কবিতা

ফরিদা ইয়াসমিন সুমি’র কবিতা

ভেনাসের তৈলচিত্র

এই যে শোনো,
হ্যাঁ তুমি,
তোমাকেই বলছি,
কিছু বলবার থাকলে এক্ষুনি বলে ফেল। আর বোধহয় সময় নেয়াটা ঠিক হবে না।
প্রকৃতির অজস্রতার মাঝেও ম্লান হয়ে এসেছে অপরাহ্নের আলো, কিছু অস্পষ্টতাও আজ বড় বেশি স্পষ্ট।
বলবার যদি কিছু থাকে আজই বল।

দেখো, নদীর বয়ে চলা কেমন অগাধ গভীর, তবু ঘাসের ঘ্রাণে সম্মোহিত হয়ে তীরে ভিড়ে!
আমি বলি কী, আর সময় নিও না, বলে ফেল বলবার কথা ক’টি।

বাইরে চৈত্রের দমধরা আকাশ, নক্ষত্রেরাও কিছু মৃত্যু পুরে দেয় রক্তের ভেতর।
কারো কথা ভাববে, স্বপ্নে দেখবে, সেকথা তার হৃদয়ে পৌঁছুবে না,
এমনটা অসম্ভবের চেয়েও অসম্ভব! প্রকৃতির বরখেলাপ।

পাশ-দেয়ালের আয়নাতে এঁকে রাখা ভেনাসের তৈলচিত্রটি এখন চোখের তারায়,
তাই বলছি, যদি কিছু বলবার থেকে থাকে আজই, এক্ষুনি, এই মুহূর্তেই বলে ফেল।
শোনার সময় আর হবে কি’না জানি না!

বীজধান

জানালাটা খোলা –
ওপারে কড়া রোদ্দুরে
ঝলমলে সবটা দুপুর,
ঘাস-সবুজ বনে
মাতাল ফুলের উৎসব
লাল লাল মান্দার-ফুলে
লাল-ঝুটি বুলবুলির পরাগায়ন!
প্রাচীন ছায়াচ্ছন্ন প্রান্তরে
ডাহুকের ঠমক দিয়ে চলন
শূন্য আকাশে হাওয়ার চাবুক।
যৌবনের স্থুলতার চিহ্ন নিয়ে
দু’চোখে জ্বলজ্বলে লুব্ধতা,
কড়া মদের নেশার মতো
শরীরে থমথমে ঝিমঝিম!
অধীর আনন্দে থৈথৈ মৃত্তিকা
বীজধানে লুকোনো গানের মতো
প্রতিটি অণুতে কাঁপে আনন্দ-কণা।
জানালাটা বন্ধ হয়ে যায়!
অন্ধকারে পথ চেয়ে থাকে
প্রাণের স্পন্দন,
স্তব্ধ শূন্যতার ভেতর থেকে
চারদিগন্ত উদ্ভাসিত করা
প্রশ্ন ভাসে –
‘অমাবস্যা আর জ্যোৎস্নার তফাৎ কতদূর?’

ঘরহীন কোকিলা

শয্যা ছেড়ে গেলে
দেবে যাওয়া সিথানে উষ্ণতা ছড়ায়
স্বেদ-গন্ধ।
অনুযোগের ভঙ্গিতে পড়ে থাকে
দু’চারটা ঝরে পড়া চুল।
একটাই মাত্র জীবন
তবু কতো কতো
পরাভূত অভিযোগে
চোরাবালি শুষে নেয়
বর্ণালি অনুসঙ্গ।
নির্বোধ মানুষ
হাত পেতে নেয়
শাস্তিযোগ্য কষ্ট
আনন্দ বদলে!
কী করি, কেন করি
ভেবে ভেবে
অনির্দিষ্ট প্রজন্ম
করে পার।
অনিশ্চিত সঙ্গমে
নিশ্চিত গর্ভবতী
কোকিলারাও ঘরহীন।

বৃক্ষ

বৃক্ষ হতে বাকি নেই আর-
নতুন করে গজাবে বলে,
শাখা-প্রশাখাগুলো ঝরিয়েছে
পুরোনো সব পাতা!
স্ব আর পর-পরাগায়নে
ফুলের পর ফল
ফলের পরে বীজ
বীজের পর চক্র,
চক্রাকারে আয়ুর
চেতনাকাল!
কিচিরমিচির কলকাকলিতে মুখরতা
ডালে ডালে পাখিদের বাসা বাঁধার ধুম!
নিঃসন্দেহে
বৃক্ষ হয়ে গেছি ভেবে চেয়ে দেখি,
মাটিতে গাঁথে নি আজও শেকড়!

সঙ্গনিরোধেই ভালোবাসা

টিকে থাকার কঠিনতম লড়াইয়ে যখন ব্যস্ততম এই পৃথিবী,
আমার দেশের রাজনগরে তখন এক পশলা বৃষ্টি নামে।
পাথরচাপা মলিন ঘাসেরা ফিরে পেতে চায় সতেজ প্রাণ।
চৈত্রের ফুলেরা দিকবিদিক ছোটায় সুতীব্র সুঘ্রাণ।
বৈরী নগরীর প্রকৃতিতে বাজে কিশোরীপায়ের সুরেলা ছন্দ
যৌবনের উদ্দামতায় মত্ত অস্থির আকুল হাতছানি।
এ নগরী জেনেছে পরাজিত হতে নেই
এ নগরী জেনেছে ঘৃণাবাষ্প ছড়াতে নেই
সঙ্গনিরোধেই রেখেছি জমা সমস্ত ভালোবাসা
দূরত্বে বেড়েছে সকল অনায়াস গভীরতা।
আমরা জেনেছি, কঠিনতা ধুয়েমুছে যায়
বৈরীতা মুখথুবড়ে পড়ে গন্তব্য হারায়।
প্রকৃতির মতো আমাদের ভালোবাসাও জেনেছে
চৈত্রের ফোঁটাতে চিরবসন্ত ঝরে
বৃষ্টির ফোঁটাতে ভালোবাসা ঝরে
টুপটাপ
টুপটাপ
টুপটাপ
টুপটাপ
কার্নিশে
প্রাঙ্গণে,
সময়ের কাঁটায়
আলিঙ্গনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *