কবিতা

জিলুলর রহমানের দীর্ঘ কবিতা।। জড়ো হলে ঝরে যাবো, বিভেদে থাকবো বেঁচে: করোনা দিনের ভালোবাসা

জিললুর রহমান

শীতকাল শুরু হলে ধুলা ওড়ে

বিরাণ প্রান্তরে বনে

কিংবা চৌরাস্তার মোড়ে

ধুলা ওড়ে উড়ুউড়ু মনে

মনের পবন বড় সচকিত

বুক ভরে শ্বাস নিই তবে

শ্বাসের ভেতরে থাকে ধুলা

এই ধুলা থেকে একদিন আমরা এসেছি

একদিন ধুলা হয়ে ফের যাব চলে

ছাই থেকে ছাই

ধুলা থেকে ধুলা

উড়েছে কার্পাস তুলা

শুধু এই শীতে ধুলা একাকী ওড়েনি

সাথে সাথে সংক্রামক কীট

এই কীটদষ্ট পৃথিবীর হাওয়া

এই একে অপরের দিকে চাওয়া

পথের নিশানা সব

তাল গোল পাকিয়ে পাকিয়ে

ফুসফুস দগ্ধ করে যায়

অহেতু শঙ্কায় তাই দুরুবক্ষে কাঁপি

কেউ কেউ দুয়ারে দিয়েছে ঝাঁপি

কারও মুখ গরুর নাফার মতো পট্টি দিয়ে ঢাকা

কেউ বন্ধ করে দিল হাওয়াই গাড়ির চাকা

আমরা বন্দরে ঘাটে

যতই করি না ভীড়

যতই বাঁধি না কেন

কাঁটাতার বিভেদের হুল

কীটাণু ভাইরাস কোনো সীমান্ত মানে না

উহানের কুরুক্ষেত্র জুড়ে পড়ে থাকা

সহস্র লাশের আত্মা থেকে বের হয়ে

একদিন চৈনিক মায়ার ঘোর ছেড়ে ফেলে রেখে

করোনা গিয়েছে উড়ে দেশে দেশান্তরে

জাতিধর্মে ওদের তো বিকার দেখিনি

ইরান কি ইতালির জনপদে

মানুষের ঘরে দোরে

লাশের নতুন স্তুপ গড়ে তোলে অনায়াস

মহাপরাক্রম নিয়ে

বিশ্বটাকে ধমকে ধমকে যে দেশের বছর ফুরায়

তারাও পেয়েছে তেতো স্বাদ

নানা জনপদে আর নানান আকাশে

এখন তো রবিবারগুলো গীর্জায় প্রার্থনাহীন

আর সান্ধ্য পাবগুলো মদে চুর হয়ে নেতিয়ে পড়েছে

শুধু অশীতিপরের খক্ খক্ কাশির দমক

আর অন্তরাত্মা হিম করে দেয়া এম্বুলেন্স

এছাড়া এখানে সব জড়তায় মূঢ়

মানুষেরা পরস্পর তফাতে থাকছে একা

এভাবেই সামাজিক জীবগুলো

নি:সঙ্গ চাতক হয়ে বকের ধ্যানের বেশে

কুরে কুরে মরার প্রতীক্ষা করে

সখ করে তারা একে কুরেন্টিন ডাকে

কুরেন্টিনে তোমাকে দেখার

সব পথ রুদ্ধ করে দেয়

কুরে কুরে মাথা কুটে যদি মরি ঘরের ভেতর

তোমার নৈকট্য থেকে তবু দূরে দূরে থাকি

সমান্তরাল রেলের দূরগামী লাইনের মতো

তোমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ দূর থেকে কানে বাজে

বুকের সুঘ্রাণ হায় পাবার আকুতি শুধু বাড়ে

করোনা দিনের চুমু কতোটা গভীর হতে পারতো বলো তো

কতোটা আকাঙ্ক্ষা এসে জমা থাকে জিভের ডগায়

বলতে বলতে কথা কেটে যায় ঘোর

না বলা কথার তোড়ে আকুলি বিকুলি করে বুক

অন্য কুয়াশায় মন বিপন্ন কাতর

ফণিমনসার কাঁটাগুলো তবু সঙ্গী হয়

পাশে পাশে থাকে মান্দারের কাঁটা বড়ই গাছের ডাল

দূর থেকে ঠেলে দেওয়া ভাতের থালায়

একবাটি ডালের পাশেই দশফোঁটা হাহাকার

মিষ্টি কুমড়ার ভাজি আর

অশ্রুসিক্ত পালংশাকের ঝোল

তোমার ব্যস্ত আঙুল আমাকে আশ্বাস দেয় বটে

শাসায়ও তো সাথে সাথে

দর্শন মেলে না দিনে

মেলে না তো নিকষ আঁধারে

এমন করোনা দিনে মুখ থেকে উধাও মুখোশ

মানুষেরা একে অপরের — মানুষের নগ্ন মুখ

মুখজুড়ে নগ্ন বলিরেখা দেখে

অবিশ্বাস আক্রান্ত শহরে কারও ঘাড়ে

কেউ আর নি:শ্বাস ফেলে না আজ

চালের আড়ত থেকে

মাছের বাজার থেকে

যতোসব দরকারী সওদা উধাও

পেঁয়াজ আনাজ আটা আর মশলার গুঁড়ি

মরিচ রসুন বাটা সব আগুনে আগুনময়

এসো আমরা জড়ো করি খাবার দাবার

এসো আজ প্রেমও গুদামজাত করি

আর যাবতীয় সব প্রয়োজন

তারপর আমরা আর দেখবো না মানুষের মুখ

দেখবো না তোমার আমার আমাদের মুখ

ছোট্ট মেয়েটির মনকাড়া কথাগুলো ছয় ফুট

দূর থেকে শুনি

বুকের ভেতরে নিয়ে মেয়েটিকে

আদর করার দিন শেষ হয়ে গেল বুঝি

রাত বাড়ে দিবস ফুরায়ে যায়

বিভ্রমে আকীর্ণ জনপদে

অতীন্দ্র ছায়ার চলাচল

পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া

প্রতিটি মানুষ আজ হন্তারক মনে হয়

পৃথিবী কতোটা ধুলি আর

কতোটুকু আলোর উচ্ছ্বাস

কার সাধ্য মেপে দেখে অর্থহীন বায়ুক্লান্ত হাহাকার

শিল্পীর ক্ষরণ আর শ্রমিকের ঘাম

কোনটা নোনতা বেশি কোনটাতে জল

দিব্যরথে লালন হাছন ঘুরে

কে যে বেশি চেতনা জাগায়

সামান্য মনুষ্যকুল মদলিপ্ত নেশাবুঁদ

মাতোয়ারা ময়ুর সিংহাসনের খোঁজে

সয়ে যাচ্ছি হানাহানি ভেদাভেদ

বুঝেও না বোঝার মায়াচোখ বুঁজে

একেকটা একাকী মানুষ

আরো আরো একা হয়ে বাঁচার সংগ্রামে মাতে

অথচ মানুষ ছিল সামাজিক জীব

‘দশে মিলে করি কাজ’ এবার প্রথম লোকে মানতে নারাজ

এখন প্রতিটি ঘরে সকলে সজোরে বলি

ইউনাইটেড উই ফল, ডিভাইডেড উই স্ট্যান্ড,

জড়ো হলে ঝরে যাবো, বিভেদে থাকবো বেঁচে।

২ thoughts on “জিলুলর রহমানের দীর্ঘ কবিতা।। জড়ো হলে ঝরে যাবো, বিভেদে থাকবো বেঁচে: করোনা দিনের ভালোবাসা

  • হোসাইন কবির

    সমসাময়িক বিষয়ে চমৎকার কাব্যিক বয়ান

    Reply
  • Achyuta

    হাহাকারটা বুকে বাজল খুব এই সকালে কাঁটাতারের এপার থেকে। এ এক ভীষণ ক্যুর‍্যান্টিন। ভালো থাকুন কবি এই আশায় হয়তো আপনি বা আপনার মতো কোনো চিকিৎসা গবেষক আমাদের আবার কাছাকাছি আসার মন্ত্র চেনাবেন হয়তো রচনা করবেন কোনো মহাকাব্যিক অ্যান্টিডোট

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *