উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৪র্থ-পর্ব
ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েক মুহূর্ত হতবাক চারজন। একে একে অপরের দিকে তাকায়। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে ওদের অনুকূলে। কিন্তু সারা রাত কেন গাড়িতে বসিয়ে রেখে ভোরের আলোয় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, তাও বাসা থেকে অনেক দূরের কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। চারজনার মধ্যেই ঘুম জড়ানো, শ্লেষ্মা মাখানো গরায় নজরুল কবীর কনস্টেবলকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে সামনে পা বাড়ায়। বাকি তিনজনও অনুসরণ করে নজরুল কবীরকে।
ঘুম ঘুম চোখে কমলাপুর থেকে হেঁটে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে উলন মসজিদ মেসে যখন পৌঁছায়, তখন সকাল। চারদিকে ভোরের কুসুম-কুসুম আলো। চারজনই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
হঠাৎ আজ, প্রায় আঠাশ-ত্রিশ বছর পর সেই ঘটনা মনে পড়ে টুনটুনি অধ্যাপকের। সেসব জায়গা, রাস্তা, মেস, চায়ের দোকানদার কি এখনও আছে! মনে হয় না। চারপাশের জীবন কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যেসব জায়গাও আজ আর অবিকল নেই। যদি সময় পাওয়া যায়- তাহলে একবার রামপুরা, উলন রোড, মসজিদ মেস ঘুরে আসবে-ভাবেন অধ্যাপক টুনটুনি। বুকের গভীরতম এলাকা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। তিনি স্মৃতির ভারে কেমন একটু আক্রান্ত হলেন- বাসায় না ফিরে তিনি চীন-বাংলাদেশ বুড়িগঙ্গা মৈত্রী সেতুর দিকে ডানা মেলে দিলেন।
ব্রীজের উপর এসে অনেক্ষণ আকাশে ভাসলেন, ভেসে থাকলেন বাতাসে! দু’দিকে ডানা দুটো প্রসারিত। নিচে বুড়িগঙ্গার টলমল পানি। পানির উপর ঝিরঝিরে ঢেউ। বাতাস বইছে মৃদু মৃদু। দূরে মিটি মিটি আলোর কোটি কোটি চোখ। গাঢ় সবুজ কুয়াশাময় দৃশ্যাবলি-দুটো চোখে এসব দৃশ্য দেখে অবাক হলেন তিনি, অধ্যাপক আলী আসগর, অথবা অধ্যাপক টুনটুনি। তিনি নিমেষে সেই বোধিবৃক্ষ তলায় টুনটুনিতে রূপান্তরিত না হলে প্রকৃতিতে, জগৎ সংসারের অপরূপ রাশি রাশি এই সৌন্দর্য দেখতে পেতেন না। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালেন ঘুঙুরের সুর ও শক্তিতে।
বুড়িগঙ্গা ব্রীজের নিচ থেকে রাজহাসের মতো সাতার কাটতে কাটতে চলে যাচ্ছে বিশাল লঞ্চ। অধ্যাপক টুনটুনি পাখি পাখার ঝাপটা দিয়ে পলকে সৌরলোক থেকে নিচে নেমে আসেন, উড়তে আরম্ভ করেন লঞ্চটির পাশাপাশি, নিরাপদ দূরত্ব রেখে। তার ভালো লাগে-লঞ্চটি যাবে বাগেরহাট। দোতলা বিশাল লঞ্চ। নাম- রূপসী। এই লঞ্চে চড়ে তিনি অনেকবার গ্রামের বাড়ি গেছেন। বরিশাল জেলার পিরোজপুর মহকুমার ভান্ডারিয়া থানার বোথলা গ্রামে, কচানদীর পারে শ্যামল স্নিগ্ধ একটি আঁচলে ঢাকা গ্রাম-আহা কতদিন যাওয়া হয় না গ্রামের বাড়িতে! যাবেন, পত্রিকায় একটা কলাম লিখতেন, এক সময়ে বাংলা ভাষার মহত্তম কবি-শামসুর রহমান, কলামটির নাম ছিল “পাখির চোখে দেখা”। সময় পেলে মন দিয়ে পড়তেন কলামটি। অধ্যাপক টুনটুনি বেদনাতুর মন নিয়ে অনেকক্ষণ উড়লেন রূপসী লঞ্চটার সাথে সাথে। এক সময়ে ফিরে আসলেন- রাত গভীর হয়েছে, বাসায় ফেরা দরকার। রূপসী লঞ্চটাকে পেছনে রেখে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ছেন, কী অবিস্মরণীয় সুখ-তিনি চেতনায় সম্পূর্ণ একজন মানুষ, অথচ শারীরিক কাঠামোতে এক পাখি, সামান্য পাখি নাম গোত্রহীন-টুনটুনি। তিনি অবাক নিজেই, এক ব্যাখ্যাতীত শিহরণে তিনি কম্পমান। মানুষ হয়ে আকাশে সৌরমণ্ডলে উড়ছেন, বুড়িগঙ্গার বিপুল জলরাশির উপর উড়ছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কি কখনও শুনেছে কেউ?
অধ্যাপক টুনটুনি ফিরে এলেন ব্রীজের উপর। বসলেন রেলিংয়ে- তাকালেন আবার চারদিকে। দূরে সদরঘাটে লক্ষ লক্ষ আলোর কারুকাজ। আকাশে তারার হাট-বাজার। দূর থেকে উড়ে যাচ্ছে সাদা শাড়ি পরিহিত মেঘদল। নিচে কলকল ছলছল পানির সঙ্গীতে তিনি মুগ্ধ হলেন। সৃষ্টির এই বিলাশ বিপুল বৈচিত্য এই হৃদয় মন ছেয়ে অনুভব করলেন। বিশ্রী শব্দ তুলে দূর পাল্লার বাস, দানব ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে-বিরক্ত হলেন তিনি, বাতাসে পাখা মেলে দিলেন। ফিরে চললেন বাসায়।
বাসায় ফিরে যেতে যেতে তিনি ভাবছেন-নিশ্চয় ছেলেমেয়ে-স্ত্রী মাকসুদা সবাই গম্ভীর উৎকন্ঠায় অপেক্ষায় দৌড়ঝাঁপে আছে। মজাটা বুঝতে চেষ্টা কর-হে মাকসুদা বেগম! আমাকে, আমার অক্ষমতা নিয়ে নিম্ন শ্রেণীর মোড়লিপনা আমার ভালো লাগে না। সারা জীবসের জন্য সাধারণ হয়ে যাও-মনে মনে ভাবছেন আর ডানা ঝাপটাচ্ছেন তিনি অধ্যাপক টুনটুনি।
বারান্দায় কিংবা ঘরের মধ্যে বিচলিতভাবে যখন ঘোরাঘুরি করবে মাকসুদা, দরজায় কারো শব্দ পেলে ছুটে আসবে সে, তখন অধ্যাপক টুনটুনি মাথার উপর দিয়ে, না হয় কানের পাশ দিয়ে নিমেষে উড়ে যাবেন। মাকসুদা অবাক হবেন, তাকে খপ করে ধরতে চাইবেন কিন্তু ধরতে পারবেন না, রাগে অন্ধ হয়ে গালিগালাজ করবেন, অথচ বুঝতে পারবেন না, ওই পাখিটি তার কে?
এক অসামান্য রহস্যের গন্ধ, উত্তেজনা নিয়ে অধ্যাপক টুনটুনি পাখি বাড়ির সামনে এলেন, ডানা দুটো প্রসারিত করে মৃদুভাবে বাড়িময় চক্কর দিতে লাগলেন। প্রথমে তিনি ভাবলেন- কোনো ভুল জায়গা, ভুল বাড়িতে এসেছেন কি? কিন্তু না, চক্কর দিতে দিতে তিনি দেখলেন, ঠিকই আছে, তার বাড়িতেই তিনি এসেছেন। টিনের চাল, ইটের শক্ত যথেষ্ট ডুরু দেয়াল, সাদা রঙ- সামনে টানা বারান্দা- বারান্দার পরে ছোট এক চিতুই পিঠার উঠোন। উঠোনে কয়েকটি ফুলের গাছ একেবারে বাইরে, রাস্তার সঙ্গে গেটের ডানপাশে সিমেন্টে লেখা ‘স্বপ্ননীড়’। বাড়িটা তারই, তাদেরই, কোনো ভুল নেই। কিন্তু কেউ কোথাও তাঁর জন্য অপেক্ষায় নেই- একেবারে প্রচণ্ড নিঝুম বাড়ি। এমনকি প্রতিরাতে ঘুমুতে যাবার আগে বাড়ির সামনের এক’শ পাওয়ারের বাল্বটি জ্বালিয়ে রাখের মাকসুদা, সেটাও নেই। পুরো বাড়িটা চমৎকার অন্ধকারে খা খা করছে।
তাহলে?
তাঁর প্রত্যাবর্তন কেউ আকাঙ্খা করে না? তাঁর ফিরে না আসা ‘শূন্যনীড়’ এর অন্য মানুষেরা আনন্দিত? সেটা কি করে সম্ভব? সারা জীবন স্ত্রী-সন্তানদের জন্য পরিশ্রম করছেন, জীবনে যতদিন বাঁচবেন তাদের জন্যই তো বাঁচবেন। ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক আলী আসগর সম্পদের সুখে বিশ্বাসী নন। নিজের জন্য কিছুই রাখতে চান না। মৃত হলে দেহটা দেবেন কোনো মেডিক্যাল মহাবিদ্যালয়ে। জ্ঞানপিপাসু ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার কাজে লাগবে এই প্রয়োজনহীন নশ্বর দেহটা। গবেষণা শেষ হলে দেহটা নদীর স্রোতে ভাসিয়ে কিংবা পুড়িয়ে দিতে বলবেন-কেননা তিনি চান না, মরে যাওয়ার পর পৃথিবীর মাটিতে তাঁর কোনো চিহ্ন থাকুক। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিনই জীবন, জীবনের সুখ-দুঃখ। মরে যাবার পর জীবনের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থই হয় না।
পুরো বাড়িটাকে তাঁর কাছে একটি অচেনা, পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়ির মতো লাগছে। তিনি দরজায় এসে থামলেন, কান পাতলেন, ভেতরে অস্ফুট মুখের শব্দ পাওয়া যায়। বাসায় কি চোর-ডাকাত ঢুকেছে? মাঝরাতে যদিও ছোট একটি পাখি মাত্র তিনি-তবু মানবিক চৈতন্যে তাঁর সারাটা শরীর ভয়ে কাঁপছে। তিনি কাকে ডাকবেন- কাকে বলবেন তাঁর ঘরে ডাকাত ঢুকেছে মাঝ রাতে? মুখে তো কথাই ফোটে না। কিচিরমিচির বা টুনটুন শব্দ করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারবেন? হঠাৎ অনাহূত এক যাতনায় মনটাতার বিষণœ হয়ে যায়। কীসের এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলেন যে ঘরের মধ্যে ডাকাত ঢুকেছে, অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না, মানুষ নয়- টুনটুনি পাখি হওয়ার কারণে!
হঠাৎ মনে হল মিষ্টি হাসির শব্দ, টুংটাং চুড়ির শব্দ-অধ্যাপক টুনটুনি-এক ধাঁধায় পড়ে গেলেন, কিছুটা বিচলিত এবং বিপন্ন তিনি, কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। বাড়িতে যদি ডাকাত পড়বে তাহলে লোভনীয় হাসি আর আমোদিত চুড়ির শব্দ আসবে কেন? অধ্যাপক টুনটুনি উড়ে জানালার কাছে গেলেন, জানালার একটা পাট খোলা, নিঃশব্দে জানালার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকলেন। না, কোনো ডাকাত কিংবা চোর অথবা তস্কনেন দেখা নেই। সামনের রুমে ছেলে ঘুমে আচ্ছন্ন। ঢুকলের ভেতরের ঘরে, মেয়ে মৌলিও ঘুমিয়ে আছে। গেলেন পেছনের রুমে, যেখানে থাকেন মাকসুদা আর তিনি। ঘরটার মধ্যে শূন্য পাওয়ারের সবুজ বাল্ব জ্বলছে। সবুজ আলোয় ঘরটা নাচছে। দরজার উপর উঠে তিনি দেখতে পার তারই দুগ্ধসাদা বিছান দুটো শরীর। একটি মানবীর, অন্যটি মানবের।
অধ্যপক টুনটুনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না। তিনি কি দেখছেন? স্বপ্ন ক্লান্তিবিলাস? নাকি ভ্রান্তিবিলাস? চোখ রগড়ে তিনি আবার তাকান- না কোনো ভূল নেই তাঁর অমৃত দৃষ্টিতে, তাঁর বাড়ি, তাঁর ঘর তাঁরই বিছানা। সেই বিছানায় সম্পূর্ণ উদোম শুয়ে আছে তাঁর স্ত্রী মাকসুদা, পাশে আর একজন- আকার প্রকার দেখে বোঝা যায় বদমাইশ পুরুষ, সেও উদোম, ন্যাংটা। দু’জন দু’জনকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরেছে। মাকসুদার উষ্ণ নরম পায়রা জোড়া ঠেকছে নগ্ন পুরুষ মানুষটির নগ্ন লোমশ বুকে, দু’জন দু’জনকে দু’হাতের বেষ্টনীতে আঁকড়ে ধরছে, মুখে মুখে ঘষছে, ঠোঁট জিহবা চুষছে। দু’জন দু’জনকে পরম নিবিড়তায় দলন মলন করছে। এক অনির্বজনীয় অবিরাম সুখের শরবত পান করতে করতে পুরুষটি উঠে বসে মাকসুদদার বুকের উপর, মাকসুদা স্বর্ণাভ পা দুটো দু’দিকে ছড়িয়ে পুরুষটিকে মন্থনের জায়গা করে দেয়- আর ঠিক তখনই চিনতে পারে পুরুষটিকে।
সাঈদ হোসেন দেলোয়ার।
সোনু ভবন- তাদের বাড়ির পাশেই দেলোয়ারের বাড়ি। ঘনিষ্ট প্রতিবেশী। দেলোয়ার দেখতে সুপুরুষ। চমৎকার আড্ডাবাজ। স্থানীয় বাজারে কয়েকটি দোকান আছে তার। ভাড়া দেয়। জমি জমাও আছে। স্থানীয় মানুষ। প্রভাব- প্রতিপত্তির সঙ্গে থাকে। অধ্যাপক আলী আসগরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। এক প্রকার বন্ধুর মতো। দু’জনে দু’জনার বাসায় আসা-যাওয়া আছে।
বাড়ি তৈরীর সময় সাঈদ হোসেন দেলোয়ান অনেক সাহায্য করেছে। তাঁর আত্মীয়ের ট্রাক দিয়ে প্রায় অর্ধেক টাকায় ইট বালি এনে দিয়েছে। নিজের লোক দিয়ে পাহারা দিয়েছে। আলী আসগর খুবই কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। বাড়ি বানাবার সময় এলাকার চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা চাঁদা নিতে এলে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।
কি চাস তোরা?