উপন্যাস

উপন্যাস।। ভালোবাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব এক

দপদপ করে ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে সে। একবার টিভি খুলছে আবার বন্ধ করছে। আবার খুলছে আবার বন্ধ করছে।
এইরকম বারবার করে খুলছে এবং বন্ধ করছে। যেন শব্দময় ঘর এবং নিঃশব্দতার ভেতরে একটা যােগসূত্র বের
করার চেষ্টা করছে সে। শব্দের ভেতরেও আবার এক প্রকারের শব্দে যেন সে সন্তুষ্ট নয়। বিভিন্ন ধরনের শব্দ,
ব্যঞ্জনা এবং ধ্বনির ভেতরে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখছে। একবার বিটিভি দেখছে আবার ডিশ চালাচ্ছে।
এই স্টার প্লাস দিল, এই দিল এটিএন, আবার দূরদর্শন, আবার জিটিভি, আবার বিবিসি, পরে জি সিনেমা।
ঘুরে আবার বিটিভি। বিটিভি দেবার সময় তার পাল্টাতে হয়। দিব্যি সে নিজে নিজেই তার পাল্টে নিচ্ছে।
কারাে ওপর নির্ভর করা নেই। কারাে অনুমতি নেবারও যেন কিছু নেই। তার মানে এইসব কায়দা কানুন সে আগেই
জানত। কিন্তু ভাব দেখাত জানে না। এই ব্যাপারে সে। সাইকোলজিস্টদেরও নাক কাটবে। সে ভাল করে জানত
বাসাবাড়ির সাহেব বেগমরা এসব। নানা পছন্দ করে না। কিন্তু দাবার খুঁটি এখন উল্টে গেছে। এ বাড়ির পরিস্থিতি
এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাহেব- বেগমই যেন তার কাছে জিম্মি। তার মুখের একটি হাঁ এবং না এর ওপরে এ বাসার
সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। শােবার ঘরে খাটের ওপরে পা তুলে বসে দরজার এপাশ থেকে সবই শুনতে পাচ্ছে
সালমা। ঘর অন্ধকার। হাসান ঘুমাচ্ছে। রাত এখন এগারােটা। কিন্তু সালমার কাছে মনে হচ্ছে যেন। অনেক রাত।
আজ সাড়ে ন’টার ভেতরে শােবার ঘরের দরজা বন্ধ করেছে সে। রাত আটটার ভেতরে খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলেছে।
অন্যদিন হলে এত সকালে রাতের খাবার খেতে হাসান আপত্তি করত। আজ সে করেনি। তবে ভাল করে সে খায়ও নি।
নাকি তার খিদে ছিল না। অন্ধকারে খাটের ওপরে চুপচাপ বসে থাকলেও সালমার ভেতরটা টগবগ করে ফুটছে।
অগ্নিগিরির গরম লাভা যেমন টগবগ করে ফুটে ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে, তেমনি অতৃপ্ত ও অশান্ত হয়ে উঠেছে
সালমার ভেতরটা। ক্ষোভ ও দুঃখ তার বুক থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে বেরিয়ে কুয়াশার মত জমে যাচ্ছে বাতাসে। হাসান
একবার কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সালমা মুখে আঙুল টিপে তাকে শাসন করেছে– চুপ। ফিরােজা এখন রান্নাঘরে
ঢুকে ভাত খাচ্ছে। ঠকাস, ঠকাস করে শব্দ করছে দরজায়। ঝনঝন করে নাড়াচাড়া করছে বাসন। তার ইচ্ছেটা বােঝা
যাচ্ছে স্পষ্ট। যুদ্ধে আহ্বান করছে সে সালমাকে। আসুক, সালমা তার সামনে। এসে দাঁড়াক। দেখা যাক কার কী কথা
আছে। অথচ এরকম হবার কথা ছিল না। এরকম মন – মানসিকতা নিয়ে সে বড় হয় নি। এত বড় জঘন্য সমঝোতা
করার কথা কল্পনাও করে নি সে জীবনে। অথচ আজ তার নিয়তি কোথায় টেনে এনে ফেলেছে তাকে।

