কবিতা

একগুচ্ছ কবিতা II মজিদ মাহমুদ

ভয় আমাদের এতদূর এনেছে
আমরা ভয়ের সন্তান
মরার ভয় থেকেই তো যুদ্ধে
প্রতিপক্ষের ঘাড় দিয়েছি মটকে
পিতার অনুগত ও পুত্রের ভালোবাসা-
সেও তো ভয় থেকে
তাদের বিগড়ে যাওয়ার ভয়
একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার ভয়
ভয়ই তো আমাকে ভালোবাসার পথে
বসিয়ে রেখেছে
যেভাবে একটি শিকারি কুকুরের ভয়ে
মেষগুলো সুশৃঙ্খল দলবদ্ধ থাকে
ভালোবাসা হলো একটি কৌশল
ভয়ের উপজাত সন্তান
ভয় না থাকলে ভালোবাসা থাকবে না
জন্ম থেকেই আমাকে শেখানো হয়েছে ভয়
পিতাকে কর ভয়, শিক্ষককে কর ভয়
ঈশ্বর ভয়ের বেশি কিছু নয়
প্রেমিকার চলে যাওয়ার ভয়ে
তার নির্বোধ উক্তি নীরবে সয়েছি
ভয় ও ভালোবাসা, ভয় ও আনুগত্য
একই অর্থবোধক
যাকে পেয়েছি ভয়
সে দিয়েছে ভালোবাসা অবশ্যই
নেতা-নেত্রীকে পেলে ভয়
বাড়ি গাড়ি অক্ষয়
ঈশ্বরকে পাও ভয়
মৃত্যুর পরে স্বর্গ নিশ্চয়
অনন্ত ভয়ের করো ভান
ভালোবাসা জুটিবে অফুরান।

আমি তো কিছুদিন বাঁচতেই চেয়েছিলাম
আমি তো কিছুদিন বেঁচেও গেলাম
আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি
বাঁচতে বাঁচতে মরে যাচ্ছি
কারণ এখন আর বাঁচার সময় নাই
খেলার মাঠে নির্ধারিত সময়ে
ফাউল করেতে করতে বেঁচে গেছি
লালকার্ড দেখার আগে পড়েছি সটকে
শূন্যবল ফসকে পেয়ে গেছি লাইফ
তাহলে আরো দুএকটি দান খেলাই তো উচিত
সূর্যপাটে যাওয়ার আগেই তো খেলা যাচ্ছে গুটিয়ে
সবগুলো বল তো আর শূন্যগর্তে পড়বে না
বল ও গর্তের মাপ ঠিক থাকলে
দৌড়ের টাইমিং হলে কবেই যেতাম সটান
বলিহারি তুমিও মেরেছ
আমিও দিয়েছি উড়িয়ে
মাঠে প্রতিপক্ষই তো কাছাকাছি থাকে
যাদের সঙ্গে খেলি নাই
যাদের ঠ্যাঙের সঙ্গে বাঁধেনি ঠ্যাং
তারা মানবিক চেতনায় ভরপুর
তারা থাক নমস্য উচ্চতায়
আমি তোমাকে মারিব
মারতে মারতে বাঁচাব শুশ্রূষায়
যাদের দেখি নাই
যাদের দেখব না
তারা থাক আমার অদৃশ্য চেতনায় ।

তার মৃত্যুর পরে সবাই বলল, তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন
তার বিরুদ্ধে ছিল না সহকর্মীদের অভিযোগ বিশেষ
সকল বিবেচনায় তিনি ছিলেন এক সাধু পরুষ
জাতির কল্যাণে সব কিছু করেছেন- যুদ্ধ ব্যতিত
উপরওয়ালারা খুশি না হলেও চাকরির ঝুঁকি ছিল না কখনো
কারণ নিয়মের বাইরে দেন নি কোনো মত জীবনে
চাকরির আমলনামায় ছিল না তার দাগ
পাড়া-পড়শিরাও এরচেয়ে বেশি ভাবে নি কখনো
পান-জর্দা একটু আধটু খেলেও ধূমপানের ছিল না অভ্যাস
পাড়ার হকারও খুশি ছিল তার পত্রিকা অনুরাগে
প্রতিদিনের খবরে তার প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক
পুলিশের খাতাতেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ
জীবনে একবার হাসপাতালে গেলেও সুস্থ ছিলেন বেশ
ব্যাংকের ঋণ ও ইনস্যুরেন্সের কিস্তি পরিশোধে হয়নি ব্যত্যয়
আধুনিক মানুষের সবগুলো গুণ ছিল তার
শান্তির সময় শান্তির পক্ষে, যুদ্ধের ভীতি ছিল না অতীতে
তার ছিল সুখী দাম্পত্য জীবন
দিয়েছিলেন পাঁচ সন্তানের জন্ম
বলা যায়, পিতা হিসাবেও আদর্শ তার কালে
এমনকি স্কুল জীবনেও করেননি হৈ চৈ
সুবোধ ছাত্র ছিলেন- শিক্ষকের ভাষায়
সুতরাং এই প্রশ্ন করা নিশ্চয় অবান্তর হবে-
তিনি কি স্বাধীন ছিলেন?
তিনি কি ছিলেন সুখী?
আমাদের সবারই কি উচিত তার মতো হওয়া!

আমার ভালোবাসা এমন নয় যে তুমি ঘৃণা করলেও বাসতেই থাকব
কেননা আমার ভালোবাসা কেবল শারীরিক চেতনা নয়
আমার মনোচেতনাও তোমাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে
যদিও আমার চোখ প্রথমে তোমার আঁখির কটাক্ষ পেয়েছে টের
তবু আমার ও তোমার অব্যক্ত কথাগুলোই তারা বলতে চেয়েছে
যদিও তারা কেউ জানত না কি সব কথা ছিল তাদের
যদিও তোমার রঙ ও উচ্চতাকেও আমি উপেক্ষা করিনি
কেননা তোমার রঙই তো ছিল আমার প্রিয় রঙ, আর
তোমার উচ্চতা আমি হিমালয় শৃঙ্গের মতো উঠতে চেয়েছি
যদিও তোমার কোমর ও বক্ষের মাপ আমি গোপনে নিয়েছি
তবু কামুকতা আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না
কেননা দুর্গম অনেকটা পথ আমরা পাশাপাশি হাঁটতে চেয়েছি
কখনো কাঁধে কখনো পিঠে কখনো পেটেও বইতে হবে আমায়
পথের মাঝখানে যে সব শিশু খাদ্য ও পানির জন্য করবে আহাকার
তারাও তো তোমার বক্ষের অংশিদার !

তুমি তখন কাশফুল নিয়ে বেশ মেতেছিলে
তোমাদের কবিরা অমল ধবল পালে বাতাস লাগিয়ে
তোমার প্রস্ফুটিত কুঁড়িদের বিকাশ দেখছিল
তুমি তখন ছিলে একটি নদীর মত
তোমাকে সিক্ত বসনা করে বৃষ্টি হচ্ছিল
এক অজানা পর্বতের সূচ্যগ্র থেকে নেমে আসছিল
তোমার শিহরণময় গোপন কম্পন
পানি সরে যাচ্ছে
তোমার দু’ধারে জেগে উঠছে পলি
তুমি জন্মদানের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছ
কি যে কোমল তোমার সেই পলির জমিন!
ধরো আজ যদি আমি হেলেনের কথা বলি
তোমাকে নিয়ে মেতেছিল গ্রিসের মানুষ
আমিই সেই একিলিস; যার গোড়ালিতে প্রাণ ছিল
এই অন্ধ হোমারকে তুমি কি বিশ্বাস করতে পারো?
তুমি ছিলে শরতের মত আনপ্রেডিক্টেবল
তুমি হাসতে হাসতে কাঁদো
কাঁদতে কাঁদতে হাসো
তোমাকে কখনই আমি আবিষ্কার করতে পারি নি
সঙ্গমের স্মৃতির মতো সে সব আজ অর্থহীন
এখনও সূর্য আমাদের সময়কে বিভাজিত করে দেয়
দিন গণনায় তুমি ফিরে আস, কিন্তু
তোমাকে আলাদা করে চিনতে পারি না আমি
তুমিও হয়ে গেছ তোমার বান্ধবী রহিমা ও
রোকসানার মত এভারেজ
তোমরা আজ একই ফিতায় চুল বাঁধো; তুমিও
ওদের মত নাভি থেকে সরিয়ে ফেলেছ বসন
পিঠের দিক থেকে তোমাকে চিনতে পারি না
আসলে তোমার বয়স হয়েছে; তাই
শুভ্রকে ধরে রাখতে তোমার এই আপ্রাণ চেষ্টা
মনে হয় আমি তোমার বার্ধক্যে এসেছি
তোমার যৌবনে ছিল রবীন্দ্র-নজরুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *