কবিতা

একগুচ্ছ কবিতা-ফরিদা রানু

গতকাল রাতে কড়া নেড়ে বললে- তোমাকে চাই
তোমার আপাদমস্তক, তোমার মন, তোমার অন্তর চাই,
তোমার যা আছে তার সবটা উজাড় করে দিও!
রেশম পর্দা টেনে, সুখের কাজল ছেনে
আমিও বললেম-
এই নাও হৃদপিন্ড, এই নাও ধারাল অস্ত্র
ছিন্ন করে জেনে উত্তর:
আমি তোমার, শুধুই তোমার।

কুমকুমের আবিরে যখন প্রস্ফুটিত কৃষ্ণচূড়া
আসমানের বাসরে তখন আস্ফালনে উষ্মা ভরা,
বেনুবনের সারিতে এমন প্রজ্বলিত ভস্ম রাধা
বৃন্দাবনের বাহিরে যেমন আকুলিত শ্যাম পাড়া!
উষ্ণ প্রবাহে শীতল পাহাড়ে
কৃষ্ণ সমারোহে অতুল বাহারে
কষ্ট কোলাহলে করুণ মায়ারে,
নষ্ট বাগিচার কুসুম আসরে-
নীর ঝরে অগোচরে খুব নীরবে।
সে কি গানের বুলবুল নয়?
স্রোত কি সদাই কুলকুল বয়?
ফুল কি বিলকুল ভুল হয়?
প্রেম কি শুধু উচাটন মনের ক্ষয়?

প্রকম্পিত রাজপথে ঝঞ্ঝার মিছিলে
কৃষ্ণচূড়া যখন অবগুণ্ঠিত শ্লোগানে
তখন খুব ভালোবেসে
আলতো হাতে যত্ন করে
‘তুমি আমার কবিতা
‘তুমি কবিতা সুন্দরী’
পোস্টার লাগায় দেয়ালে দেয়ালে।
ঘোমটা তুলে কোন এক খেয়ালে
মহুয়া বলে,
মন কেনা এত সহজ নয় গো?
দস্যিপনা ছেড়ে চুপটি মেরে বসে থাক সব তাহলে।

শিউলি ঝরানো পথে থেকে থেকে রক্ত জবা
গুণ্ঠিত অরুণ মেঘে থেমে যায়, সিক্ত তমা
ক্লান্তির বাসরে করজোড়ে শুধু চাই ক্ষমা
বঞ্চিত পাঁজরে কত শঙ্খ ক্ষত আছে জমা!
স্থির মনে,
দৃঢ় সংগোপনে
শূণ্যে দুলে হাতগুলো
বিপরীত মাধ্যাকর্ষণে
অসহায় আস্ফালনে।
রাত দখলের বিভৎস প্রতিযোগিতায়
ডাকাত লুটতরাজ চলে
অপারঙ্গমতায়,
সাহসী পুরুষের ঢাল শামুক পঙ্কিলতায়
রাঙা শিমুলের ছোপ ছোপ দাগ সুক্ষ্ম অহমিকায়।
টগবগ করে জ্বলছে বহ্নি শিখা
কাফনের কাপড়ে তবুও অশ্রু ঢেকে রাখে সাহসিকা;
বকুলে মুকুলে সুরভিত ছিল যে বুক
সেখানে আজ চাঁপা আগ্নেয়গিরির দুখ!
দু:খ পিও,
বারি পিও
বিধু পিও সাকি;
তোমার লগে
আমার পরান
বান্ধা যেন রাখি।
সূর্য ডুবে
ঠুনকো ভবে
মৃত্যু যায় ডাকি
ভাঙবে শাসন
জাগবে শোষণ
থাকবে তারার আঁখি।

এসো আজ আনুবিসের মুখোস পড়ে
রজনে সিক্ত করে
নীল নদের জলে ধুয়ে
পরতে পরতে নেট্রনের প্রলেপে
লেলিনের পট্টিতে মুড়ে
সময়টাকে মমি করে দাও।
হারাতে চাই না টান টান ত্বক
খোয়াতে চাই না ভাঁজহীন চোখ
লুকাতে চাই না টোলপড়া মুখ।
আনুবিসের মুখোশ পড়ে তুমি না হয় এসো
সময়টাকে পেছনে ফেলে আমার কাছে বস!
তোমার সুখে সুখ যে আমার
তুমি না হয় হেসো
মমির দেহে তুমি না হয় হৃদপিন্ড হয়ে মিশো।

আমি একটি রাত দখল করতে চাই
তবে বাংলাদেশ
বা বহির্বিশ্বে নারীরা যেভাবে দখল করে
ঠিক সেভাবে নয়-
পুরুষ কি শুধু পশু?
নয় কারও আশ্রয়?
বঞ্চিতের পাশে দাড়ায়
আহ্লাদকে দেয় প্রশ্রয়!
আমিও রাত দখল করতে চাই
একটি নয়, দু’টি নয়
শত হাজার রাত দখল করতে চাই;
তবে পিতৃতন্ত্রের তুলোধোনা করে নয়
বরং মাতৃতন্ত্রের সম্মানে, আবেগে
সমুজ্জ্বল; স্ব-মহীমায়!

হোক প্রতিবাদ
জনসভায়, হাজার মুষ্ঠির মিছিলে
হোক প্রতিবাদ
শুক্লাপাতায়, নানান গোষ্ঠীর নিখিলে,
হোক প্রতিবাদ
ছাপাখানায়, লেখকের বলিষ্ঠ কলমে
হোক প্রতিবাদ
মিষ্টি আভায়, অপাংক্তেয় অনিষ্ট শরমে।
হোক প্রতিবাদ
বিপন্নতায়, মরেছে যেসকল মরমে,
হোক প্রতিবাদ
ভিন্ন মাত্রায়, কাঠাল পাঁকা গরমে।
হোক প্রতিবাদ
জাতীয়তায়, যারা ভেঙেছে স্থিতি
হোক প্রতিবাদ
শৃঙ্খলতায়, যারা পেয়েছে ভীতি
হোক প্রতিবাদ
আসন্নতায়, থামুক মুদ্রা স্ফীতি
হোক প্রতিবাদ
অস্থিতিশীলতায়, আসুন গড়ি প্রীতি।

মেঘ বালিকা,
আমি এই রোদজ্বলা দুপুরে তুমি হতে চাই
প্রখর তাপে শুকিয়ে যাওয়া শুষ্ক গালে
ঘন মেঘের বর্ষণ হতে চাই;
তামাটে তকে নোনা কনার জায়গায়
তোমার শীতল ফোঁটায় স্নিগ্ধ হতে চাই।
আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে
রিমঝিম বৃষ্টির তাল খুঁজে ফিরি
ঝরে পড়া বকুল তলায়
বানাতে চাই সুঘ্রাণে ভরা সিঁড়ি।
মেঘ বালিকা
ও মেঘ বালিকা
আমাকে একটা শান্ত শ্রাবণ বিকেল দিও
খুব করে ভিঁজবো!
চোখের কাঁজল মুছে
সুচনী ঘাসের উপর বৃষ্টি মাখবো
দু’হাত মেলে ভালবাসার স্পর্শ নিয়ে
ভারী আঁচল গায়ে জড়াবো।
বল মেঘ বালিকা,
তুমি আমার সেই বিকেল হবে
যার আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে।

কুঞ্জবনের সখা তুমি
রাধারমন বুলি জপি,
বৃন্দাবনের লীলা ভূমি
নৃত্যচারনের প্রেম গোপী,;
কোথায় রাধার ধ্যান মগ্ন?
যেথায় কৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গ,
যেথায় রাধার সোনার অঙ্গ
সেথায় কৃষ্ণের শাসন ভঙ্গ।
বিনিদ্র যাপন মোর বিভাবরী
সদাই তাহারে দেখি প্রাণভরি,
রূপের আগুণে যাই মরি মরি
দৈবে জড়ায় ধরে দিব্য হরি!

চল্লিশে পা দিয়ে-
নিজেকে বুড়ো ভাবতে শুরু করি
চোখের নীচে বলিরেখা,
শরীরের ওজন
সবসময় করোটিতে চিনচিন ব্যথা।
বয়স হলে এসবতো হবেই-
মাস্টার্স শেষে সরকারি চাকরি
এরপর জীবনে নতুন মানুষ
পরিবারের সংখ্যা বাড়া
আটপৌরে বাঙালি নারীর জীবন
এই গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ।
আর কি কিছু চাইবার আছে জীবনে?
স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ নেই
শুধু সন্তানদের ভবিষ্যৎ পানে চেয়ে থাকা
আচ্ছা, এই জীবনটাও কি হাস্নাহেনা হতে পারেনা?
মগজে কি যেন আছে!
জোস্না দেখলে আজও পাগল হয়ে যাই
নদীর সঙ্গে এখনও ছুটতে ইচ্ছে হয়
ঝুম বৃষ্টিতে আজও হাত বাড়াই
তাহলে তো এবয়সও হাস্নাহেনা!
লোকচক্ষুর আড়ালে
সূর্যাস্তে-
প্রস্ফুটিত
বিকশিত।

কিছুক্ষণ আগে শিমুলের সঙ্গে কথা হলো
কত যুগ পরে যেন এই দুই হাত তার স্পর্শ পেল;
আঙুলের ছোঁয়ায় রক্তিম লাল যেন আরও ফুটে উঠল-
মুহূর্তেই সবকিছু এলোমেলো
শাড়ির আঁচল, পেজা তুলোর মন
ঝুন ঝুন করে এক পায়ে বেজে যাওয়া তামার মলটিও খুলে গেল,
বুকের বাম পাশটা দাপ করে জ্বলে উঠলো
এত কাছে নিও না আমাকে- ছুড়ে ফেল
বাতাসের নাচুনী,
চুলের বিনুনি
সব কিছুই যেন অশনি।
নীরবে নামালাম কোল থেকে
মুক্তোর মালা কপোল বেয়ে ঝরলো,
প্রেম বা ভালবাসা কি এভাবেই হারলো?
‘না’- খুব গম্ভীর কণ্ঠে শিমুল শোনালে।
ক্ষত বিক্ষত বুক থেকে কেমন নরম তুলোর ফুল ফুটাই আমি,
শান্তির ঘুম আনতে চুপ করে তাঁর মাথার বালিশ হই
আমিতো শুধু আমার নই যে তোমার হবো;
আমি শুধু তোমাদের ঘুম হবো বলে নিজেকে বিলিয়ে দেই
তা বৈ আমার আমার অন্য কোন ইচ্ছে নেই;
আমি যেন রক্ত বুকে হাসতে পারি
আমি যেন তোমার সুখের প্রেম হয়ে জাগতে পারি।

One thought on “একগুচ্ছ কবিতা-ফরিদা রানু

  • প্রফেসর সুজা ফখরুল

    কবি ফরিদা রানু এর একগুচ্ছ কবিতা বাংলাভাষা ও সাহিত্যে যোগ করবে এক মৌলিক নতুন মাত্রা। কবির প্রতিটি কবিতা পাঠকের চিত্তে অসম্ভব নাড়া দিয়ে যায় এবং আবেগময় স্বত্তাকে জাগিয়ে তোলে তখন পাঠক এ-র মাঝে বোধের সৃষ্টি করে এমন ভাবে কবিতায় ব্যবহৃত শব্দমালাগুলো জীবন্ত ঝংকারে গেয়ে উঠে জীবনের গান। মনেহয়, এতো আমার কথা, আমার মনের কথা, আমার হৃদয়ে জমে থাকা তোমার জন্য মমতায় ভরা ভালোবাসায় জড়ানো আমার একান্ত অনুভূতির আমার আবেগের বাঙময় প্রকাশ। ব্যক্তিগত অনুভূতি সার্বজনীন অনুভূতি প্রকাশ ঘটায়। কেমন করে যেনো আমার কথাগুলো আর একান্ত আমার থাকেনা ; হয়ে যায় আমাদের কথা।
    কবি ফরিদা রানু র সৃজনশীল কাব্য প্রতিভার অনন্য বৈশিষ্ট্য তাঁর শব্দনিয়ে খেলার মুন্সিয়ানা। কতো সহজ শব্দে, কতো সাবলীলভাবে জীবানুভব জীবানুভুতির প্রকাশ করেন তিনি। শব্দ ব্যবহার, নিজস্ব শব্দগুচ্ছ তৈরি করেন কবি ফরিদা রানু তাঁর কাব্য। চিত্রকল্প, অনুপ্রাস, আবেগময় ইমেজের নিপুন ব্যবহার তাঁর কবিসত্তার এক অনন্য প্রকাশ। বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্য প্রেমী ও কবিতা অনুরাগী সমঝদার পাঠকগণ কবি ফরিদা রানুর কাব্য প্রতিভায় খুঁজে পাবেন এক শক্তিমান কাব্যলক্ষীকে।
    শুভেচ্ছা অভিনন্দন ও শুভকামনা নিরন্তর আমার প্রিয় কবি ফরিদা রানুকে। তাঁর কবিতার মতো তিনিও আমার প্রিয় মানুষ। গভীর অনুরাগে আমি পড়ি তাঁর কবিতা কারণ তাঁর কাব্যে ও কবিতায় আমি আমার হারানো স্বত্তাকে খুঁজে ফিরি

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *