গদ্য

কথাশিল্পী রাহাত খান // মণীশ রায়


বুকের ভেতর গভীর আতিশয্য, সরকারি কলের মতো আবেগ যেখানে সামান্য সুযোগে ঝরঝর করে ঝরতে চায়, সেখানে নির্মোহ-নিরপেক্ষ হয়ে দুইচারটে বাক্যবন্ধ রচনা করা সত্যি দুরূহ এক কাজ !
কথাসাহিত্যের বোদ্ধারা বলেন, সরাসরি কোনো অভিজ্ঞতা নাকি সাহিত্য রচনায় খুব একটা কাজে দেয় না। এগুলো কেবল শীতের ঝরা পাতার মতো ; খালি জমিতে জমতে জমতে এক সময় সার হয়ে যায় । সেখান থেকে নানা অদলবদলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একটা-দুটো গল্প- উপন্যাস তৈরি হয় ; মাটির নিচে অনেকদিন পড়ে থাকবার পর জীবাশ্ম যেমন , তেমনি।
কিন্তু রাহাত খানের ৬৬তম জন্মদিনের ঘরোয়া আয়োজনটিতে যোগ দিয়ে আমার বারবার একথাটাই মনে হয়েছে , তিনি যার ভেতর একবার সেঁধিয়ে গেছেন তার পক্ষে আবেগাআপ্লুত না হয়ে টান টান উদাসীন থাকা একেবারেই কঠিন এক কাজ। ফিরতি পথে ফের মনে হল, এই আতিশয্যের নামই বোধকরি ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধাবোধ, যা কারো জন্যে তোলা থাকে চিরকাল, সুযোগ পেলেই তা বের হয়ে আসতে চায় , সমস্ত অবদমন আর অবরোধের সুতো ছিঁড়ে !
একজন মেধাবী ও বলিষ্ঠ লেখকের প্রতি আমার এই ভালো লাগার ঘোর প্রথমত লেখা দিয়েই শুরু। ব্রাম্মণবাড়িয়ার পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে ‘দিলুর গল্প’ পড়তে গিয়ে যে কিশোরের ভেতর অজানা আনন্দের ঘোর তৈরি হয় , পরবর্র্তীকালে পরিণত বয়সে এসে ছোটোগল্প ‘আমাদের বিষবৃক্ষ ’ কিংবা ‘চুড়ি ’ পড়ার মধ্য দিয়ে তা আরো গভীর ও দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যায়। হয়তো এভাবেই ভালো লাগার লেখক জন্ম নেন পাঠকের হৃদয়ে ! প্রথম প্রেমের মতো ‘ দিলুর গল্প’পাঠের স্মৃতিটুকুই সম্বল , সেখানে বিচার বিশ্লেষণের খুব একটা জায়গা নেই , বিশেষ করে সাদা-সরল কিশোর মনের আঙ্গিনায়। কিন্তু ‘আমাদের বিষবৃক্ষ’ পড়ে তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছে, এ লেখককে কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে গল্প ষাটের দশকে বিরল কোনো গল্প নয়। এপার বাংলা ওপার বাংলার অনেক প্রথিতযশা লেখক এ বিষয়টিকে ছুঁয়েছেন। বাংলা মুলুক ছাড়াও হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যেও এ ধরনের গল্প লেখা হয়েছে প্রচুর। তাই এ জাতীয় গল্প লেখায় যথেষ্ট সতর্ক ও যত্নশীল হতে হয় লেখককে । নইলে এটি একপেশী হয়ে যেতে বাধ্য। লেখক রাহাত খানের কলমে এ কাজটি সার্থকতার সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছে। নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তুলে আনতে গিয়ে চরিত্রগুলো কোথাও থমকে পড়ে নি । স্পষ্ট ও দৃঢ় প্রতিটি চরিত্র। ঘটনা ও চরিত্রের ক্রমবিকাশের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যকে পাঠকের সামনে অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াসটি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদের সঙ্গে স্মর্তব্য। কোনো একরৈখিক গল্পের মতো নয় এটি, কদিন আগে পড়েও মনে হয়েছে, এটি সবদিক দিয়ে একটি আধুনিক ছোটোগল্পের নমুনা। সাবলীল গদ্য এবং চরিত্রচিত্রনের বিশ্বস্ততা শুধু নয়, গল্পটি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নানামুখী চিন্তা এসেও জড়ো হয় পাঠকের মনে, যা আধুনিক ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট । কোনো গল্পের পাঠশেষে যে লেখক পাঠককে অন্তত পাঁচমুখী চিন্তার বেড়াজালে জড়াতে পারেন , তিনিই আদর্শ লেখক – তাতে কোনো সন্দে থাকবার কথা নয়। একদা নিকোলাই গোগলের বিখ্যাত গল্প ওভারকোট পড়ে তুর্গেনিভ বলেছিলেন ‘ওই অল স্প্রিং ফ্রম গোগলস ওভারকোট’, তো সেরকম করে না হলেও বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মতো অনেক অনুজ গল্পকার এরকম দুচারটি গল্প পড়েই শিক্ষিত হতে চেয়েছি।
‘চুড়ি’ গল্পটিও নারী চরিত্র বিশ্লেষণের এক চমৎকার প্রতীকী উদাহরণ। টুং –টাং চুড়ির শব্দ দিয়ে যে নারী গভীর রাতে জানান দিয়ে যায় সে প্রেমে পড়েছে, তা সূক্ষ্ম জীবনবোধেরই বহিঃপ্রকাশ । এভাবেই এক-একটি গল্প রাহাত খানের বিচিত্র জীবনবোধের উদাহরণ হয়ে থাকে। অনেক শক্তিমান লেখকেরও কিছু গল্প হঠাৎ চোখে পড়ে যায়, যা পাঠ করবার পর , বিশেষ করে প্রেমের গল্পগুলোর বেলায়, মাঝে মাঝে মনে হয় , যিনি লেখক তার এ সম্পর্কে স্বকীয় বোধ বা বিশ্বস্ততা বা উভয়েরই অভার রয়েছে। কিন্তু একথা রাহাত খানের বেলায় কিছুতেই বলা যাবে না। ‘এক প্রিয়দর্শিনী ’ শিরোনামের উপন্যাসটির ( বড় গল্প বা নভেলা বললেই ভালো হয়) উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। বিদেশে ট্রেনিং নিতে গিয়ে কামাল খান তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার ছায়া দেখতে পান এক বিদেশিনীর মাঝে এবং তারা ঘনিষ্ঠ হন। প্রেমের এই অবয়বটি কেবল আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী কথাকারের পক্ষেই আঁকা সম্ভব, প্রেমোপাখ্যানের সরল রাস্তায় না হেঁটেও যে নিটোল গল্প নির্মাণ করা যায় তা ‘এক প্রিয়দর্শিনী’ পাঠ না করলে বুঝানো মুশকিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বসে ‘হে শূন্যতা’-র মতো উপন্যাস লিখেছেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি মর্মান্তিক দৃশ্য রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দল পাকানোর অসম্ভব বিশ্বস্ত এক চিত্র । আজকের এই নিদারূণ সময়ে বসে যার আঁচ আমাদের সবার গায়েই লাগছে !
রাহাত খানের জীবনবোধ নানা উপকরণে ঋদ্ধ ও নির্মোহ। তাঁর হাত দিয়ে নানা চরিত্র উঠে এসেছে। কখনো স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট , কখনো আত্মনির্বাসিত কোনো তুলি শিল্পী, কখনো কোনো গ্যাং-স্টার, কখনো সতত বিদ্ধ ও রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধা, আবার কখনো বা মুক্তিযুদ্ধে নিহত কোনো রাজাকার তনয় । তাঁর গল্প পড়ে কখনো কিছু আরোপিত বলে মনে হয় না। বরাবরই জীবন ঘেঁষা কথোপকথন, কোথাও স্টাইল জীবনকে ছাড়িয়ে যায় না। অলংকার প্রয়োগেও তাঁর গল্পের কোথাও জোরাজুরি নেই। ভাষার ওজস্বিতা প্রমাণ করতে মাত্রাতিরিক্ত উপমা উৎপ্রেক্ষা বা চিত্রকল্প-রূপক মেশানো কঠিন সব বাক্যশৈলী প্রয়োগ রাহাত খানের স্টাইল নয়। তাঁর গদ্য চেষ্টাহীন , অলংকারের প্রয়োগও একেবারেই অনায়াসলব্ধ। ফলত তাঁর গল্প পড়ে ক্লান্ত হবার কোনো সুযোগ নেই । গদ্যকে পশ্চিমী ধাঁচে স্মার্ট করে তুলতে রাহাত খান প্রায়ই ইংরেজি শব্দের আকছার ব্যবহার ঘটিয়েছেন। এ ধরনের প্রয়োগ মাঝে মাঝে চমকে দিলেও কিংবা তরুণমতি পাঠককে আনন্দ যোগালেও মাঝে মাঝে কারো কাছে স্থূল বলে মনে হতে পারে । চরিত্রের গভীরে ঢুকতে এবং জীবনের ব্যাখ্যাটুকু আরো স্পষ্ট ও ক্ষুরধার করতে গদ্যভাষাটি যতটা গম্ভীর হওয়া আবশ্যক তা হয় নি, তারল্য এসে গেছে , যা বড় জীবনকে ছুঁয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট নয়।
হয়তো কোনো কোনো উপন্যাস পাঠ করে আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছি, হতাশ হয়েছি খানিকটা, ত্বড়িৎ সমাপ্তির কারণে বিরক্তি জন্মেছে । কিন্তু হাসতে হাসতে, কথা বলতে বলতে, সাংবাদিকতার ব্যস্ততাময় নিত্যনৈমিত্তিকতা আর উচ্ছ্বাসময় জীপন-যাপনের ভেতর নিরবধি বাস করে যাঁর উপন্যাস কিংবা গল্প লেখার অভ্যেস – তাঁর তো কিছু ব্যত্যয় থাকবেই। এতো হেলাফেলাভাবে লিখে যাবার নিত্য অভ্যেস সম্ভবত আমাদের দেশের আর কোনো লেখকের নেই।
রাহাত খান মূল ধারার কথাকার । এদেশে যা কিছু মঙ্গলময় ও কল্যাণকর তিনি তার সঙ্গে ছিলেন। আমাদের গর্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপিত মানুষ রাহাত খান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উত্তরাধিকার তাঁর কাঁধে । স্বাভাবিক কারণেই তাঁর প্রতি পাঠকের প্রত্যাশা বেশি হতেই পারে।
লিও টলস্টয় একবার বলেছিলেন, মহৎ মানুষ না হলে নাকি মহৎ সাহিত্য হয় না। এ কথার বাস্তবতা আজকের বাণিজ্যিক জমানায় অনেকখানি অচল, একথা বললে সম্ভবত ভুল হবে না। মহত্ত্বগুলো দুর্নীতি ও নীতিহীনতার এ যুগে বরাবর মাথার উপর দিয়েই চলে যায় ; তা হোক, তারপরও মানুষের প্রতি মানুষের একটুখানি সহানুভূতিশীল বা সংবেদনশীল বা স্পর্শকাতর থাকা খুব বেশিকিছু নয়। সাধারণ মানুষ সাহিত্যে বা ব্যক্তিজীবনে এর প্রতিফলন এখনও দেখতে চান !
রাহাত খানের ভেতর এই গুণটুকু রয়েছে, হাজারটা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও। একথা স্বীকর না করলে সম্ভবত পুরো রাহাত খানকে মেলে ধরা যাবে না। নানা দুর্বিপাকে পড়ে যারাই , বিশেষ করে তরুণণ লেখককুলের কেউ , রাহাত খানের কাছে এসেছেন বিভিন্ন সময়ে , সাহয্যের স্বতঃস্ফূর্ত ও দ্বিধাহীন হাত এগিয়ে এসেছে সবার আগে। আমার নিজের অভিজ্ঞতাও এক্ষেত্রে রয়েছে। যখনি কোনো সংকটে পড়ে লেখক হিসাবে তাঁর কাছে গিয়েছি, হউক বা না হউক, টেলিফোনের রিসিভারটি হাতে তুলে নিয়ে বলে উঠেছেন,‘ বলতো, কাকে বলতে হবে?’ অবশ্যই একে সততা হিসবে চিহ্নিত করা যায় !
এই মমত্ব কোথায় পাবো? যাঁর লেখা পড়ে একদিন ভালো লাগতে শুরু করে এবং পরিচিত হবার পর ব্যক্তিত্বের তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতায় কাছে টেনে আধুনিক জীবনবোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ হাত ধরে শিখিয়েছেন নিজেরই অজান্তে , তাঁকে যে-কোনো দুঃসময়ে ভালবেসে আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কি কোনো উপায় থাকে ?
রাহাত খানের ৬৬তম জন্ম দিনে তাঁকে এদেশের সকল মননশীল লেখকের পক্ষ থেকে ভালবাসা ও শুভেচ্ছা। একই সঙ্গে একাধিক জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত দায়িত্বশীল এই লেখকের প্রতি অনুরোধ, প্লিজ , আপনার চল্লিশ বছরের সাহিত্য অভিজ্ঞতার অর্জন দিয়ে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখুন , যা ‘হে অনন্তের পাখি’-র মতো নয়, ‘জোহরার বাড়ি’-ও নয়, ‘মধ্যমাঠের খেলায়াড়’ কিংবা ‘ছায়াদম্পতি’ নয়, একেবারেই ভিন্নরকম এক গল্প, যেখানে শুধু আলোর চারপাশের মানুষ নয়, আলোর পরিধির অনেক দূরে যাদের বসবাস, তারাও কথা কয়ে উঠবে, নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যাদের দিন ও রাত্রি কাটে তাদের কথাও, যা পাঠ করে আমরা আমাদের অপহৃত ভালবাসা ও প্রেম ফেরত পাবো এ দেশের প্রতি , সমাজ ও জাতির প্রতি এবং সর্বোপরি বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির প্রতি।
এই ভালবাসা ও অধিকার অপনার প্রতি আমাদের রইলো। থাকবেই।
( কথাশিল্পী রাহাত খানের ৬৬তম জন্মদিনের জন্য লিখিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *