গদ্য।। কবিতার বৈকুণ্ঠে এক নির্মোহ পরিক্রমা।। শাহানা আকতার মহুয়া
তাঁর কবিতা মানেই যেন সময়ের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে, এক ইতিহাস থেকে আরেক ইতিহাসে হেঁটে যাওয়ার অভিলাষ। কবিতার অন্তর্নিহিত সত্যের সাথে সময়ের যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তা বারবার পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাঁর কবিতার কাছে।
বলছি কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কথা।
কবি হলেও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় দুলালের বহুমাত্রিক পদচারণা। বাংলা কবিতার মূলধারাকে শাণিত করছেন। কবিতাকে ভেঙেচুরে নতুনভাবে সৃষ্টি করতে চান তিনি। তাই তাঁর কবিতাগুলো একটা অন্যটার চাইতে আলাদা। একেকটি কবিতার স্বর একেক রকম। প্রতিটি কবিতা জ্বলজ্বল করে ভিন্নতর ব্যঞ্জনায়। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কবিতা তাঁর সময়ের অন্য যেকোনো কবির চেয়ে আলাদা। তাঁর কবিতা যে কেবল ভিন্ন স্বভাবের কথা প্রকাশ করে তা-ই নয়,বরং বলা যায় তিনি একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করেছেন।
প্রেম বিষয়ে তিনি যখন বলেন- “প্রেম আমার কাছে নেশার মতো, কবিতার মতো। ডুবে থাকি, ঘোরে থাকি” এবং এক মিনিট নীরবতা কবিতায় যখন বলেন- ‘তুমি কি ‘ভয়ঙ্কর’ ভালো লাগা আরেক রবীন্দ্রসঙ্গীত!/ খোলাজা নালা দিয়ে আসা বাতাসের বোন, বুনো ঘ্রাণ?’ … তা যেমন এক মায়াচ্ছন্ন ঘোর তৈরি করে পাঠকের মনে তেমনি মানব জাতির মুখে দুর্গন্ধ কবিতাটিও কি তীব্রভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায় ন।। (এক পাতিলের ভাত দুই থালায় / ভাই থেকে ভাই আলাদা, জাতি থেকে পৃথক প্রজাতি।)
কবিতা হচ্ছে জগতের অধরা মাধুরী। কবি এই মাধুরী তুলে এনে শব্দে-বর্ণে-ছন্দে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। মূর্ত করে তোলে শিল্পী যেভাবে গ্যালাতিয়ার ভেতরে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। পরিশ্রমী এবং একনিষ্ঠ দুলাল তেমনিভাবে প্রাণস্পন্দন আনেন তাঁর লেখনীতে। আবার একই সঙ্গে চান প্রেম ও বিরহ, যুদ্ধ ও শান্তি। কারণ কে না জানে যে যত বেশি প্রেমিক সে তত বেশি বিদ্রোহী।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত এক সত্যসন্ধানী কবি। মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ তাঁর কবিতা, তাঁর চেতনা কিংবা আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে। দূরে থাকলেও তিনি স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন নন- তাইতো তাঁর লেখায় যেমন পাওয়া যায় সোঁদা মাটির গন্ধ তেমনি সমসাময়িক নানা ইস্যু, অসঙ্গতি, টানাপোড়েন তীব্রভাবে ফুটে ওঠে তাঁর কলমের খোঁচায়।
কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কবিতালঙ্কার প্রসঙ্গে মনে পড়ল আচার্য ভামহ’র বিখ্যাত উক্তিটি—’কান্তমপি নির্ভূষং ন বিভাতি বনিতামুখ”- প্রেয়সীর মুখ স্বভাবকান্ত হলেও অলঙ্কার ব্যতীত সে মুখের সৌন্দর্য ফোটে না। কাব্যে তাই অলঙ্কারের প্রয়োজন আছে বৈকি। সেদিক থেকে ব লা যায় তাঁর কবিতা রূপকল্প, চিত্রকল্পের সমাহারে সমৃদ্ধ। কোনো গৎবাঁধা ছন্দে তিনি কবিতাকে ফ্রেমবন্দি করেননি। উপমা, উৎপ্রেক্ষার যথাযথ ব্যবহার করলেও খুব বেশি অলঙ্কারে ভারি করে তোলেননি। কবিতাকে শব্দ ব্যবহারে তাঁর সমকাল মনস্কতা নিবিড় পাঠককে সচকিত করবেই- ।
‘পরশু থেকে আমার ছায়া নিখোঁজ, ছায়াসঙ্গী আমার সঙ্গে নেই,
কি অদ্ভুত ঘটনা; তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা!
তাহলে কি ত্যাগ এবং পদত্যাগ করে পালিয়েছে’। (প্রেসক্রিপশন)
কিংবা, “ডংরি আর তেরেনা এক বিছানায় ঘুমায়, ভিনদেশে / অতীতের মতো বর্তমানও কি একটা ভিনদেশ?” (গাছপান)
যত যাই বলি না কেন, যেভাবেই বলি না কেন- এটা তো মিথ্যে নয় যে একজন কবি প্রকৃত অর্থে একজন স্রষ্টা। যখন একটি কবিতা সৃষ্টিকর্ম চলে তখন কবি একজন অসহায় আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে অস্থির পোয়াতি মহিলার মতো। তার সৃজনশীল স্বেচ্ছাচারিতা তার জীবনেও প্রতিফলিত হয়। এ স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তাকে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়। যদিও এ স্বেচ্ছাচারিতাই তাকে মৌলিক ও আলাদা করে তোলে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন-
“কে কবি— কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন”
কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল লেখনীর সাথে যে গাঁটছড়া বেঁধেছেন তা তাঁর স্বকীয়তায়, নান্দনিকতায়, প্রেমে এবং দ্রোহে আরো জ্বলজ্বলে হয়ে উঠুক।