গদ্য

গদ্য।। বাংলার পটশিল্প।। মনিরা আক্তার

মানুষের জীবনজিজ্ঞাসা এবং শিল্পজিজ্ঞাসা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শিল্পবোধ ও শিল্প মূল্যায়নের সাথে। কারণ এর সাথে সংযুক্ত মানুষের মূল্যবোধ। মূল্যবোধ এমনি এমনি তৈরী হয়না তা অনুশীলন করতে হয়। এই অনুশীলনের মাধ্যমেই মানুষ তার কৃষ্টিকে ধারণ ও বাহন করে। শিল্প, সভ্যতা, কৃষ্টি নিয়েই মানুষের মূল্যবোধ তৈরী হয়। এই মূল্যবোধই আবার মানুষের‘কালচার’ বা ’সংস্কৃতি’। শিল্পের বাস্তবতা হলো আমাদের চারপাশ। যা আমরা সবসময় দেখি।

আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলো একজন শিল্পী তাঁর শিল্পগুণে রাঙিয়ে তুলেন। সহিত্য.সংঙ্গীত,চারু ও কারুকলা সব শিল্পেই শিল্পীগণ প্রতিদিনের চারপাশের ঘটনাকে অবলম্বনকরে তারসাথে নিজের কল্পনার রস সংযোজন করে নতুন ঘটনার জন্ম দেন। যা মানুষের হৃদয়ে বিভিন্নভাবে নাড়া দেয়।

তবে একথা সবাই স্বীকার করবেন যে, শিল্প মানুষের আনন্দের জন্য, সে যে কোন বিষয়েরই হতে পারে। সমাজের অনেক সুখের গল্পের পাশাপাশি নির্মম কাহিনীও মানুষ বার বার পড়ে বা শুনে। কারণ ঐ চিত্রকল্পগুলো পড়া শোনা বা দেখার মাধ্যমে মানুষ সে বিষয়ের উপর নিজের মনের ভেতর আর একটা চিত্রকল্প তৈরী করে এবং তা দিয়ে নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তার রস আহরন করে। তা থেকে মানুষ কখনো ব্যাথিত হয় অবার কখনো আনন্দ পায়। দুঃখও একধরনের আনন্দ। পটশিল্পের শিল্পী যখন সুর করে সীতার অগ্নি পরীক্ষা এবং শ্রীরামচন্দ্র কতৃক তার নির্বাসনে বর্ণনা করেন শ্রোতা বা দর্শক তার কল্পনার মনে একটি চিত্র অনুভব করে যা অতি ব্যথিতের অনুভুতির। অতএব ঘটনার শিল্পবস্তু যাই হোক না কেন তা থেকে রস আহরন কারাই হলো রসিকের কাজ।

আলোচনার বিষয় বাংলার পটচিত্রশিল্প। পট শিল্প মুলত লোকায়ত চারুকলা শিল্প। পটশিল্প বাংলার এক প্রাচীন লোকসংঙ্গীতের ধারা। অন্তত আড়াই হাজার বছর পটচিত্র এ উপমহাদেশের শিল্প ও জনজীবনের অনন্দের উৎস, শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। পটচিত্র শিল্পীদের পটুয়া বলা হয়। পটশিল্প যা পৌরানিক ও লৌকিক গল্প গাঁথায় তৈরী। পট শিল্প সংগীত নির্ভর তাই একে পটুয়া সংঙ্গীত বলা হয়। পটুয়ারা লৌকিক ও পৌরানিক কাহিনি অবলম্বন করে বিভিন্ন ধরনের পটচিত্র অংকন করে এবং পটের কাহীনিকে ঘিরে গীত রচনা করে। এ সকল গীত তারা গ্রামে গ্রামে বাড়ী বাড়ী গিয়ে পট প্রদর্শনের সংঙ্গে পরিবেশন করেন। পটুয়া গীত বাংলার এক প্রচীন লোক সংঙ্গীতের ধারায় তৈরী। এই শিল্পে একটি ঘটনাকে কিম্বা দৃশ্যকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়। যেখানে সুকুমার প্রবৃত্তির বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়ে থাকে। যা কল্পনাকে প্রসারিত করে। এই শিল্পে জীবন চর্চাটাকে শৈল্পীকভাবে উপস্থাপন করা হয়। যা সামাজিক দিকভাবে কল্যাণমুখী। শিল্পকলার যে বিশাল গুন থাকা দরকার পটচিত্রশিল্পে আমরা তা দেখতে পাই। এই চিত্রকর্মে যেন সচেতনভাবেই সমাজ কল্যাণের দিকটি দেখা হয়েছে। পট শিল্পের একটি বড় গুণ এটি সামাজিক দায় বা দায়িত্ব হিসাবে কাজ করে।

বাংলাদেশের পটচিত্রের মধ্যে গাজীর পট ও পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্রের মধ্যে কালীঘাটের পট উল্লেখযোগ্য। মোটা কাপড়ের উপর রং তুলির সাহায়্যে কোন বিষয়ের ছবি বা দৃশ্য ফুটিয়ে তোলাই পট চিত্রের মূলকথা। ‘পট’ শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো কাপড়। সস্কৃত শব্দ ‘পট্ট’ বা পালি পট্টিকা থেকে এই শব্দটি এসেছে বলে যানা যায়। কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে জমিন তৈরী করে তার উপর রং তুলি দিয়ে চিত্র আঁকতে দেখা গেছে। কখনো কখনো এই চিত্র কাগজের উপরও করতে দেখা যায়। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিলো না তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের বাহক ছিলো। পট তৈরীর জন্য রঙ তৈরিতে পটুয়ারা বনজ বা খনিজ পদার্থের ব্যবহার করে রঙ তৈরী করতেন। চাল ভেজে কালো করে রঙ তৈরী করা হতো আবার পাকা লোকুচার ফল থেকে লাল হরিতকি ফল বা কাঁচা হলুদ সাথে মাটি মিশিয়ে হলুদ রঙ তৈরী করা হতো। একসময় পটচিত্র আঁকার রং তৈরীতে ইটের গুড়া, কাজল,লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি,অলতা,কাঠ কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। এ ক্ষেত্রে পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয়। আবার রঙয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল,হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহার করা হয়। পটুয়ারা হলো লোকশিল্পী বা গ্রামীনশিল্পী। পটচিত্রে সাধারণত গ্রামবাংলার প্রাচীন লোকশিল্পকে তুলে ধরা হয়। এতে কাহিনী ধরাবাহিক ভাবে চিত্রিত হয়ে থাকে। পটগীতির বর্ণনা সম্পূর্ণভাবে পটচিত্রের হুবহু অনুকরণে না হলেও চিত্রে যা থাকে গীতিকার চিত্রের ভাব ও ভক্তিরশের অভিব্যাক্তি সুরে সুরে তুলে ধরেন। পটচিত্রের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। কৃষ্ঞলীলা, রামলীলা, শীবের শঙ্খ পুরাণো প্রভৃতি সংগীতে বাংলার নারী-পুরুষ ও জীবনের এক নিখুঁত প্রতিকৃতি রচিত হয়ে থাকে। পটুয়া সংগীতে খুব সহজেই তুলে ধরা হয় বাঙালী হিšদু সমাজের ধর্ম, দর্শন ও পুরানের মূল তত্ত্ব গুলোকে। পটচিত্র এ উপমহাদেশের শিল্প ও জনজীবনের যেমন আনন্দের উৎস তেমনি শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির ধারা ও বিভিন্ন মঙ্গলানুষ্ঠানের অল্পনায়, পোড়ামাটির তৈরী পুতুল ও মনসা বা গাজীর পটচিত্র, মাটির সরা, ঘট ও পাখার উপর নানা রংঙে চিত্র সেই প্রচীন লোকায়ত শিল্পের ধারাই বহমান। যা আজও বাঙ্গালীর পালিত বিভিন্ন পার্বনে দেখতে পাওয়া যায়।

One thought on “গদ্য।। বাংলার পটশিল্প।। মনিরা আক্তার

  • অভিজিৎ হাজরা

    পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার অন্তর্গত নয়া গ্রামের পট চিত্র শিল্পীদের খ্যাতি এখন এখন গোটা ভারত সহ বিশ্বের নানা দেশে খুব খ্যাতি লাভ করেছে। অনেক ছোট বেলায় পট শিল্পীদের দেখতাম ব্যাগে পট নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পট দেখিয়ে ভিক্ষা করে বেড়াতে। তারপর ধীরে ধীরে তারা যেনো কোথায় হারিয়ে যেতে থাকলেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই শিল্পী দের এবং তাদের শিল্পকর্ম কে দেশ বিদেশে তুলে ধরলেন। নভেম্বরের মাসে ওই গ্রামে পটের মেলা বসে। দেশের বিদেশের বহু শিল্প অনুরাগীরা এখানে আসেন। আমি প্রথম 2021 সালে ওখানে যাই শুধু তাদের শিল্প কর্ম ও শিল্পের ব্যবহৃত প্রাকৃতিক উপকরণ দেখে মুগ্ধ হই তা না, আরো অবাক হৈ যখন জানতে পারলাম যে ওই এলাকার সমস্ত শিল্পীরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাদের পরবর্তী কালে নাম হয় “চিত্রকর” পদবী যোগে। উদাহরন স্বরূপ শেখ ইদ্রিশ হয়ে যান সুকুমার চিত্রকর নামে এবং এটাই হয়ে ওঠে ওনার পরিচয়। এনারা তাদের শিল্পকর্মে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক ও খনিজ উপাদানের ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান সমাজ কে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করছেন, তাদের শিল্প কর্মের নিরন্তর সাধনা ও গান দিয়ে যেমন রক্ষা করে আসছেন বাংলার চিরাচরিত ও প্রাচীন লোকসাহিত্য সংস্কৃতি কে অপর দিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির এ এক অনন্য নিদর্শন। এই সকল শিল্পীদের নিরন্তর সাধনার জন্যে তাদের জন্যই অভিবাদন।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *