কবিতা

এবিএম সোহেল রশিদ এর জন্মদিনে শুভেচ্ছা

লাল জুলাইয়ে কবিতা লিখেছেন
সমর্থন জানিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছেন
সন্তানতুল্য প্রতিবাদীর জন্য পথে দাঁড়িয়েছেন
রাজপথের রক্ত স্রোতের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন
বিজয়ের জন্য তারুণ্যের আকুতি দেখেছেন।
অথচ বিজয় মিছিলে জাননি।

সোজাসাপটা উত্তর—
এ বিজয় তারুণ্যের
বড় অর্জন ভাগবাটোয়ারা করতে নেই।

আটপৌরে সংসার জীবনে
আপনি নুন তেলের হিসেব কষেন
ব্যাকরণ সিদ্ধ চিত্রকল্প খোঁজেন
কিন্তু আপনাকে ধরা দেবে না কবিতা।

দ্রোহের পঙক্তিমালার পর চাই বিরতি।
এই মানচিত্র আপনার, এর অলিগলি সব চেনা
মানুষগুলোর স্বভাব মুখস্থ, চোখের ভাষা ঠোঁটস্থ!

যারা লালজুলাই শুনেছে, দেখেনি
তাদের কবিতায় এখন পত্রিকার পাতা রমরমা
তাদের গর্বে মুখরিত শাহবাগ-শিল্পকলা
এই ভিড়ে নাই-বা হলো আপনার কথা বলা।

হঠাৎ আজ বন্ধ জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন
চলমান বিজয়োৎসবের হর্ষধ্বনি শুনলেন
কিন্তু দেখার চেষ্টা করলেন না।

একাত্তরের কাছ থেকে জেনেছেন
দেশপ্রেমিকদের প্রাপ্তির খাতা খুলতে নেই
ক্ষুধা না পোষালে, সৃষ্টিশীল হওয়া যায় না
তা হোক সন্তান উৎপাদন কিংবা সত্যোচ্চারণ।

সুবিধাভোগীর ভিড়ে ‘মৃত্যু’ আপনাকে নিয়ে দেবে উড়াল
একটু দাঁড়ান, বন্ধ জানালাটা খুলে দিই
শেষবারের মতো দেখে যান বাংলাদেশের মুখ!

এতকাল পতাকার লাল
বলেছে লাগবে না রক্ত
এতে হয়ো না বেসামাল
হায়েনারা সব খুনে আসক্ত।
চোখে পর্দা টানা রাজা
মাথায় রক্তাক্ত মুকুট
হাতে হাতে ঝাঁটার সাজা
উড়ছে মৃত্যুর চিরকুট।

আর নয় চুপ, দেখাও স্বরূপ
দেব রুখে কালো হাত
হও যদি বিরূপ? হবে তছরুপ
নামবে বিভীষিকার রাত।

দেশ আমার, সাধ্য কার
কোন সাহসে চোখ রাঙাও
বিভেদ করে তুমি
অধিকারটুকু কেড়ে নাও।

লাঠি বোমা টিয়ারগ্যাস
করে না ভয় বাংলাদেশ।

.প্রতিবাদী রক্তে ফুটেছে সাদা বকুল
ভুলে ভুলে উড়িয়েছে কালের ধুলো
যুবতীর ঝড়ো চুলে এলোমেলো দৃষ্টি—
হাত বাড়িয়ে বলল, ঘোমটা খুলো
উপড়ে ফেলেছি প্রতিহিংসার মূল
ঘুম কাতুরে আলোয় তাই নিমগ্ন বৃষ্টি।
.
পরিচয়হীন আমাকে কীসের ভয়
একটাই দোষ! আমি বীর, দুর্জয়
পেতে চেয়েছি আগুনের উল্লাসে—
নাগরিকত্ব, নাম-ঠিকানা-পরিচয়
আমি নই মিছিল, বৈশাখি ঝড়
স্বেচ্ছায় প্রেম উড়াই, বৈরী বাতাসে।
.
আমি ক্লান্ত পথিক নই, দুরন্ত নাবিক
সবার আগে হাতে নেই মিছিলের ঝান্ডা
পাখি, নারী, নদী আর বেনারসি শাড়ি
ফেলে ছুটি, রোধ করি পুলিশের ডান্ডা—
জাগিয়ে তুলি আত্মায় লুকানো মানুষ
যে ভীত নয়, সে শুনে না প্রোপাগান্ডা।
.
সাহসী বুকে জমা তীক্ষ্ম কথার ছুরি
বিদায়ী সম্ভাষণে মিছিলের আমন্ত্রণ
মৃত্তিকায় কান পেতে শুনি ছলচাতুরী—
প্রত্যুত্তরের জন্য করি, নতুন শব্দ চয়ন
এসো দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাই, স্পষ্টবাদী হই
বুঝুক সবাই, ঐক্যবদ্ধ কতটা জরুরি।

হও আগুয়ান, দিচ্ছ স্লোগান
চাও কীসের অধিকার
এরা বধির, এরা অন্ধ
শোনার সময় নেই তার।

হাঁকবে নেতা, থামবে স্লোগান
বিজয়ের উল্লাসে
পাবে না সময় পালাবার
যুক্তির উপহাসে।

.সম্পর্কের আঙিনায় আজ ইস্পাতের প্রাচীর
আদালতের আদেশ, প্রেমের কাছে মূল্যহীন
চাইলেই ভাঙা যায় না এই ভালোবাসার নীড়
প্রত্যাশার তুলি করে ‘রুদ্ধ আকাশ’ রঙিন।
যতই চেপে ধর গলা, হবে না বন্ধ সত্য বলা
এ তোমার কেমন সংস্কার, কেড়ে নিলে অধিকার।
যতই আঁটো ফন্দি, জনরোষে হতেই হবে বন্দী
স্বাধীনতা তুমি কার? ক্ষমতার নাকি জনতার।

পতাকার লাল এখনো রক্তে ভেজা
অর্ধশতাব্দী পরও সূর্যোদয়ের মুখোমুখি
শুনছি প্রসব যন্ত্রণায় কাতর, সময়ের কবিতা
অকাতরে বিলাচ্ছে প্রাণ, মীর মুগ্ধ, আবু সাঈদ
শত শত রক্তাক্ত প্রাণ, অর্জন করছে অম্লান।
.
পতাকার লাল এখনো রক্তে ভেজা
স্লোগান মুখরিত রাজপথ
ষাটোর্ধ্ব বৃক্ষ ছায়ায় মিছিল! জিতেছে লাল জুলাই
সাহসের লংমার্চ দাঁড়িয়ে বলেছিল, গণতন্ত্র চাই।
.
পতাকার লাল এখনো রক্তে ভেজা
জানতে চায়! তরুণ বর্গাচাষি
সীমান্তের ওপারে ফুঁসে ওঠা একচোখা সুহৃদ
ভুল বুঝতে পেরে আঁকে স্বাধীনতা, কার আহ্বানে
উড়ুক সার্বভৌমত্বের পতাকা সশ্রদ্ধ সম্মানে।
পতাকার লাল এখনো রক্তে ভেজা
সম্পূরক প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিস্তম্ভ
রক্তনদীর গর্জনে মুখরিত স্মৃতিসৌধ
প্রবঞ্চকের প্রতি ঘৃণা জানাতে চায় শহিদ মিনার।
বিজয়ের উচ্ছ্বাসে রৌদ্রোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ আর
দুরন্ত যৌবনের লালজুলাই
হাজার গ্রাফিতির সুতীব্র উচ্চারণ
‘কেমন আছ বাংলাদেশ?’ কেন এখনো যুদ্ধ বেশ?
করবে সব অবসান, অধিকারের গান
বাংলাদেশের মাটি, দেশপ্রেমিকের ঘাঁটি
যতটুকু অবদান, ইতিহাসে ততটুকু স্থান।

স্বাধীনতা, কেমন আছ তুমি
কোথায় থাক আজকাল
ভ্রষ্টদের শেকলে বন্দি আমার ‘কণ্ঠ’
কথায় কথায় অধিকারের মিছিলে গুলি
এভাবে, এভাবে চলবে আর কতকাল?
বলতে পারো?
.
স্বাধীনতা, তোমার ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে
পাড়ি দিয়েছিলাম এক নদী রক্ত
বিসর্জন দিয়েছিলাম দুই লক্ষ ফুলের সৌরভ
মাঠের পর মাঠ পুড়ে হয়েছিল ছারখার
তবুও এ মাটির ‘প্রান্তিক সন্তান’ মানেনি হার।
.
চাই স্বাধীনতার সাথে আলিঙ্গন
তাই তোমাকে দেখার প্রত্যাশায়
অবরুদ্ধ ঢাকায় গুলিবিদ্ধ কিশোর
পুলিশ ব্যারাক, ছাত্রাবাসে লাশের মিছিল
বুটের আঘাতে জর্জরিত মৃত্তিকার পাঁজর
.
স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য
সন্তান হারা মায়ের আহাজারি, রণাঙ্গনের শক্তি
যুদ্ধ-বিধবার বিসর্জিত অশ্রু, সাহসের প্রেরণা
পথ নির্মাণ করেছে, গর্জে ওঠা আগ্নেয়াস্ত্র
শিখে নিয়েছিল বাঙালি, শত্রু পরাজয়ের মন্ত্র।
.
স্বাধীনতা তোমার অপেক্ষায়
রাজনীতি শূন্য মাঠ, ফেলছে ‘দীর্ঘশ্বাস’
চৌরাস্তার মোড়, ভুলে গেছে আগুনঝরা ‘স্লোগান’
মাইক্রোফোনগুলো এখন নষ্টদের দখলে
বলো, আর কত রক্ত ঝরালে তুমি আসবে?
অর্জিত দেশপ্রেমে আবার নতুন করে জাগবে?
.
কারাগারেই ফুরিয়েছে নেতৃত্বের বিজয়োল্লাস
মাইক্রোফোন হাতে বিপ্লবীদের উচ্ছ্বাস
প্রেমিকাকে অপেক্ষায় রেখে, চলে গেল যুবক
গ্রামের ভীতু ছেলেটি অস্ত্র তুলে নিল হাতে
শাড়ির আঁচল, কোমড়ে বেঁধে এগিয়ে গেল অষ্টাদশী।
এক নববধূ যুক্তির কোষাগারে দিল জমা মেহেদি রং
ফসলের গোলা তুলে দিল মসজিদের ইমাম
সিন্দুক খুলে টাকা দিল মন্দিরের পুরোহিত
বেজে উঠলো দামামা, যুদ্ধ জয়ের রণসঙ্গীত।
.
তোমাকে লাল সবুজে বরণ করে নিতে
গ্রামের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আছে বসে জায়নামাজে
অশীতিপর বৃদ্ধার তছবিহতে দীর্ঘায়ুর প্রার্থনা
নতুন সূর্যোদয়ের জন্য একনিষ্ঠ আরাধনা।
.
কোটি মানুষের ইচ্ছের প্রদীপ ‘দ্রোহ’
মুক্তিকামীদের পদক্ষেপ সোনালি ধুলো
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আর কত রক্তনদী
সেসব বঞ্চনার ইতিহাস জানাতে
তোমাকে আসতেই হবে।

জেল-জুলুমের ষোলোটি বছর
সংবাদপত্রে, শিরোনামহীন খবর
দেশপ্রেমিক যারা মৃত্যু ফাঁদে
দেখেছি মেঘাচ্ছন্ন বর্তমানে
কেন এই বাংলাদেশ কাঁদে।
.
নৃশংস হত্যার হাহাকারে, পুলিশি নির্যাতনের অন্ধকারে
বিক্ষুব্ধ রাজপথে দাউদাউ আগুন, ঘৃণা সহকারে।
.
আমি জাতীয়তাবাদী, সুতীব্র প্রতিবাদী
ঘৃণা, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি, স্বৈরাচারের প্রতি।
পারেনি ভুলতে ষড়যন্ত্রে ও বিবাদে
দেখেছিলাম সুদিনের আলো, জিন্দাবাদে।
.
এতোদিনে, গেছি চিনে, শোষকের জাল
চিনেছি গুম হত্যা! কারা করে নির্ধারণ পরকাল
কারা লোভী, স্বৈরাচারের দোসর
কাদের হাতে বন্দি এই শেকল পরা শহর।
.
আমরা এখন বলতে পারি, কে হন্তারক?
কে গুম ও আয়নাঘরের ন্যাপথ্য পরিচালক
জেল-জুলুমের চাবুক কার হাতে?
কে মারে খুব সহজে; ভাতে নয়, রক্তপাতে।
.
ষোলোটি বছর ত্যাগ-তিতিক্ষার পিঠে চড়ে
এসেছে গণঅভ্যুত্থান, এসেছে বিপ্লব, বেলা দ্বিপ্রহরে
যাদুর এই শহরে, রক্তাক্ত প্রহরে।
মঞ্চ মঞ্চ খেলা আর কত বেলা?
যাক থেমে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের খেলা
বিরুদ্ধে হোক সোচ্চার
ছাত্র জনতার অর্জিত অধিকার
মুক্ত হও, মুক্ত হও, মুক্ত করো দেশ
মুক্তির মিনারে হাসবে আবার বাংলাদেশ।

অভিনেতা, কথাসাহিত্যিক ও কবি এবিএম সোহেল রশিদ শিল্প-সংস্কৃতির প্রায় সবকটি পথেই স্বাচ্ছন্দ্যে পাদচারণা করছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বেদিমূলে আত্মোৎসর্গকৃত সূর্যসন্তান শহিদ বুদ্ধিজীবী এবিএম আবদুর রহিম ও মা কারুশিল্পী মিসেস ঝরনা রহীম-এর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৫ ( এসএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি ১৯৬৮) রাজধানী ঢাকায় আজিমপুর মেটারনিটি হাসপাতালে ভূমিষ্ঠ হলেও পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসুদেব ইউনিয়নের তিতাসনদীর পাড়ে ঘাটিয়ারা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মোল্লাবাড়ি পরিবারে।

লেখকের দৃষ্টির সীমানায় সময়ন দীর স্রোতে বিরহও রঙ বদলেছে বার বার। দুঃখমেঘে জমানো খুনশুটি ও কষ্ট সমুদ্রের নানান অনুষঙ্গ, দেশপ্রেম, কাব্যরসের বিচ্ছুরণে শৈল্পিক উচ্চারণের সাহস দেখিয়েছেন কবি এবিএম সোহেল রশিদ। অভিনয় তাঁর পেশা। সব মাধ্যমেই অভিনয় করেন। চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বিটিভিতে চলচ্চিত্র বিষয়ক পাক্ষিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ ঝিলমিল’ গ্রন্থনা ও সঞ্চালনা করেছেন।

লেখকের অন্যান্য বই

কবিতার বই
১. আগুন ঠোঁটের ঘ্রাণ
২. পাপড়িতে মাখামাখি বিকেলের রোদ
৩. বিসর্জনের অহংকার
৪. সারথিকে আমি চিনি
৫. মায়াবী জালে বাঁধা উঠোন
৬. চোখের ভেতর অচেনা নদী
৭. প্রেম ও দ্রোহের কবিতা আগুনপথে একাই হাঁটি
৮. জ্যোৎস্না রাতের উজানে
৯. বুকপকেটে ঘুমায় গন্তব্যেরঠিকানা
১০. ডুবে চাঁদ অবাধ্য পুকুরে
১১. শেষ অবধি সারথি ভালোবেসে ছিল
১২. ফেরারি চিরকুট প্রশ্নবোধক মুখ
১৩. আমি আর প্রেম চাইব না
১৪. নদীর মতোই প্রেম বয়ে যায়

কিশোর উপন্যাস
‘১.পানামনগরে ভয়ংকর রাত

উপন্যাস
১.পোড়ামুখির সোনার নোলক
২. আগুননদী ফাগুনবাড়ি
৩. সব প্রেম আছে জমা সুন্দরীতমা

শিশুদের গল্পবই
১.মিষ্টি নানুর মজার গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *