কবি কাজী নজরুলের জীবনে নার্গিস।।গদ্য
লেকক- আজহারুল ইসলাম আল আজাদ
স্নেহ ভালবাসা প্রেম-প্রীতি,রাগ-অনুরাগ,
বিরাগ,বিরহ ,মায়া ও মমতা, দুঃখ, কষ্ট হাসি কান্নার মাঝে মানব জীবন শুরু আর এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই মানব জীবনের অবসান। এ সমস্ত গুনাবলী নিয়েই মানবের সরণী গমন। কেউ আসে কেউ চলে যায় -১৮৯৯ খ্রিঃ ২৪ শে মে(১১ জৈষ্ঠ্য ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে পিতা ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুনের গৃহে জন্ম গ্রহন করেন এক শিশু। তাঁর নাম রাখা হয় নজরুল ইসলাম।জীবনের প্রথম প্রহর কেটে যায় তাঁর অনেক কষ্টে ও দুঃখে। গ্রামের লোকজন তার নাম রাখেন দুখু মিয়া। নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে উপরোক্ত গুণাবলীর অধিকারী থাকাই স্বাভাবিক। ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। কিন্তু তিনি শিক্ষাঙ্গনে টিকতে পারলেন না। আট বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা গেলেন।নিজের কাঁধে পড়ল ভরন পোষনের দায়িত্ব। কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন, আল্লাহ কাউকে অনাহারী রাখেন না। তিনি কাজে নিয়োজিত হলেন ফলে তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। চায়ের দোকানের কাজ নিলেন কিন্তু সেখানেও মন টিকলো না। বাবা যে কাজ করতেন সে কাজে যোগ দিলেন। সে কাজ কবিকে ভাল লাগেনা। আবার চলে এলেন চায়ের দোকানে সেখানে পরিচয় হল এক মিলেটারীর সাথে। তিনি তার লেখা-পড়ার দায়িত্ব নিলেন। তাঁর সাথে তিনি চলে গেলেন।৭ম শ্রেনিতে ভর্তি হলেন কিন্ত সেই মিলেটারী ট্রান্সফর জনিত কারণে অন্যত্র চলে গেলেন নজরুল আবারও নিজ এলাকায় চলে এলেন ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেন। তিনি অভাবের কারনে যোগ দিলেন বাঙালি প্লাটুনে। সেখানে আড়াই বছর কাজ করার পর ছাটাই হলেন। চলে এলেন নিজ এলাকায়। কি করবেন স্থীর কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না।।লেটো গানের দলে যোগ দিলেন। শুরু হল তার সাহিত্য চর্চা। তিনি দেশের হালচাল ও অসম অবস্থা দেখে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। তিনি অসংখ্য কবিতা গল্প প্রবন্ধ নাটক একাংকিকা, উপন্যাস রচনা করলেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ছন্দ হিল্লোল, ভাঙার গান, দোলন চাপা,ছায়ানট, কুহেলিকা, ইত্যাদি।
নজরুল হয়ে উঠলেন তারুন্যের কবি ও প্রেমের কবি।
তবে তাঁর জীবনের প্রেমের ঘটনা কত যে বেদনাবিধূর তা’বলতে গেলে ব্যপক সময়ের প্রয়োজন। তাঁর প্রেমের উপাখ্যানে সফলতা ও ব্যর্থতা দু’টোই আছে। কবি কাজী নজরুলের জীবনে প্রেয়সীর প্রণয় যেমন তাঁর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে ঠিক তেমনি মহীয়ান হতেও সহায়তা করেছে। প্রথম প্রণয় সম্পর্কে কবি লিখলেন-
“তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা
এইটুকু হোক্ সান্ত্বনা মোর, হোক্ বা না হোক্ দেখা |”
১৯২০ সাল। কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর কবি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদে অবস্থান করেন। আকবর আলী খানের সাথে দেখা হলে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার
নিভৃত এক অজপাড়াগ্রামে আকবর আলীর সাথ চলে আসেন । দৌলতপুরে এসে কবি তাঁর স্বভাব সুলভ গান গেয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, হো হো করে অট্টহাসি হেসে জয় করলেন খান পরিবারের ছোট-বড় সবার মন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ঘিরে ধরল কবিকে। কবি ছোটদের উদ্দেশ্য করে লিখলেন ‘হার মানা হার’ কবিতা:
তোরা কোথা হ’তে কেমনে এসে
মণি-মালার মত আমার কণ্ঠে জড়ালি!
আমার পথিক-জীবন এমন ক’রে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ ক’রে বাঁধন পরালি॥
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব ক’রে হেসে
তা’রা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে
তোরা কেমন ক’রে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে।
ঐ কচি বাহুর রেশমী ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
তোরা চলতে গেলে পায়ে জড়াস্,
না’ ‘না’ ব’লে ঘাড়টি নাড়াস,
কেন ঘর-ছাড়াকে এমন ক’রে
ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি॥’
এই নিভৃত পল্লীগ্রাম দৌলতপুরে কবি হাসি-আনন্দে কাটালেন তিন-চার মাস। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন খান পরিবারের সঙ্গে। বলতে গেলে পরিবারের আপনজন হয়ে ওঠেন কবি। আলী আকবর খানের এক ভাইয়ের মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের সঙ্গে নার্গিসের ভাই মুনশী আবদুল জব্বারের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়। এই বিয়েতে নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের প্রথম পরিচয় ঘটে।
নজরুল খানবাড়ির পুকুর পাড়ে বসে মনের আনন্দে বাঁশের বাঁশিতে সুর তুলতেন। সুরের লহরীতে পশু পাখি আকাশ বাতাস দুলে উঠে।এক নিশুতি রাতে নজরুলের বাঁশের বাঁশির সুর শুনে ষোড়শী নার্গিসের মনে ঘরে রয়না সৃষ্টি হয় সারা দেহে কম্পন। হৃদয়ে জাগে দোলা, বুকে জাগে স্পন্দন। নার্গিস নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কৃষ্ণের জাদুকর মন ভোলানো বাঁশির সুরে যেমনি ভাবে রাধা আত্মহারা হয়েছিলেন, তেমনিভাবে নার্গিসও নজরুলের বাঁশির সুরের মূচর্ণায় বিমোহিত হয়েছিলেন । নজরুলের প্রেম কাননে ফোটে নার্গিস ফুল। প্রেমিক কবি প্রেমময় রূপসী প্রেয়সীর মনের গোপন কথা ব্যক্ত করলেন নিজের লেখা ‘কার বাঁশী বাজিল’ কবিতায়:
কার বাঁশি বাজিল
নদী-পাড়ে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল
কার বাঁশী বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল ক’রে সুরে সুরে
এত ক’রে ঝুরে’ ঝুরে’
কে আমায় যাচিল?
পুলকে এ-তনু-মন ঘন ঘন নাচিল
ক্ষণে ক্ষণে আজি লো কার বাঁশী বাজিল?
কার হেন বুক ফাটে মুখ নাহি ফোটে লো!
না-কওয়া কি কথা যেন সুরে বেজে ওঠে লো!
মম নারী-হিয়া মাঝে
কেন এত ব্যথা বাজে?
কেন ফিরে এনু লাজে? (আংশিক)
কবি নজরুলের জীবনে এক বিচিত্র অধ্যায় কাটে দৌলতপুরে। এখানে এসেই নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের পরিচয় হয়। সেই পরিচয় সূত্র ধরে ঘটে প্রেম তারপর প্রণয়। আর এই প্রণয় পরিণত হয় পরিণীতায়। যৌবনে কবি নার্গিসের প্রেম-পরশে হয়েছিলেন আবিষ্ট। বাঁধন-হারা কবি বাঁধা পড়েন নার্গিসের মায়ার জালে। তাঁরই আভাস কবির ‘মানসবধূ’ কবিতা।
এ বিশ্ব-নিখিলের সকল শুভকাজে যাঁর প্রসন্ন কল্যাণ-আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েচে, সেই পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার করুণাধারা শ্রাবণের ধারার মতই ব্যাকুল বেগে আজ আমার ঘরে-আমাদের মুখের ’পরে বুকের ’পরে ঝরে পড়চে; তাঁর কল্যাণ-ভারাতুর আনত আঁখির সু-নিবিড় চাওয়া কেমন এক সুধা-করুণ আশীষে ছেয়ে ফেলচে!
শিশির-নত ফুলের মতই আজ তাই আমার সকল-প্রাণ-দেহ-মন তাঁর চরণ ধুলার তলে লুটিয়ে পড়েচে। তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নিচে আমার মাথা নত ক’রে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে:-
আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নি নার্গিস-আ’সার খানমের বিয়ে বর্দ্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে বিপুল গৌরবান্বিত, আয়মাদার, জমিনদার মরহুম মৌলবি কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ-বিশ্রুত পুত্র মুসলিম-কুল-গৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’-কবি দৈনিক নবযুগের ভূতপূর্বক সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাঙলার এই তরুণ সৈনিক-কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন ক’রে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই। এই-আনন্দ-ঘন চির-শিশুকে যে দেশের সকল লেখক লেখিকা সকল কবি বুকভরা ভালোবাসা দিয়েছেন, সেই বাঁধন-হারা যে দেশ মাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে বসেচে, এর চেয়ে বড় পরিচয় তাঁর আর নেই।
আপনারা আমার বন্ধু, বড় আপনার জন। আমার এ গৌরবে, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ ক’রে আমার-এ কুটীরখানিকে পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট ক’রে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ।
এমন আচমকা না-চাওয়া পথে কুড়িয়ে-পাওয়া যে সুখে আমার হৃদয় কানায় কানায় পুরে উঠেচে, আপনাকেও যে এসে তাঁর ভাগ নিতে হবে। এদের পাশে দাঁড়িয়ে, মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ-ভরা আশীর্বাদ করতে হবে! আর, একা এলে তো চলবে না, সেই সঙ্গে আপনি আপনার সমস্ত আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকেও আমার হয়ে পাকড়াও ক’রে আনবেন এ মঙ্গল-মধুর দৃশ্য দেখাতে।
বিয়ের দিন আগামী ৩ আষাঢ় শুক্রবার নিশীথ-রাতে। নিশীথ-রাতের বাদল ধারার মতই আপনাদের সকলের মঙ্গল-আশীষ যেন এদের শিরে ঝরে পড়ে এদিন!
আমি আজ তাই জোর করেই বলচি, আমার এত বড় চাওয়ার দাবির অধিকার ও সম্মান হ’তে-আপনার প্রিয় উপস্থিতি হ’তে আমায় বঞ্চিত ক’রে আমার চোখে আর পানি দেখবেন না। আরজ-
দৌলতপুর, ত্রিপুরা। বিনীত
২৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৮ বাং আলী আকবর খান
বিয়ের খবর প্রকাশিত হয় পত্রপত্রিকায়..
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বন্ধুসুলভ কথায় লেখেছিলেণ ‘সে তো দৌলৎপুরের দৌলৎ’। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী সম্বোধন করলেন ‘দৌলৎপুরের দৌলৎখানার শাহজাদী’। সাংবাদিক আবদুল গফুর জালালী লিখলেন ‘ধন্য দৌলৎপুরের দৌলৎখানা’ প্রমুখ শিরোনামে বিভিন্ন লেখা।
নজরুল-নার্গিসের বিয়েতে লেখা হয় কাবিননামা। কবির মানস বধূ নার্গিসকে জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে পাবার মুহূর্তে বেজে ওঠে এক অশনি সংকেত। কাবিননামায় লেখা হয়েছিল বিয়ের পর নার্গিসকে নজরুল দৌলতপুর থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। নজরুলকে ‘ঘর জামাই’ হয়ে নাকি চিরদিনই থাকতে হবে দৌলতপুরে। কবি নজরুল ছিলেন পৌরুষদীপ্ত এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। ‘ঘর জামাই’ হয়ে শ্বশুর বাড়ি দৌলতপুরে থাকা কবির ব্যক্তিত্বে হানে চরম আঘাত। এতে কবি তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তবে সামাজিক মান-মর্যাদা সর্বোপরি ভালোবাসার মানস প্রিয়তমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে বসলেন বিয়ের পিঁড়িতে। ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয় সম্পন্ন।
বাসর রাত। নীরব-নিথর স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। জেগে আছে রাতের চাঁদ-তারা। আবার সে চাঁদ-তারাও আষাঢ়ের মেঘমালার সাথে আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলায় নিমগ্ন। দূর-বহুদূর থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসে রাত জাগা শুকসারির অস্ফুট সুর : ‘সুখ না দুখ’?
নজরুল-নার্গিসের যুগল-মিলন। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে দুজনার মাঝে মধুর আলাপন। এই প্রেমময় শুভলগ্নে-শুভক্ষণে হঠাৎ আষাঢ়ের কালো মেঘের ধূপছায়া ফেলে দুজনার হৃদয়াকাশে। দুজনার মাঝে শুরু হয় বাক-বিতণ্ডা। সে উত্তপ্ত রেশ মুহূর্তের মধ্যে তিক্ততায় পৌঁছে চরমে। আষাঢ়ের কালো মেঘ যেন কঠিন বজ্র-ঝড়ে রূপ নেয়। কবির চাঁপা ক্ষোভ ধুম্রজালে ছেয়ে যায়।
দুখু মিয়া তখনও নজরুল হয়ে ওঠেননি। দুখু মিয়ার দুঃখের অমানিশার ছদ্মাবরণে ঢাকা নজরুল। ছন্নছাড়া, বাঁধন-হারা দুঃখ ভরা জীবনতরীর এক দুর্দিনের যাত্রী। তবে নজরুল দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হলেও তাঁর আভিজাত্যকে ঢেকে দিতে পারেনি দুঃখের কালোছায়া। ‘ঘরজামাই’ হয়ে থাকার কথা শুনে কবি দুঃখে ক্ষোভে, ক্রোধে যেন ফেটে পড়লেন। নববধূ নার্গিসকে দৌলতপুর থেকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন কলকাতায়। কবি-বধূ নার্গিস বয়সে ষোড়শী অনূঢ়া। আর নজরুলও তখন সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রেখেছেন। ছিন্নমূল বাউন্ডুলে কবিকে বুঝে উঠতে পারেননি নবপরিণীতা কবি-বধূ নার্গিস আ’সার খানম। নাম ঠিকানা বিহীন বাঁধন-হারা এক কবির সঙ্গে ঘর বাঁধলেও নার্গিস অজানা-অচেনা অনিশ্চিত পথে সেদিন পা বাড়াতে পারেনি।