ভেতরটা বড় অস্থির লাগছে সালমার। গত কয়েকদিন ধরে যেন ঝড় বয়ে গেছে বলে। কালো হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি
মেলার। চুল পালের ওপরে আলুথালু। প্রথম তাে একেবারে হতব্ব অহা। হাসানের বিপর্যস্ত হওয়া চোখে ভাসহ হন নন।
হাসানের চোখের দিকে প্রথমে সালমা তাকাতেই পারে নি। বেলিথালার মুখে খবরটা পেত। একেবারে মাথায় যেন বাজ
ভেঙে পড়েছিল তার। একি, এ সব কী! জীবন মানুষের বিভিন্ন ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যায়, সালমা জানে।
তার জন্যে সে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিল বলা যায়। বুকে সাহস ছিল তার, মাথায় বুদ্ধি। তার পাশে ছিল হাসান, স্বামী ও
প্রিয়তম। মাত্র তিনবছর হল বিয়ে হয়েছে তাদের। সন্তান ইচ্ছে করেই সংসারে আনেনি। এম.এ পাস করে মাত্র একবছর
হল চাকরিতে ঢুকেছে। একটু থিতু হলেই বাঙ্গা নেবে। এখন তার বয়স চলছে আটাশ। হাসান তার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল।
সালমার বাড়ি থেকে এ বিয়েতে আপত্তি উঠেছিল প্রথমে। ক্লাসের সহপাঠীর সাথে বিয়ে, তার ওপর মফস্বলের ছেলে,
ঢাকায় কোনাে স্থায়ী নিবাস নেই, আর্থিক অবস্থা কোনােরকম, সালমার মা ভীষণ ভাবে এ বিয়েতে আপত্তি করেছিলেন।
তার ওপর পাস করার পর পর বিসিএস না দিয়ে বা কোনাে চাকুরিতে না ঢুকে এক বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে ব্যবসায়
নেমেছে। এ নিয়েও আপত্তি ছিল তার। সালমাদের বংশে প্রায় সকলে চাকুরিজীবী। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তারা
উচ্চপদে আসীন। সালমার মায়ের ইচ্ছে ছিল কোনাে সরকারি গেজেটেড অফিসারের। সাথে সালমার বিয়ে হােক।
যেমন ফরেন সার্ভিসে সালমার মায়ের এক ভাইপাে ছিল। মায়ের ফুপাতাে ভাইয়ের ছেলে। নাম আসলাম। দেখতে
শুনতে চৌকষ। পরিষ্কার ইংরেজি বলে। সালমার মায়ের গােপন নয় প্রকাশ্য ইচ্ছে ছিল সালমার সাথে আসলামের বিয়ে
হােক। দু’জনের নামের ভেতরেও এক ধরনের সমতা তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন বিয়ের আগেই। কিন্তু সমতা
আবিষ্কারের পরও সালমা আসলামকে বিয়ে করে নি। এমনকি তার নাম পর্যন্ত শুনতে চাইত না। কিন্তু আসলাম যেন
মনে হয় সালমাকে তার জীবনে আশা করেছিল। প্রায় তাদের বাড়িতে এসে ভাবিদের সাথে বসে সময় কাটাত। বড়ভাবি
একদিন ঠাট্টা করে সালমাকে বলেছিল, কীগাে, তুমি তাে তােমার লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত এদিকে আসলাম মিয়া যে তােমার
সাথে কিছু কথা বলার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। সালমা শুনে রুখে উঠে বলেছিল, কেন? বড়ভাবি তার রুদ্রমূর্তি দেখে
রাগ করে উঠে বলেছিল, কেন আবার কী! তুমি তাে ছেলেমানুষ নও। সবই বোঝ। সালমা বড়ভাবির কথার জবাব দেয়নি।
দিলে সেটা আরাে বেয়াদবি হয়ে যেত। একদিন বাড়ির সিড়ির কাছে আসলাম তাকে ধরেছিল। বলল, শামু, তুমি কি বাইরে
একেবারে হাতে নাতে ধরা পড়ে সালমা অপ্রতিভ হয়ে গেল। কোনােরকমে বলল, হ্যা তুমি কি আমাকে কিছুক্ষণ সময় দেবে?
আমি কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম। মনে মনে বিরক্ত হয়েছিল সালমা। তবু সেটা গােপন রেখে বলল, আমি তাে এখন একটু
ব্যস্ত আছি। পরে বলবেন। আসলাম সেকথা শুনে বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ? টিএসসি, সালমা বলল । তাহলে চল আমি
তােমাকে সেখানে পৌছে দিই, আসলাম বলল। সালমা বেরোচ্ছি।

ভেবে দেখল প্রস্তাবটা মন্দ নয়। বাইরে তখন কড়কড়ে দুপুর। রাস্তার পিচ গলতে শুরু করেছে। বাসার গাড়িটা বড়ভাইয়ের
কাছে। এই সময় রিকশা করে মগবাজার থেকে টিএসসি একটু দূর হয়ে যায়। একরকম নিমরাজি হয়ে আসলামের সাথে সে
তার গাড়িতে এসে বসল। আসলাম তখন নতুন একটা গাড়ি কিনেছে। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আর গুলশানে থাকে বলে।
আসলামের জীবনটা ছেলেবেলা থেকে স্বচ্ছন্দ। আসলামের বাবাও তার বাবার মতই শেষ বয়সে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভূমি সচিব
হিসেবে রিটায়ার্ড করেছেন। আসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশােনা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে ঢুকেছে। পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সে এখন। সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি। পাত্র হিসেবে বাজারে এমন লােভনীয় বস্তু যে হা করলেই হাজারটা
মেয়ে আসলামের পায়ের কাছে এসে পড়বে। কিন্তু আসলামের সেই এক গো। সে সালমার আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে চায়।
তার ওপর আসলাম জানে, সালমার বাড়ির সকলেই তাদের দু’জনের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী। সালমার সেদিন একটা
বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা জীবনের। আসলামের গাড়িতে ওঠার সময় ভেবেছিল হয়ত লােকটা গাড়ির ভেতরে ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে।
সারাটা পথ ঘ্যানঘ্যান করতে করতে কানের পােকা নড়িয়ে দেবে তার। কিন্তু আশ্চর্য, আসলাম একটা কথাও তার সাথে বলে নি।
অথচ আলাপের শুরুতেই আসলাম বলেছিল তার সাথে কিছু কথা আছে। ভেতরে ভেতরে অবাক হয়েছিল সালমা। সারাপথ
অস্বস্তির সাথে তার কেটেছিল। আসলাম শুধু ড্রাইভিং সিটে বসে সালমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কোন ক্যাসেট চালাবো,
রবীন্দ্রসঙ্গীত না পপ? সালমা এ কথায় ঘাড় নেড়েছিল, যার অর্থ যে কোনাে একটা হলেই চলবে। তখন আসলাম বাজিয়েছিল
একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। যার প্রথম লাইনটা ছিল এরকম, বধু, কোন আলাে লাগল চোখে। ক্যাসেটটা যে আসলাম নিজের ইচ্ছেই
বেছে নিয়েছিল তা ঠিক না, হাতের কাছে যেটা ছিল সেটাই সে বাজিয়েছিল কিন্তু সালমার ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তির জন্ম
হয়েছিল। সে কোনােরকমে টিএসসি’র কাছে পৌছেই তড়িঘড়ি করে বিদায় নিয়েছিল আসলামের কাছ থেকে। সে কতদিনের
কথা। তারপর তাে সালমার বিয়ে হল হাসানের সাথে। বিয়েটা দায়সারার মত করে হল। বাবা মারা গিয়েছিলেন। মা ও
ভাইভাবিদের অমতে বিয়ে। বিয়ে ঢাকায় হয়েছিল। হাসানের আত্মীয়স্বজন ঢাকায় এসে কিছুটা হােটেলে কিছুটা আত্মীয়স্বজনের
বাসায় থেকে হাসানের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পর প্রায় সাথে সাথেই সালমা রাজশাহীতে শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছিল।
প্রায় একমাস বাদে হাসানের সাথে আবার ফিরে এসেছিল ঢাকায়। সালমাকে বউ হিসেবে পেয়ে হাসানের মা-বাবা ভারি খুশি
হয়েছিলেন। হাসানের ভাবিগুলাে এবং বড় বােনেরা যথেষ্ট আদর যত্ন করেছিল সালমাকে। সালমা মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল।
রাজধানীতে হাসানের বাড়িঘর নেই বলে তার মনে বিন্দুমাত্র দুঃখ হয় নি। সে তাে হাসানকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল।
এ এমন এক ভালবাসা যা জঙ্গলে গিয়েও সুখের কুটির গড়ে তুলতে পারে।

হাসানের পার্টনারশিপের ব্যবসাটা চলছিল ভালই। কিন্তু হঠাৎ পতন হয়ে গেল এরশাদের। নন সরকার এল। একটু টসকে গেল
ব্যবসা। অবশ্য হাসান খুব আশাবাদী। সহজে ঘাবড়াবার ছেলে সে নয়। সে জানে এটা সাময়িক মাত্র। সালমাকে কতদিন লুকিয়ে।
সে কোনো নতুন সরকার দেশের হাল ধরলে প্রথম অবস্থায় ব্যবসার একটু মন্দা দেখা যেতে পারে। মানুষের সন্দেহ, ভয় ও সংশয়
কাটতেই কয়েকমাস সময় লেগে যায়। তাছাড়া হাসানের ঘাড়ে তার নিজের পরিবারের তরফ থেকে কোনােরকম দায়দায়িত্ব নেই।
সে পরিবারের ছােট ছেলে। আর হাসানের বাবার স্বভাব এমন যে কারাে কাছে হাত পাতেন না। নিজের ছেলে হলেও। তিনি সামান্য
একজন ডেপুটি কালেকটর হিসেবে রিটায়ার্ড করেছেন। বটে, কিন্তু দেশে তার যেটুকু জমিজমা আছে তা দিয়ে বছরের খরচ
মােটামুটি চলে যায়। সালমা এইসব আগে থেকে জেনে শুনেই হাসানকে বিয়ে করেছে। সালমার জীবনে একটাই প্রত্যাশা তা
হলাে হাসানকে সমাজে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা। এটা সে তার নিজের মা বেঁচে থাকতে থাকতেই দেখতে চায়। নিজের
মায়ের প্রতি সালমার এক ধরনের ক্ষোভ আছে। উনি এখন পর্যন্ত হাসানকে সালমার জামাই বলে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেন
নি। হাসানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে মায়ের ভুলটা শােধরানাে সালমা তার নিজের জীবনের একটা মিশন বা লক্ষ্য হিসেবে
নিয়েছে।শােবার ঘরের পাশে যে ঘরটা সেটাকে ড্রয়িংরুম করেছে সালমা। ফ্ল্যাটে ঢুকেই হাতের বাঁ দিকের দরজা দিয়ে সরাসরি সে ঘরে ঢােকা যায়। আবার শােবার ঘরের ভেতর দিয়েও একটা দরজা আছে ড্রয়িংরুমে যাবার। এই রুমটা শুধু ড্রয়িংরুম নয়, হাসানের ওয়ার্করুমও বটে। আর এ কারণেই টেলিভিশনটাকে ড্রয়িংরুমে না রেখে ডাইনিং স্পেস- এ রাখা হয়েছে। রাতে এ রুমে বসে হাসান কম্পিউটার চালায়। নতুন নতুন প্রােজেক্ট হাসানের মাথায়। সেগুলাে একটা একটা করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সে। শুধু সে নয়, তার পার্টনারও। হাসানের কাজ হচ্ছে বুদ্ধি দেয়া আর প্ল্যান তৈরি করা আর তার পার্টনারের কাজ হচ্ছে দৌড়াদৌড়ি আর গুড কানেকশনস স্থাপন।

কাজের বুয়া না থাকলে সালমার পক্ষে চাকরি করা মুশকিল হয়ে যায়। হাসান সেই ভােরে উঠে বেরিয়ে যায়। তার নাস্তা তৈরি করে দিতে হয় সকালে। টিফিনক্যারিতে দুপুরের খাবারও যেমন পরােটা মাংস ভরে দিতে হয় । সালমা নিজেও সকালে নাস্তা করে। আবার ছোট একটা সুদৃশ্য প্লাস্টিকের বাকসে দুপুরের খাবার জন্যেও কিছু ভরে নেয়।

বছরখানেক আগে সালমা যখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে একদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরে দেখে কাজের মেয়ে উধাও। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখা সাধারণ কিছু সােনার গহনা, একটা টেবিল ঘড়ি, কিছু স্যুভেনির ও কিছু জামাকাপড় নিয়ে সে পালিয়ে গেছে। অনেক খোঁজ করেও পাওয়া যায় নি। থানায় জিডি করা হয়েছিল। সাতলায় উঠে এসেছিল পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ করল পাশের ফ্ল্যাটের চাকরদের। তাতে করে কাজের মেয়ে খুঁজে পাওয়ার চেয়ে নুইসেন্স হলে বেশি। মন খারাপ করে কাটল ক’দিন সালমার। এদিকে কাজের বুয়া না থাকলে সংসার চলে না। ঘরমোছা, কাপড় কাচা, রান্না করা সব চাপ এসে পড়ে সালমার ঘাড়ে। হাসানের আবার ছুঁচিবাই আছে। ঘরদোর সব টিপটপ রাখতে হবে। কাজে বেরােবার সময় রােজ ধােপদুরস্ত জামাকাপড় চাই। সাদা রঙ ছাড়া শার্ট পরে না। সাদা রঙ সাদা রাখতে গেলে অনেক কাঠখড় পােড়াতে হয়। জুততা, টাই, চশমা সব ঠিকঠাক থাকতে হবে। হাসান নিজেই অবশ্য সেগুলাে ঠিক রাখে। সে জানে ব্যবসা মন্দা গেলেও ব্যবসায়ীকে মন্দ দেখালে চলবে না। তাতে করে ব্যবসার ভরাডুবি হবে। বিশেষ করে ইনডেন্টিং ব্যবসায় ভাল থাকাটা বিশেষ জরুরি। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সাথে আলাপ হচ্ছে। তাদের নতুন ধরনের চাহিদা। অফিস, অফিস স্টাফ ও এজেন্ট সবকিছু পুরনাে এবং রিলায়েবল দেখানাে চাই। কিন্তু চেহারার দিক থেকে থাকতে হবে একেবারে ঝকঝকে, তকতকে নতুনের মতাে।

এখন অনেক রাত। সালমা অন্ধকারে বিছানায় উঠে বসে আছে। সে অনেককিছু ভাবছে। এলােমেলাে সেসব ভাবনা। তার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। মাথার চুল এলােমেলাে হয়ে পড়ে আছে পিঠে। চোখের কোলে অদ্রিার ছাপ। সাততলায় থাকে বলে জানালা খােলা রেখেছে। সে পর্দা সরিয়ে রেখেছে। এমিরেটস্ এর লাল-সবুজ নিয়ন এসে হাসানের মুখের ওপর পড়ছে। রাস্তার ওপারে আরেক সাততলার মাথায় এয়ার এমিরেটস এর বিশাল এক বিজ্ঞাপন আছে।

সন্ধে থেকে সারারাত জ্বলে আর নেভে। একবার লাল হয়ে নেভে। একবার সবুজ হয়ে নেভে। আবার লাল হয়ে নেভে। এমনি সারারাত। এই নিয়নের আলােটা মাঝে মাঝে বিরক্ত করে সালমাকে। অবশ্য যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ। হাসান অবশ্য এই আলাের লুকোচুরিটা পছন্দ করে বেশ। সালমাকে আলাের সামনে ধরে মাঝে মাঝে বলে, এই হলাে। আমার লাল সালমা, এই হলাে আমার সবুজ সালমা। রাতের বেলা আমার দুটো সালমা। একটা লাল, একটা সবুজ। সালমা একদিন ঠাট্টা করে বলল, আর দিনের বেলায় ক’টা সালমা। দিনের বেলায় একটা সালমা, সাদা। হাসান বলল। তাহলে মােট কটা সালমা তােমার ? সালমা জিজ্ঞেস করল । দিনে রাতে মিলিয়ে আমার তিনটে সালমা। একটা লাল, একটা। সবুজ, আরেকটা সাদা। তাহলে আরেকটা সালমা জোগাড় কর। আরেকটা রঙের সালমা। তখন চার সালমা হবে তােমার। মুসলমানের চার বিয়ের কোটা শেষ। এই বলে হেসে উঠেছিল সালমা । আর সেই হাসি শুনে আদর করে তার গালে চাপড় মেরেছিল হাসান। সালমা এখন তাকিয়ে দেখল চেহারায় আবছা লালের ছাপ নিয়ে কী নিশ্চিন্তে ঘুমােচ্ছে হাসান। ঘুমােলে শিশুর মত সরল ও নিস্পাপ হয়ে যায় হাসানের মুখ। সরল ও নিস্পাপ? সত্যিই কি হাসান সরল ও নিস্পাপ? আসলে প্রিয়জনের প্রতি আমাদের মনের অন্ধ আবেগ ও অন্ধ বিশ্বাসই কি তাদের সরল ও নিস্পাপ করে রাখে না? সালমা ভাবতে লাগল।

আসলে অস্থির, ভারি অস্থির হয়ে উঠছে সালমার ভেতরটা। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটছে। অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব। নাকি বাস্তব? আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সালমা। আশেপাশের আলােয় ঘরের ভেতরটা মােটামুটি দেখা যায়। টিপিটিপি পায়ে হেঁটে সে টিপয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আস্তে করে পানির বােতল থেকে পানি ঢেলে খেল। ভেতরটা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছিল তার। এবার ঘড়িতে সময় দেখল সে। রাত সাড়ে বারােটা। মাত্র সাড়ে বারাে। এখনাে কতদীর্ঘ রাত সামনে পড়ে আছে সালমার। কথাটা ভেবে তার গা শিউরে ওঠল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *