গদ্য

কবিতা বিষয়ক গদ্য- আমার সঙ্গে দৃশ্যেরা থাকেন- ফারুক আহমেদ

প্রতিদিন আমি অনেক দৃশ্যের ভেতর দিয়ে যাই। প্রত্যেকেই যায়। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দৃশ্যের জগৎ থাকে। অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মতো মানুষ অনেক দৃশ্যের মুখের সঙ্গে পরিচিত হয়। আমার এসব দৃশ্যে থাকে- রিক্সা, বাস, ট্রাক, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক গাছের সমারোহ (যদিও এ সমারোহ ওদেরকে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিতে পারে না), নারী, বিকাল, জানালার পর্দা, বাতাস বা এমনি অজস্র শব্দ ও নিঃশব্দের আয়োজন। এর সঙ্গে ঘুরে ফিরে আসে শৈশবের বিকালগুলি, আসে সবুজ ধানক্ষেত, সরু খাল, দুপুরের পেটে ছুরির মতো বিদ্ধ হওয়া দোয়েলের শিস, সরিষার হলুদ ক্ষেত, শিশির ভেজা সকাল, আমার মা-বাবা, ছুটির ঘণ্টা, অনেকগুলো কিশোরীর যাতায়াত, বকুল ফুলের ঘ্রাণ, অপরাজিতার মুখ- সর্বাপুরি আমার ব্যক্তিগত যাদুঘরে দৃশ্যের অধিকার সর্বাধিক।

এসব দৃশ্যের কথা আসায় আমার মনে পড়ে যায় লাইব্রেরির সামনে থেকে ধীরে ধীরে চলে যাওয়া দুপুর, একজন সুন্দরীর হাসির বুলেট, ব্রেডের সঙ্গে মাখিয়ে খাওয়া কোন সকালের যাতায়াত, আমাকে মুগ্ধ করতে ব্যস্ত আমার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে সদ্য অতীত হওয়া এমন সব দৃশ্যও আমার কৈশোরের দৃশ্যের মতো নিজের ভেতর গভীর উদ্বোধনের জন্ম দেয়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা যখন পুরো শহরের বুকে আমাকে উগড়ে দিল, তখন মনে হলো, এভাবে একদিন আমার জীবন মৃত্যুর কাছে আমাকে উগড়ে দেবে। যৌবন পার করার আগেই আমি একজন বৃদ্ধের মতো অনবরত স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি এবং বার বার মনে হয় সবসময় আমার পাশে থাকুক এক টুকরো সবুজ, একটা হাসি, কিছু লাবণ্যময় কথা। এই স্মৃতিকাতরতা, এই প্রত্যাশা আসলে নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, কবিতার যাতনা বা এমনি সব বিষয়ের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনকে ভালবাসার নামান্তর। এ কবিতার তাড়নায় একজন যুবকের অসহায় আকুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমার ছোট্ট কবিতার জগৎ ঘিরে রেখেছে আমার প্রাত্যহিকতা। এ ক্ষেত্রে কবিতার ফর্ম- মাত্রা-ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদির আবশ্যকীয়তা দূরে রেখে অনায়াসে আমার আত্মার নির্মিত সৌধকে উচ্চারণ করতে চাই। সব সময় চাই আমার আত্মার উচ্চারিত বর্ণমালা বেরিয়ে এসে একেকটি পঙ্ক্তির অবয়ব গ্রহণ করুক। এতে যদি কোন দৃশ্যের জন্ম হয় তাহলে আমি আপ্লুত, যদি একটা উৎপ্রেক্ষার আগমন ঘটে তাহলে আমি বিহ্বল হয়ে ঘন ঘন, দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবীকে অনুভব করার চেষ্টা করি, একটা উপমা সুন্দরীর রক্তিম কপোলের থেকে আমার কাছে অধিক মনোহর ও প্রার্থনীয় মনে হয়। আমার মনে হয় আমি কবিতা সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করে পৃথিবীময় বিস্তৃত নিসর্গের মহারাজায় রূপান্তরিত হলাম। পাখিরা, মাছেরা আমার এ বিজয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। এরকম ভেবে ভেবে নিজের ভেতর তৃপ্তির ফোটা ফোটা দৃশ্য জমা করি। আর যারা আমার কবিতার জন্য উৎসবে মেতে ওঠে, তাদের জন্য পুনরায় টেবিলে প্রার্থনায় বসি। এ কবিতার চরণে আত্মাহুতি ছাড়া আর কী!

কিন্তু কেবলই কি দৃশ্য? পদ্মায় জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য স্রেফ দৃশ্য হয়ে ধরা দেবে আমার কাছে, তা কি করে হয়। আমার তো জলের বি¯তৃত ঢেউকে জ্যোৎস্নার প্রহেলিকা বলে মনে হয় আর জেলেদের জ্যোৎস্নার শিকারি। প্রতিদিন সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যেতে যেতে একসারি গাছকে মনে হয় পৃথিবীর তাবৎ অরণ্যের প্রতিভূ। এসব দৃশ্য আমার ভেতর নিদারুণভাবে খেলে, বার বার বৈঠা চালায়। একটা মফস্বল শহর, যেখানে আমি বড় হয়েছি, তা আমার কাছে পরম কবিতা হয়ে নাড়িয়ে দেয় মর্মমূল।

এভাবে মানুষের স্মৃতিতে যতো দৃশ্য থাকে, সেসব কিছু দিয়ে মানুষের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করি। আমার সত্তা যে সব দৃশ্যে ব্যথিত হয়, অন্যজনের সেরকম হয়; আনন্দবোধের বিপরীতে অন্যজনও আনন্দ বোধ করে- এরকমটা সত্য বলে মানি। কোন আপেক্ষিক ভাবনাই এর বাইরে আমাকে নিয়ে যেতে পারে না। সকলের সঙ্গে আমার আত্মার যোজন, বোধের যোজন।

কবিতার প্রসঙ্গ এলে দৃশ্যের সঙ্গে অনেকগুলো মুখও চলে আসে, সে সব মুখ কবি নামক যন্ত্রণা বহনকারী কিছু মানুষের। আমি জীবনানন্দের বিষন্ন মুখের সঙ্গে কি করে যেন বরিস পাস্তারনাকের মুখের সাদৃশ্য পেয়ে যাই। মেকি সব আয়োজনের ভেতর নিঃশব্দে টুপ টুপ করে বৃষ্টির আওয়াজ আমাকে দু’মুখের সম্মিলনে সহসাই চমকিত করে দেয়। অনুভব করি এ হলো আত্মকথনের মতো করে মানুষের সকল বিস্ময়-সৌন্দর্যের কথা বলে যাওয়া। বিনয় মজুমদার আমাকে শিখিয়ে দেয় গণিতের সঙ্গে কবিতার মিল মনে হয় কবি কবিতায় একটা সরল অংক তৈরি করছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই চকচকে মুদ্রার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহীদ কাদরীর নানা পঙক্তিমালা। অথচ মধুসূদনের নিনাদের মতো গম্ভীর স্বর আমি কিভাবে ভুলি। আর এমন সব আয়োজন মাথায় নিয়ে নিঃসঙ্গ গলি দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় ‘কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে/ হাওয়ায় হাওয়ায়/নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর।’ এইভাবে শেষ পর্যন্ত কবিতাকে, কবিতাদেবীর সঙ্গে আমার সংসারকে মনে হয় অমিতের সাজানো সংসারের মতো। যাকে প্রতিদিন নতুনভাবে সাজাতে হবে। কখনও পুরনো হবে না। যদি তাই হয়, তাহলে এ জীবনে যে এক আশ্বর্য দ্যুতির আভায় পার হয়ে যাবে তা ভেবে আমি আহ্লাদিত।

যা হোক, প্রতিদিনের আপাত দৃশ্যের বাইরে যে অন্য একটা দৃশ্যের জগৎ আমার ভেতর ঘুরে বেড়ায়, তাকে আমি কবিতার ভেতর স্থাপন করতে চাই; কবিতা বলেই। চাই অন্যরা সেটুকু অনুভব করুক। ভাবুক আমরা, মানুষেরা এভাবে ভাবি। আমার বালিশের নীচে চাপা পড়ে আছে যে নদী, তার কথা জানিয়ে দিতে চাই। এতে নিশ্চুয় বুঝতে সমস্যা হবে না একটা খরস্রোতা নদীর কত ক্ষমতা। ভাঙ্গাগড়া, উত্তাল-নিশ্চুপতা বা কত কত বিচিত্র তার রূপ। তেমনি একটা নদী আমার বালিশের নীচে চাপা পড়ে আছে- এ কথা সকলকে বলে রাখলাম।

আধুনালুপ্ত ‘দৈনিক আজকের কাগজ-এর জন্য আমার প্রথম কবিতার বই ‘কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস’ নিয়ে লেখা গদ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *