ফারুক আফিনদীর কবিতা
অরণ্যের খাট
আমার শিশু কন্যা দুপুরে ফোন করে বললো- কাঠের খাট ভেঙে গেছে, বাসায় আসো। শুনে হতাশার মধ্যে ডুবে গেলাম। বর্ষার পদ্মায় কেমন ঘূর্ণিপাক? একসময় হতাশায় ডুবে আমি আশৈশব চেনা পানকৌড়ির মতো খেলা করতাম। কিন্তু এখন আর আমি পানকৌড়ি নই। মাছ ও জল খাই বটে, জলের ঘাটে ডুবাই নৌকা বাই। কিন্তু এ-ই যে আমার জীবন নয় এখন। কেন না আমার ফুটফুটে শিশু কন্যা আমাকে বলেছে, আমাদের ঘুমানোর কাঠের খাটটা ভেঙে গেছে, (পুনঃ) আমাদের খাটটা ভেঙে গেছে। আর আমি হতাশার মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমি ক্লান্ত দাড়িয়ে থেকে থেকে। ভিজে ভিজে শীতল হয়ে গেছি। শরীরে কেমন কাঁটা দিয়েছে যেন। আমি এখন কাঠের খাটের মধ্যে ঘুমাতে চাই, অরণ্যের কাঠ-। কেন না, আমি অরণ্যের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চেয়েছিলাম। কাঠের খাটের মধ্যে আমি ঘুমাতে চাই, অরণ্যের কাঠ-। এবং দেখতে চাই শিশু কন্যার ফিঙে নাচ। কিন্তু আমার খাট ভেঙে গেছে এবং এ মহূর্তে আমার হাত শূন্য, কিন্তু আকাশের মতো নয় যে আমি হাতের মধ্যে কররেখাগুলোকে দেখব আকাশগঙ্গা হয়ে যেতে। সুতরাং আপাতত অরণ্যের কাঠে বা কাঠের খাটে ঘুমানো হচ্ছে না আমার। এবং এটা জানি না যে আমি কবে আবার অরণ্যের শান্তি নিয়ে ঘুমাতে পারব। এটা জানি যে একবার ঘুমাবই, যখন খাটে শুইয়ে আমাকে ঘুমে করে নিয়ে যাওয়া হবে এক ভিনদেশে যেখানে ঘাস ও বুনোলতারা অনর্গল কথা বলে নিরালা নির্জনে। সেখানে অরণ্যের মতো ঠাণ্ডা পড়ে থেকে ঘুমাব আমি, ঘুমের ওপারে-।
মৃত পুরুষ
সূর্য উঠেছে, উঠছে রে!
বেঁচে উঠছে
আগুন ফোটার মতো
দিন শেষে ফের সন্ধ্যায়
কবরে ঢুকছে
প্রকৃত মৃত মানুষ।
২.
পূরনো কবরের ওপর আলো ফেলছে সকালের সূর্য
একটা গরম বাতাস- বেরিয়ে যাচ্ছে- সাদা দীর্ঘ বাষ্প-
নগ্ন ভাষ্কর্যের মতো- বাতাসে উঠে যাচ্ছে
সন্ধ্যায় ফের ঢুকে পড়ছে কবরে
অগ্নিবর্ণ পুরুষটা
মৃত এক গরুর মতো
শুয়ে আছে হলুদ মোমের শরীর
মধুগন্ধ ঝরিয়ে
বুকের লাল লাবণ্যক পেছনে ঠেলে দিয়ে
হৃদয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় যে গোলাপি শাড়ি-
বিছানায় পড়ে আছে- রাত্রির নিঃশ্বাস ভরা আঁধারে-
মন গেছে নদীপাড়ে পার্কে উড়াল বাতাসে
মৃত সে — নগ্ন সে, মৃত যে-
তোমার শরীর রয়েছে ঘরে। কোণে আলমারির পাশে দুটি বাহু খাড়া করে রাখা আছে। অন্ধকারে বিষণ্ন শাবল, মাটির ওপরে তবু দাড়িয়ে আছে। মন পড়ে আছে উদ্যানে।
আর…, মৃত তুমি
ভাঙা ঘরে-
মৃত এক গরুর মতো টেনে নিয়ে যাও আজ- কাল ভোরের সূর্যের দিকে-
একজন স্ত্রী ও কতিপয় বাবুই
একজন নারী চলে গেলে, একজন, দুজন, তিনজন…, একজন- দুইজন- তিনজন-, কিছুই হয় না একজন পুরুষের। তৃষ্ণা পেলে অনায়াসে খুঁজে নিতে পারে একটু ঠাণ্ডা বা কুসুমগরম পানি-
দুহাতে ধরে মোলায়েম করে এক সাদা কাচের গেলাস থেকে ঢকঢক করে গিলে নেয়
একজন নারী চলে গেলে কী হয় একজন পুরুষের? ঘরে আগুন লাগে? বেড়া পোড়ে? চাল ধসে যায়! এর পর গাছতলায় গিয়ে তিনহাতি গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকে, ছায়ায়। আর পাখিদের বাসা দেখে। ভালোবাসা শেখে। এর পর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়ায়। এর পর বাঁশ আনে ছন আনে। বানায় আবার ঘর। পাখির বাসার মতো ছোট্ট। এর পর কোণায় কোণায় পাখি আসে, ভালোবাসে। এইসব দেখে ভালোবাসা কারে কয়- শেখে সে।
একজন নারী চলে গেলে কী হয়? কয়েকজন? জ্বলে। গুমোট মেঘ করে। বরিষায় ভেসে যায় ঘাট- হৃদয়পুরের হাট-। ছন আনে না, বাঁশ আনে না, ঘর হয় না দুমাস। পাখি আসে না, কোণে। ভালোবাসে না। এইসব দেখে সে বোঝে, নৈঃসঙ্গ কারে কয়।
একজন নারী চলে গেলে কিছুই হয় না একজন পুরুষের। একজন নারী বাড়ি এসে আগুন জ্বালিয়ে চলে যায় শুধু। জ্বালাতে পারে না?
একজন ঘরণী পারে, অধিশ্বরের মতো ঠাণ্ডাহৃদয়ে ফোটা ফোটা মৃত্যু রস ঢেলে দিতে।
একজন নারী এইসব পারে না- ঘরে এসে-। সে শুধু ভালোবাসে- একবার, আবার চলে যায়, আবার-। বাবুই যেন।