্রণা জনতার, কিছু দুঃখ সকলের-
বুকের ভিতর ঢুকে যায়, ফুঁসে বারুদের মত
গনগন করে,
এসব শব্দ, দুঃখ, যন্ত্রণা, ব্যথা
কেবলই ঘন্টা বাজায়
কেবলই শঙ্খের ধ্বনি দেয়।
কিছু কথা আমার, কিছু কথা তোমার
কিছু কথা জনতার, কিছু কথা আত্মগ্লানির
সব কথা ফুটছে, সব কথা মাথা কুটছে
সব কথা ফুসছে, ভেতর বাহির
সব কথায় আগুন জ্বলে
সব পোড়ে আগুন-ধোঁয়ায়।
কিছু উচ্চারণ ধিক্কার, কিছু উচ্চারণ লেলিহান
কিছু উচ্চারণ প্রতিবাদ, কিছু উচ্চারণ বিস্ফোরণ ঘটায়।